শিল্পোন্নত দেশ জাপানের বাজারভিত্তিক অর্থনীতি বিশ্বের ২য় বৃহত্তম অর্থনীতি। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের অর্থনীতি মূলত ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। ভঙ্গুর এ অর্থনীতি পুনর্বাসন এবং পুনর্গঠনে জাপানিরা কঠোর পরিশ্রম করে। ৫০ বছরের পর জাপানের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৪৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এর মূলে ছিল জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা।
২য় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালে জাপান তাদের শিক্ষার জন্য আইন পাস করে। বর্তমান জাপানের শিক্ষাব্যবস্থায় সেই আইনের প্রভাব অনেক।
জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থা:
জাপানের অপরাধ শতকরায় শূন্য। জাপানিদের এমন সুন্দর সমাজব্যবস্থার ভিত্তি আসলে কি? বা আপনি যদি অন্যভাবে প্রশ্ন করেন তাদের এমন চরিত্র গঠনের ভিত্তি কোথায়? তাহলে একবাক্যে বলতে হয় সেটা শেখানো হয় তাদের স্কুলগুলোতে। তাদের স্কুলে অনেক কিছু শেখানো হয়। যার মধ্যে গণিত, ভাষা, নৈতিকতা ইত্যাদি। জাপানের স্কুলগুলোতে জীবনমুখী শিক্ষা দেয়া হয়। শেখানো হয় সামাজিকতা, ন্যায়-অন্যায়, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি।
জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা ৫ ভাগে বিভক্ত। কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ৩-৫ বছর, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬-১১ বছর, জুনিয়র হাইস্কুল/মিডল স্কুলে ১২-১৪ বছর এবং সিনিয়র হাইস্কুলে ১৫-১৭ বছরের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা দেয়া হয়। আর বিশ্ববিদ্যালয় অথবা ভোকেশনাল স্কুল ২-৪ বছরমেয়াদি হয়।
জাপানের প্রাথমিক বিদ্যালয় আর জুনিয়র হাইস্কুল হচ্ছে বাধ্যতামূলক শিক্ষার পর্যায়। প্রাথমিক স্কুল ৬ বছর আর মিডল স্কুল ৩ বছর। ৬ বছর হলে শিশুরা প্রাথমিক স্কুলে যেতে পারে। সরকারি এবং বেসরকারি দুই ধরনের প্রাথমিক স্কুল রয়েছে। দুই ধারাই বেশ জনপ্রিয়। আমার আজকের লেখা জাপানের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে।
জাপানের প্রাথমিক স্কুলগুলোতে ছাত্র-ছাত্রীরা এক ধরনের টুপি পরে আর ‘রানদোশেরু’ নামক এক ধরনের ব্যাগ বহন করে।
টুপি একেক স্কুলের জন্য ভিন্ন রং হতে পারে। ছেলে এবং মেয়েরা ব্যাগ পিঠে বহন করে স্কুলের পথে হেঁটে যায়। স্কুলে আসার পর তারা জুতা বদল করে ক্লাসরুমের জন্য ভিন্ন জুতা পরে নেয়।
প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিশুরা সোমবার থেকে শুক্রবার সপ্তাহে ৫ দিন ক্লাস করে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক-একটি ক্লাসের সময়সূচি হল ৪৫ মিনিট। প্রতিটি ক্লাসের মাঝে ১০-১৫ মিনিট বিরতি থাকে। একদিনে সর্বোচ্চ ৬টি ক্লাস হয়। টিফিনের আগে ৪টি ক্লাস, টিফিনের পরে ২টি ক্লাস।
দিনের শুরুতে প্রধান শিক্ষক সবার আগে স্কুলে আসেন। তিনি স্কুল গেটে দাঁড়িয়ে সব ছাত্র-ছাত্রীকে অভ্যর্থনা জানান। শিক্ষার্থীরা স্কুলে ঢুকে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন। ক্লাস শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত কেউ খেলাধুলা, কেউ বিভিন্ন প্রোগ্রামিং কার্যক্রম, কেউ হ্যান্ড ক্রাফটে কাজ করে।
