দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ১২ ভাগ অর্থাৎ প্রায় দেড় কোটি পুরুষ-মহিলা নিজের অজান্তে থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক। আমাদের দেশে প্রতিবছর হাজার হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মায়। একমাত্র সচেতনতাই পারে এই রোগকে প্রতিরোধ করতে। জানাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল
প্রত্যেক মা-বাবাই চান তাঁদের সন্তান সুস্থ ও সুন্দরভাবে জন্মলাভ করুক।
কিন্তু কারো কারো এ স্বপ্ন ভেঙে যায় জানা-অজানা নানা কারণে। থ্যালাসেমিয়া তেমনি একটি জন্মগত রক্তরোগ, যাতে মা-বাবার স্বপ্ন ভেঙে যায়। যেসব সমাজে আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বিয়েশাদি বেশি প্রচলিত, সেসব সমাজে থ্যালাসেমিয়ার মতো বংশগত রোগবালাই বেশি।
মা-বাবা এ রোগের বাহক হলে তাঁদের সন্তান থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মাতে পারে। যারা থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক তাদের কোনো উপসর্গ নেই। এরা স্বাভাবিক জীবন যাপন করে। এমনকি জন্মের পরপরই এ রোগটি ধরা পড়ে না। শিশুর বয়স এক বছরের বেশি হলে মা-বাবা লক্ষ করেন শিশুটি ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে, বাড়ছে শিশুর দুর্বলতা।
আর তখনই শিশু বিশেষজ্ঞ রক্ত পরীক্ষা করে শিশুটিকে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশু হিসেবে চিহ্নিত করেন। মা-বাবা জানতে পারেন যে তাঁরা দুজনেই থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক। আমাদের দেশে থ্যালাসেমিয়া এখন এক নীরব মহামারি, যাতে প্রতিবছর হাজার হাজার শিশুর মৃত্যু হচ্ছে।
রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের বাঁচিয়ে রাখতে বিশাল রক্তের ভাণ্ডার প্রয়োজন হচ্ছে। আনুষঙ্গিক খরচ বহন করতে গিয়ে আর্থিক দৈন্য ও মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন লাখো মা-বাবা।
থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুর কী সমস্যা হয়?
থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের শরীরে রক্তের মূল্যবান উপাদান হিমোগ্লোবিন ঠিকমতো তৈরি হয় না। শিশুর বয়স এক বা দুই বছর হলে শিশুর রক্তশূন্যতা দেখা দেয় এবং ফ্যাকাসে হয়ে পড়ে। শিশুর স্বাভাবিক দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে শরীরের দরকারি অঙ্গ, যেমন—প্লিহা, যকৃৎ বড় হয়ে যায় এবং কার্যক্ষমতা হারাতে থাকে। মুখমণ্ডলের হাড়ের অস্থিমজ্জা বিকৃত হওয়ার কারণে শিশুর চেহারা বিশেষ রূপ ধারণ করে, যা দেখে চিকিৎসক সহজেই থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুকে চিহ্নিত করতে পারেন। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের অন্যের রক্ত নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন থ্যালাসেমিয়া রোগের একমাত্র চিকিৎসা, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও সব সময় সফল নয়।
থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক কি না তা কিভাবে জানা যায়?
থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহকদের কোনো লক্ষণ থাকে না। তারা স্বাভাবিক জীবন যাপন করে। তাদের শরীরে রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা সামান্য কম থাকে। তাদের সাধারণত রক্ত গ্রহণ করতে হয় না। তবে একজন থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক নারী গর্ভবতী হলে রক্তের হিমোগ্লোবিন বেশি কমে যেতে পারে, যে কারণে কারো কারো গর্ভাবস্থায় দু-এক ব্যাগ রক্ত গ্রহণের প্রয়োজন হতে পারে। যেকোনো মানুষের রক্তের সিবিসি পরীক্ষা করে সন্দেহ করা যায় যে সে থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক কি না। এই পরীক্ষায় সন্দেহ হলে ‘হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস’ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় সে ব্যক্তি থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক কি না।
স্বামী-স্ত্রী দুজনেই থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হলে?
স্বামী ও স্ত্রী দুজনই যদি থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হন, তবে শতকরা ২৫ ভাগ ক্ষেত্রে তাঁদের সন্তান থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে শতকরা ৫০ ভাগ বাহক হিসেবে এবং ২৫ ভাগ সুস্থ শিশু হিসেবে জন্ম নিতে পারে। তাই সন্তান গ্রহণের ক্ষেত্রে মাতৃগর্ভে বাচ্চার ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া রোগ নির্ণয় তাঁদের একমাত্র ভরসা।
কিভাবে এই পরীক্ষা করা হয়?
