দেড়শ বছরের ডিনস্টন সিমেন্ট্রি স্মৃতি বিজড়িত এপিটাফ ‘ইন লাভিং মেমোরি অব মাই হাজব্যান্ড’। স্বামীর কবরে প্রিয়তমা স্ত্রী জেসিজি লিখে গেছেন ‘ইন লাভিং মেমোরি অব মাই হাজব্যান্ড’! স্বামীর মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে সুদূর ইংল্যান্ড থেকে তদানীন্তন পূর্ব বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে ছুটে এসেছিলেন জেসিজি। প্রিয়তম স্বামীর সঙ্গে তার শেষ দেখা হয়নি! গভীর হতাশায় নিমজ্জিত স্ত্রী জেসিজি অবশেষে আবেগতাড়িত হয়ে নাম পরিচয়হীন পাঁচ কবরের একটিতে অশ্রুসিক্ত নয়নে হৃদয় নিংড়ানো আবেগ ঢেলে লিখে গেছেন এই উক্তি।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা শহর থেকে প্রায় ১৪ কি.মি. দূরে চা বাগান বেষ্টিত রাজঘাট ইউনিয়নের জেমস ফিনলে চা কোম্পানির মালিকানাধীন ডিনস্টন চা বাগানের ভেতরে অবস্থিত এই ঐতিহাসিক সিমেট্রি। সবুজে ঘেরা, সুনশান নিথর নীরব প্রকৃতির কোলে এই সিমেট্রিজুড়ে রয়েছে বৃটিশদের নানা স্মৃতিগাঁথা। ১৮৫৪ সালে ইংরেজরা সিলেটের মালনিছড়ায় প্রথম চা বাগান প্রতিষ্ঠার পর ১৮৮০ সালে শ্রীমঙ্গলে বৃটিশরা বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু করেন। চা উৎপাদনের জন্য সেসময় সুদূর গ্রেট বৃটেন থেকে এখানে টি প্ল্যান্টার্সদের আগমন শুরু হয়। তৎকালীন সময়ে যেসব বৃটিশ এবং তাদের স্ত্রী-পুত্র, স্বজন মারা যেতো তাদের ডিনস্টনের এই সিমেট্রিতে শায়িত করা হতো।
চির সবুজ পাহাড় ঘেরা চা বাগানের মাঝখানে অবস্থিত এই সিমেট্রিতে বৃটিশদের কবর রয়েছে ৪৬টি। এরপর প্রায় দেড় শতাধিক বছর ধরে জেমস ফিনলে চা কোম্পানি এই সিমেট্রি রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছে।
জেমস ফিনলে টি কোম্পানি সূত্রে জানা যায়, রবার্ট রয়বেইলি নামে এক বৃটিশ নাগরিককে এ সিমেট্রিতে সর্ব প্রথম সমাহিত করা হয়। ৩৮ বছর বয়সে ১৮৮৫ সালের ৩০ আগস্ট তিনি ডিনস্টন চা বাগানে মারা যান। ১৮৯৬ সালের জুন মাসে শিশু উইলিয়াম জন ও ডেভিড সহাবির মৃত্যু হলে তাদেরও এখানে সমাহিত করা হয়। ১৯১৮ সালের ১৮ মে জর্জ উইলিয়াম পিটারের সহধর্মিনী মেরি এলিজাবেথ পিটার মারা গেলে তাকে এখানে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। স্ত্রীর মৃত্যুর এক বছরের মধ্যে ১৯১৯ সালের ২ অক্টোবর জর্জ উইলিয়াম পিটারও পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। ডিনস্টন সিমেট্রির নীরবতায় পাষাণ কবরের একই আচ্ছাদনে স্ত্রীর কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।
১৮৯৬ সালের জুলাই মাসে জাহাজ যোগে নিজ দেশে যাওয়ার পথে মারা যান রাম সান্টার। ১৯০২ সালের এপ্রিলে পানিতে ডুবে মারা যান এফ ডাব্লিউ এলান। এ দু’জনের মরদেহ পাওয়া যায়নি। স্মৃতি রক্ষার্থে তাদের বন্ধুরা ডিনস্টন সিমেট্রিতে দুটি প্রতীকী কবর নির্মাণ করেন। ১৯১৯ সালের ২০ জানুয়ারি শ্রীমঙ্গলের দারাগাঁও চা বাগানে মারা যান অ্যাডওয়ার্ড ওয়ালেস। এদিন ছিল তার ২৫তম জন্মদিন। কলেরায় আক্রান্ত হয়ে ১৯৩৭ সালের শুরুর দিকে হান্ট নামের একজন বৃটিশ নাগরিক তিনিও এই সিমেট্রিতে শায়িত আছেন। ১৯৩৯ সালের বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার একটি বিমান মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার শমসেরনগর বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন কিংবা অবতরণের সময় শ্রীমঙ্গলের উদনাছড়া চা বাগানে বিধ্বস্ত হয়। এ দুর্ঘটনায় নিহত বিমানের দু’জন বৃটিশ চালকের মরদেহ ডিনস্টন সিমেট্রিতে সমাহিত করা হয়। পরে আমেরিকার সামরিক বাহিনী দু’বিমান চালকের মরদেহ কবর থেকে উঠিয়ে নিজ দেশে নিয়ে যায়।
১৯৩৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর ৩৫ বছর বয়সি গিলবার্ড হেনরিটেটের ছেলে পিটারটেট পিতার সমাধি দেখতে শ্রীমঙ্গল এসেছিলেন। গিলবার্ট হেনরির স্ত্রীর অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী তার মৃত্যুর পর মরদেহের ভষ্ম প্রিয়তম স্বামীর পদ প্রান্তে অশ্রু সজল নয়নে রেখে গেছেন পুত্র পিটারটেট। চারিদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মণ্ডিত পাহাড়ঘেরা চিরসবুজ চা বাগানের মাঝখানে কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে দেড়শ বর্ষের স্মৃতিবিজড়িত শ্রীমঙ্গলের এই ডিনস্টন সিমেট্রি। শ্রীমঙ্গলে ঘুরতে আসা পর্যটকদের পরিদর্শনের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছে এই সিমেট্রি।
Development by: webnewsdesign.com