ক্লাস শুরু হওয়ার ইঙ্গিতস্বরূপ এক ধরনের বিশেষ মিউজিক বেজে উঠে। তখন সব ছাত্র-ছাত্রী দলবেঁধে ওয়াশরুমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে শ্রেণিকক্ষে ফেরে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নানারকমের সাবজেক্ট পড়ানো হয়। যেমন জাপানি ভাষা, গণিত, ইতিহাস, শরীরচর্চা, সংগীত ও শিল্প, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, বিজ্ঞান, অংকন বিদ্যা, নৈতিক শিক্ষা ইত্যাদি। এ সব ক্লাসের সঙ্গে সঙ্গে আরও বিশেষ কিছু ক্লাস এবং সমন্বিত পাঠ্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে হয় নিয়মিত।
প্রতিটি ক্লাসে ৩০-৩৫ জন ছাত্র-ছাত্রী থাকে। প্রতিটি ক্লাসে একজন শিক্ষক থাকেন। সংগীত আর শিল্পকলা এবং শারীরিক শিক্ষার জন্য একজন বিশেষজ্ঞ শিক্ষক থাকেন।
জাপানের স্কুলগুলোতে শিশুদের কিছু বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কাজ করতে হয়। যেমন সকালের সমাবেশের সময় শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করা, শ্রেণিকক্ষে ছাত্র-ছাত্রীদের হাজিরা ক্ষেত্রে শিক্ষককে সহযোগিতা করা, বাগানের পরিচর্যা করা, খাবার পরিবেশন করা এবং খাবারের পর পরিষ্কার করা ইত্যাদি।
জাপানের প্রাথমিক স্কুলগুলোতে দুপুরের খাবার বিদ্যালয় থেকে পরিবেশন করা হয়। খাদ্য তালিকা এবং খাবারের গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য একজন ডায়েটেশিয়ান থাকেন। ডায়েটেশিয়ান বাচ্চাদের কোন্ খাদ্যের কতটুকু ক্যালরি প্রয়োজন তা হিসাব করে ব্যালান্সড ডায়েট তৈরি করেন যা দেখে দক্ষ এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাবুর্চিরা খাবার রান্না করেন।
প্রত্যেকটি স্কুলে নিজস্ব রান্নাঘর রয়েছে। দুপুরের খাবারের সময় ছাত্র-ছাত্রীরা সংগীতের তালে তালে খুব আনন্দের সঙ্গে বিশেষ ধরনের পোশাক পরে সারিবদ্ধভাবে রান্নাঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে শ্রেণিভিত্তিকভাবে নিজেদের উপস্থিতির জানান দেয়। তখন রান্নাঘরের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিগণ খাবার বুঝিয়ে দেন। খাবার নিয়ে ক্লাসে ফিরে ছাত্র-ছাত্রী নিজেরাই খাবার পরিবেশন করে।
খাবার গ্রহণের সময় শিশুদের জানানো হয়, তারা কি খাচ্ছে এবং কেন খাচ্ছে ইত্যাদি। শেখানো হয় যিনি খাদ্য রান্না করেছেন তার প্রশংসা কিভাবে করতে হয়। খাবার গ্রহণের সময়টাতে শিশুরা প্রার্থনা শুরু করে এবং খাবার শেষেও। খাবার গ্রহণ শেষ হলে শ্রেণিকক্ষ পরিষ্কার করে আবার শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়।
স্কুলে খাদ্যগ্রহণ করার জন্য রয়েছে সুন্দর ব্যবস্থাপনা। খাবার গ্রহণের আগে এবং পরে যাতে শিশুরা হাত ধুতে পারে তার জন্য প্রতিটি ক্লাসরুমে এবং ফ্লোরে রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। বেসিন এবং পানির ট্যাপগুলো শিশুদের বয়স বিবেচনার উপর ভিত্তি করে বসানো হয়।
ওয়াশরুমে ছবির সাহায্যে হাত ধোয়ার গুরুত্ব এবং পদ্ধতি বলে দেয়া থাকে। প্রতিদিন দুপুরের খাবারের পর ছাত্র-ছাত্রীরা নিয়ম মেনে দাঁত ব্রাশ করে। মাঝে মাঝে দাঁতের ডাক্তারগণ এসে শিশুদের চেকআপ করেন।