দুইভাবে এই পরীক্ষা করা হয়। একটি ‘অ্যামনিওসেনটেসিস’ আরেকটি ‘করিওনিক ভিলাস স্যাম্পলিং’।
অ্যামনিওসেনটেসিস : মায়ের গর্ভে বাচ্চা একটা ব্যাগভর্তি তরল পদার্থের মধ্যে অবস্থান করে। এই তরল পদার্থকে ‘অ্যামনিওটিক ফ্লুইড’ বলা হয়। প্রথমে আলট্রাসনো মেশিনের সাহায্যে জরায়ুর ভেতরে বাচ্চা ও গর্ভফুলের অবস্থান নির্ণয় করা হয়। আলট্রাসনো মেশিনের চলমান ছবি দেখে অত্যন্ত সূক্ষ্ম একটি সুই বা নিডল মায়ের পেটের ওপর দিয়ে বাচ্চার চারপাশের তরল পদার্থের ব্যাগের ভেতরে প্রবেশ করানো হয়। এবার সিরিঞ্জের সাহায্যে ১৫ থেকে ২০ মিলি তরল পদার্থ টেনে আনা হয়।
করিওনিক ভিলাস স্যাম্পলিং : মায়ের গর্ভে বাচ্চা গর্ভফুলের মাধ্যমে মায়ের শরীর থেকে দরকারি পুষ্টি পেয়ে থাকে। আলট্রাসনো মেশিনের চলমান ছবি দেখে সুই বা নিডলের মাধ্যমে গর্ভফুল থেকে সামান্য কিছু কোষকলা নিয়ে আসা হয়। এই পদ্ধতিকে করিওনিক ভিলাস স্যাম্পলিং বলে। এই দুই পদ্ধতির মাধ্যমে সংগ্রহ করা তরল পদার্থ বা গর্ভফুলের কোষকলা ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয় ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে গর্ভের বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া রোগ আছে কি না তা নির্ণয়ের জন্য।
কখন এই পরীক্ষা করা হয়?
মায়ের গর্ভে বাচ্চার বয়স যখন ১১ থেকে ১৪ সপ্তাহ তখন করিওনিক ভিলাস স্যাম্পলিং এবং ১৫ থেকে ১৮ সপ্তাহ তখন অ্যামনিওসেনটেসিস পরীক্ষা করা হয়। এ সময় বাচ্চার আকার থাকে দেড়-দুই ইঞ্চির মতো। আলট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষা করে গর্ভে বাচ্চা ও গর্ভফুলের অবস্থান, বাচ্চার বয়স, জরায়ুর গঠন ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে চিকিৎসক নির্ধারণ করবেন কখন এবং কোন পরীক্ষাটি গর্ভবতী মায়ের জন্য প্রযোজ্য।
এসব পরীক্ষায় খুব সামান্য ব্যথা লাগে। একটা ইনজেকশন বা টিকা নিতে যেমন ব্যথা লাগে তেমনই। তা ছাড়া সুই ঢোকানোর জায়গাটি অনেক সময় অবশ করে নেওয়া হয়, যাতে ব্যথা কম লাগে।
এসব পরীক্ষায় কোনো ঝুঁকি আছে কি?
এ পরীক্ষাগুলো করার কারণে ১০০ থেকে ২০০ জনের মধ্যে একজনের বাচ্চা নষ্ট হতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে এটি সম্পূর্ণ নির্ভর করে যিনি এই পরীক্ষাটি করবেন সেই চিকিৎসকের দক্ষতার ওপর। খুবই বিরল ক্ষেত্রে যথেষ্ট নমুনা সংগ্রহ না হওয়ার কারণে পরীক্ষাটি আবার করার প্রয়োজন হতে পারে।
পরীক্ষার পর সাবধানতা কী কী?
পরীক্ষাটি সম্পন্ন করতে ১০ থেকে ১৫ মিনিট সময় লাগে। পরীক্ষার পর ৩০ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে বাসায় যাওয়া যায়। কিছু অ্যান্টিবায়োটিক ও প্যারাসিটামল জাতীয় ব্যথানাশক খেতে হয়। বাসায় গিয়ে দুই-তিন দিন ভারী কাজ ও দূরের ভ্রমণ থেকে বিরত থাকতে হয়। মাসিকের রাস্তায় কোনো প্রকার পানিজাতীয় স্রাব বা রক্ত গেলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসককে জানাতে হয়।
এসব পরীক্ষা কতটা নির্ভরযোগ্য?
এই পরীক্ষার রিপোর্ট প্রায় শতভাগ নির্ভরযোগ্য। তবে মনে রাখতে হবে, যে রোগের কারণে পরীক্ষাটি করানো হচ্ছে অর্থাৎ থ্যালাসেমিয়া নির্ণয়ের জন্য করা হলে কেবল বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া রোগ আছে কি না তা বোঝা যাবে, অন্য রোগ নয়। ভিন্ন ভিন্ন রোগের জন্য পরীক্ষাও ভিন্ন।
রিপোর্ট বা ফলাফল খারাপ হলে কী করণীয়?
সাধারণত এক সপ্তাহের ভেতর পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া যায়। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। পরীক্ষার রিপোর্টে বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া রোগ ধরা পড়লে গর্ভবতী মাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি গর্ভাবস্থা চালিয়ে যাবেন কি না। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত সন্তান সংসারে আনতে না চাইলে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। পরবর্তী সময় করণীয় সম্পর্কে চিকিৎসক মায়ের জন্য মঙ্গলজনক পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করবেন।
প্রতিরোধের উপায়:
একটু সচেতন হলেই আমরা এ রোগ প্রতিরোধ করতে পারি। বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রী বা বাচ্চা নেওয়ার আগে স্বামী-স্ত্রী থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক কি না তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশে, যেমন—সাইপ্রাস ১৯৭৩ সালে, বাহরাইন ১৯৮৫, ইরান ২০০৪, সৌদি আরব ২০০৪ এবং সর্বশেষ পাকিস্তান ২০১৩ সালে বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীর বা বাচ্চা নেওয়ার আগে স্বামী-স্ত্রীর থ্যালাসেমিয়া আছে কি না তা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করে থ্যালাসেমিয়া রোগকে নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। যে কেউ থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হতে পারে। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে সহজেই জানা যায় কেউ থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না। বাবা ও মা দুজনেই থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হলেই কেবল সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। একজন বাহক এবং অপরজন সুস্থ এমন দুজনের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হলে সন্তানদের কোনো সমস্যা হবে না।
Development by: webnewsdesign.com