আজ সোমবার বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস ২০২২। আফ্রিকায় ২০০১ সালের ২৫ এপ্রিল প্রথম ম্যালেরিয়া দিবস পালন করা হয়। এরপর ২০০৭ সালে ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলির ৬০তম অধিবেশনে বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবসের প্রস্তাবনা করা হয়। এর পর থেকে প্রতি বছর ২৫ এপ্রিল দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হবে।
উইকিপিডিয়ায় প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী ম্যালেরিয়া শব্দের অর্থ দূষিত বাতাস। ম্যালেরিয়া হলো মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর একটি মশাবাহিত সংক্রামক রোগ, যার মূলে রয়েছে প্লাজমোডিয়াম গোত্রের প্রোটিস্টা (একধরনের অণুজীব)। ম্যালেরিয়া শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন (১৭৫৩)। ইতালীয় শব্দ দূষিত বায়ু থেকে ম্যালেরিয়া শব্দটি এসেছে। তখন মানুষ মনে করত, দূষিত বায়ু সেবনে এ রোগ হয়।
১৮৮০ সাল নাগাদ চার্লস ল্যাভেরন লোহিত রক্তকণিকা থেকে ম্যালেরিয়ার কারণ হিসেবে একটিমাত্র কোষবিশিষ্ট পরজীবী প্রোটোজোয়াকে চিহ্নিত করেন। ফলে শত বছর ধরে চলা দূষিত বায়ু সেবনের ফলে রোগ সৃষ্টির ভুল ধারণার অবসান ঘটে। ১৮৯৭ সালে ভারতে কর্মরত ব্রিটিশ ডাক্তার স্যার রোনাল্ড রস প্রমাণ করেন যে(অ্যানোফিলিস) মশা এই রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে। এ যুগান্তকারী আবিষ্কারের কারণে তাকে ১৯০২ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।
এটি একটি সংক্রমিত স্ত্রী মশার (অ্যানোফিলিস মশা) কামড়ের সঙ্গে শুরু হয়, যা তার লালার মাধ্যমে প্রোটিস্টর সংবহন তন্ত্রের মধ্যে প্রবেশ করে এবং শেষে যকৃতে পৌঁছায়, যেখানে তারা পরিপক্ব হয় এবং বংশ বৃদ্ধি করে। ম্যালেরিয়ার সাধারণ রোগের লক্ষণসমূহ হলো জ্বর ও মাথাব্যথা, যা খুব গুরুতর ক্ষেত্রে কোমা বা মৃতু্যর কারণ হতে পারে।
এসব মৃতু্যর ৯৫ শতাংশই ঘটে সাব-সাহারা আফ্রিকায়। তাদের মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুর সংখ্যা ২ লাখ ৬০ হাজারের বেশি। ২০১৬ সালে বিশ্ব জুড়ে প্রায় ৫ লাখ মানুষ ম্যালেরিয়ায় প্রাণ হারিয়েছে। মশাবাহিত এই রোগটির প্রাদুর্ভাব ১০ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায় মে থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত।
আর বাংলাদেশে ১ কোটি ৭৫ লাখ ২০ হাজার মানুষ ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ১৩ জেলায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেশি। প্রতি বছর এ রোগে অসুস্হতা এবং মৃতু্যর প্রায় ৯৮ শতাংশ এই ১৩ জেলায় হয়ে থাকে। জেলাগুলো হলো- রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, শেরপুর ও কুড়িগ্রাম। এক্ষেত্রে ম্যালেরিয়ার উচ্চপ্রবণ এলাকা পার্বত্য অঞ্চলের রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলা। মধ্যপ্রবণ কক্সবাজার এবং বাকি নয়টি জেলা নিম্নপ্রবণ।
তাছাড়া ম্যালেরিয়াপ্রবণ উপজেলা রয়েছে ৭১টি। ২০১৭ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে বিশ্বে ৯১টি ম্যালেরিয়াপ্রবণ দেশ রয়েছে। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত সর্বমোট রোগীর সংখ্যা ২১৬ মিলিয়ন। তবে ২০১০ সালের তুলনায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কমেছে ১৮ শতাংশ। এই সময়ে বিশ্বে ম্যালেরিয়াজনিত মৃতু্যর সংখ্যা ৪ লাখ ৪৫ হাজার।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১ দশমিক ৪ মিলিয়ন, ঝুঁকিতে ১ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন এবং ম্যালেরিয়াজনিত মৃতু্যসংখ্যা ৫৫৭ জন। একই সময়ে বাংলাদেশে মোট আক্রান্ত হয়েছিল ২৯ হাজার ২৪৭ জন। এর মধ্যে উচ্চপ্রবণ এলাকায় ছিল ৯৩ শতাংশ। মৃতু্যবরণ করেছে ১৩ জন। আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবমতে ২০১৮ সালে এ পর্যন্ত ৪৫৬ জন আক্রান্ত হয়ে ছয় জন মৃতু্যবরণ করেছে।