জাপানের স্কুলগুলোতে পরিচ্ছন্ন শৌচাগারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। প্রত্যেকটি ফ্লোরে পরিচ্ছন্ন শৌচাগার রয়েছে। শৌচাগারগুলো ছেলে-মেয়েদের বয়স উপযোগী করে তৈরি। বাথরুমে যেতে সে সব জুতা পরিধান করতে হয় সেগুলো দরজার সামনে পরিপাটিভাবে সাজানো থাকে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ৩য় শ্রেণি থেকে প্রোগ্রামিং শেখানো হয়। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য সমৃদ্ধ ল্যাবরেটরির ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে কিচেন রুম। শ্রেণিকক্ষে যে সব বিষয় শেখানো যায় না তার জন্য ফিল্ড ট্রিপের ব্যবস্থা করা হয়। ফিল্ড ট্রিপে শেখানো হয়; কিভাবে ধান লাগানো হয়, কিভাবে পরিচর্যা করতে হয় ইত্যাদি।
জাপানে প্রায়ই বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে। তা ক্লাসগুলোতে গুরুত্ব দিয়ে দুর্যোগকালীন কি করণীয় এবং কি বর্জনীয় তা শেখানো হয়। ভূমিকম্প শব্দ উচ্চারণ করামাত্র দেখলাম ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাসের টেবিলের নিচে আশ্রয় নিল। সেখানে ছাত্রদের একটি ছক দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করা হয় তুমি দুর্যোগকালীন উক্ত তালিকার কি কি সঙ্গে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটবে?
প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করানো হয়। সেখানে তারা ফুটবল, দৌড়সহ বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করে। বিশেষ ধরনের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আলাদা ক্লাসরুমের ব্যবস্থা রয়েছে। কোনো ছাত্র-ছাত্রী লেখাপড়ায় ভালো না করলে তাকে সেই বিশেষ রুমে নিয়ে আলাদাভাবে যত্ন নিয়ে পড়ানো হয়।
প্রতিটি বিদ্যালয়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স থাকে। দায়িত্বপ্রাপ্ত নার্স শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যাগুলো দেখেন।
প্রতিদিন ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধরনের ক্লাব এক্টিভিটিস কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। সেখানে তারা বিভিন্ন অংকন, বিভিন্ন কোম্পানির লোগো সংগ্রহ করা, জন্মদিন পালন ইত্যাদি কাজ করে। সর্বোচ্চ সংখ্যক লোগো সংগ্রহকারীকে পুরস্কৃত করা হয়।
একটি মাসে যতজন শিশু জন্মগ্রহণ করে তাদের সবার জন্মদিন মাসের একদিন পালন করা হয়। এরমধ্যে দিয়ে তাদের মধ্যে ভ্রাতৃপ্রেম গড়ে উঠে। স্কুলগুলোতে কোনো ধরনের হোম ওয়ার্ক দেয়া হয় না। বিদ্যালয়ে তারা আনন্দঘন পরিবেশের মধ্যে সময় অতিবাহিত করে।
স্কুল থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে তাদের প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। জাপানিজ শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো আদর্শের সূতিকাগার। বিদ্যালয়ের প্রতিটি কর্মকাণ্ড সুনাগরিক তৈরির ভিত্তি।
একেকজন শিক্ষক সেই ভিত্তির বুনিয়াদ। তাই তাদের সমাজের আদর্শতম মানুষ বলা হয়। আর প্রতিনিয়ত তাদের অনুসরণ করে অন্যরা।
Development by: webnewsdesign.com