এদিকে ২০৩০ সালের মধ্যে ম্যালেরিয়ামুক্ত বাংলাদেশের ভিশন নিয়ে কাজ করছে ‘জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচি’। এর মধ্যে রয়েছে ২০২১ সালের মধ্যে ১৩টি ম্যালেরিয়াপ্রবণ জেলার মধ্যে আটটি জেলায় ম্যালেরিয়া সংক্রমণ রোধ করা।
জেলাগুলোর প্রতি হাজারে বার্ষিক সংক্রমণের হার ১ দশমিক ৫৮ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৪৬-এর নিচে নামিয়ে আনা। একই সময়ের মধ্যে অবশিষ্ট ৫১টি জেলাকে ম্যালেরিয়ামুক্ত করা। ম্যালেরিয়ামুক্ত জেলাসমূহে ম্যালেরিয়া পুনঃসংক্রমণ প্রতিরোধ এবং দেশে প্লাজমোডিয়াম ফ্যালসিপেরামের (মারাত্মক ম্যালেরিয়ার জীবাণু) আবির্ভাব প্রতিহত করা।
কীভাবে ছড়ায় ম্যালেরিয়া:
দুই প্রজাতির মশার মধ্যে স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশার কামড়ে দেহে প্রবেশ করে স্যালাইভা। তারপর প্রোটিস্ট নামক অণুজীবের মাধ্যমে রক্তে ছড়িয়ে পড়ে পরজীবী। এর ফলে দেখা দেয় ম্যালেরিয়া। সাধারণত ফলমূলের রস মশার খাবার হলেও গর্ভকালে পুষ্টির জন্য দরকার হয় রক্তের। এক্ষেত্রে অ্যানোফিলিসের প্রথম পছন্দ মানবদেহ। মশার কামড়ে এই রোগটি হয় এবং জ্বর এ রোগের প্রধান লক্ষণ। তাই ম্যালেরিয়া জ্বর নামেই প্রচলিত রোগটি।
ম্যালেরিয়া হওয়ার কারণ:
ম্যালেরিয়া হচ্ছে মশাবাহিত প্লাজমোডিয়াম পরজীবী দ্বারা সৃষ্ট রোগ। এটি কেবল সংক্রমিত স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশার কামড়ে হয়। এ পর্যন্ত ৬০-এর অধিক প্রজাতির ম্যালেরিয়া পরজীবী আবিষ্কার করা সম্ভব হলেও এর মধ্যে চারটি প্রজাতি মানুষের ম্যালেরিয়ার জন্য দায়ী। প্লাজমোডিয়াম ভাইভাক্স, ফ্যালসিপ্যারাম, ম্যালেরি ও ওভাল-এর যে কোনো একটি জীবাণু বহনকারী মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া হতে পারে। এর মধ্যে ফ্যালসিপ্যারাম ম্যালেরিয়ার সবচেয়ে মারাত্মক; যা মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে। সংক্রমিত মশা যখন কোনো ব্যক্তিকে কামড়ায়; তখন ঐ ব্যক্তির রক্তে ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্রবেশ করে এবং সে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়।
কেন এই রোগটি মারাত্মক:
মশার দ্বারা সংক্রমিত ম্যালেরিয়া রোগটি কীভাবে প্রাণঘাতী রোগ হয়ে উঠল, এ বিষয়ের অজানা তথ্য উঠে এসেছে রোগটির ওপর জেনেটিক গবেষণায়। ক্যামব্রিজের ওয়েলকাম স্যাংগার ইনস্টিটিউটের গবেষকদের নেতৃত্বে এক গবেষণায় জানা যায়, এ পরজীবীটির বংশতালিকা অনুযায়ী সাত ধরনের ম্যালেরিয়ার বিষয়ে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সেখানে তারা দেখতে পেয়েছেন, প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে এই জীবাণুটি রূপান্তরিত হয়ে রোগের নতুন একটি শাখায় রূপান্তরিত হয় ,যা মানবজাতির জন্য মারাত্মক সংক্রমণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে ম্যালেরিয়া থেকে আরোগ্য লাভ করা সম্ভব। ম্যালেরিয়া রোগে অধিকাংশ মৃত্যুর কারণ হলো সময়মতো রোগ শনাক্ত না হওয়া এবং চিকিৎসায় বিলম্ব। সেজন্য জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। রোগের লক্ষণ দেখা দিলে, জটিলতা সৃষ্টির আগেই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
Development by: webnewsdesign.com