ইসলামের নিয়ম অনুসারে রোজায় মানুষকে দীর্ঘ ১০ থেকে ১৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অভুক্ত থাকতে হয়। এই দীর্ঘ সময় অভুক্ত থাকার ফলে মানবদেহে কিছু ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া হয়। রোজায় কীভাবে নিজের স্বাস্থ্যকে সুরক্ষিত রাখবেন সে বিষয়ে আলোচনা করা হলো।
স্বাস্থ্যসম্মত হতে হবে ইফতার, ভূরিভোজ করা যাবে না। খাওয়াকে উপভোগ করতে হবে। ইফতারিতে প্রয়োজনীয় সবজি, ফল, মাছ/মাংস, দুধ/দুগ্ধজাত দ্রব্য থাকা বাঞ্ছনীয়। ধীরে সুস্থে মুখের খাবার চিবুতে হবে, শেষ করতে হবে। বেশি লবণ, বেশি সুগার, বেশি ভাজি খাওয়া যাবে না। বেশি ভাজা মানে বেশি তেল, তাই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। খেজুর ভালো খাবার। এতে আছে ফাইবার, আছে ধর্মীয় অনুভূতি। দুই রকম সবজি, দুই রকম ফল খেলে মিলবে ভিটামিন মিনারেল।
ডাব, তরমুজ, শসায় থাকবে পানি যেটা ডিহাইড্রেশন ঠেকাবে। আপেল নাশপাতি আখরোট ভালো। ভাত রুটি, নুডল্স, বুট ছোলা ভালো, কারণ ফাইবার বেশি পেট ভালো রাখে। পানি পান করতে হবে যথেষ্ট ডিহাইড্রেশন ঠেকানোর জন্য। একবার বেশি না নিয়ে বারবার রাতভর সেবনের অভ্যাস করতে হবে। গরমের রোজায় ২.৫ থেকে তিন লিটার পানি লাগবে যা রাতভর পান করা বাঞ্ছনীয়।
কী খাবেন সেহরিতে
সেহরিতে এমন খাবার খেতে হবে যেটা সারা দিন আপনাকে ধরে রাখবে। ক্ষুধা লাগবে না বা খাবার তাগাদা আসবে না। ভাজি বা গ্রিল খাবেন না। কারণ পিপাসা বাড়াবে। তালিকায় সবজি, শাক রাখতে হবে। থাকবে শসা টমেটো বা ফ্রুট সালাদ। এগুলো জোগাবে শক্তি, সতেজতায় ভিটামিন মিনারেলস। আপেল, কমলার ফ্রুট সালাদের সঙ্গে বাদাম বা দই/দুধ শুধু স্বাদই বাড়াবে না, খাবারকে করবে উপাদেয় পুষ্টিপূর্ণ। ডিম ফালি করে সালাদে দেওয়া যায়, সবজি মিশিয়ে মোটা করে মামলেটও করা যায়; ডিম হলো প্রোটিনের আধার, ভিটামিন মিনারেলের ভাণ্ডার। মাছ/মুরগি দুটিই চলতে পারে তবে ভোজ নয়। দুধ অনেকভাবেই খাওয়া যায়, দই বা দুধ মিশিয়ে কিছু দিয়ে, দুধ কলা ভাত বা ওটস মিশিয়ে। সেহরি না খেয়ে রোজা রাখা ঠিক নয়। আবার পরবর্তী দিনটির হিসাব করে ভূরিভোজে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি। সেহরি খেয়ে অতিরিক্ত পানি পান করা ঠিক। তাহলে বমি হওয়ার আশঙ্কা বেশি। ২৪ ঘণ্টার বরাদ্দ ২.৫ থেকে ৩ লিটার পানি সারা রাতে কিছুক্ষণ পরপর পান করতে হবে। প্রতিদিন একটা ডিম, এক গ্লাস দুধ ও একটা মিষ্টি ফল রাতের মধ্যে খেতে হবে। খেজুর থেকে শুরু সব ফলই খাওয়া যেতে পারে রাতভর।
রোগ/রোগী রোজা
কোনো রোগেই রোজা নিষেধ নয়। রোজা রাখলে রোগ বাড়বে এটাও নয়। কোনো ডাক্তারই রোজা রাখতে না করবে না। ডাক্তার অসুখের তাৎপর্য আর ঝুঁকির কথা বলবেন/বোঝাবেন। ডায়ালাইসিস লাগে এমন কিডনি রোগী বা নিয়ম করে অনেকগুলো ওষুধ লাগে এমন অ্যাডভান্সড হার্টের রোগী রোজা বাদ দিতে পারে, তবুও সবক্ষেত্রেই রোগীর ইচ্ছাই বড়। কিছু কিছু রোগের ক্ষেত্রে রোজা রেখেই চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। সর্বক্ষেত্রেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া বাঞ্চনীয়। রোজা রেখে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি/জীবনের ঝুঁকি দেখা গেলে ইসলামের বিধান মেনে রোজা পরিহার করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই শ্রেয়।
রোজাদারের জন্য বিশেষ সতর্কতা
ইনসুলিন, সালফোনুরিয়া জাতীয় ওষুধে হাইপগ্লাইসেমিয়া হওয়ার ভয় থাকে; এখন বাজারে অনেক ভালো ওষুধ পাওয়া যায়, তাই সম্ভব হলে বিকল্প ওষুধ নিতে হবে। সন্ধ্যা বেলায় এক ডোজ নিয়ে চলে এমন ওষুধ নেওয়া যেতে পারে; নাহলে সন্ধ্যায় বেশি নিয়ে অর্ধেকাংশ শেষ রাতে নিতে হবে। সকাল দশটায় আঙ্গুলের মাথা থেকে রক্ত পরীক্ষা করতে হবে-১০(২০০)র বেশি থাকলে শেষ রাতের ডোজ বাড়াতে হবে। যে ওষুধই চলুক খারাপ লাগলে রক্ত পরীক্ষা করলে চার (৭০ মিগ্রাম) কম হলে রোজা ভাঙতে হবে। ১৬(৩০০ মিগ্রাম)র বেশি হলে রোজা না রাখার পরামর্শ থাকবে। গ্লিফলোজেন ওষুধ চললে ডিহাইড্রেশন ঠেকানোর জন্য পানি বেশি পান করা জরুরি। বমি হওয়ার ভয় থাকলে ৮০০ মি. গ্রামের বদলে ৫০০ মি. গ্রামের ছোট ট্যাবলেট খেতে হবে। ডায়াবেটিস রোগীর খাবার অন্যসময়ের মতোই ক্যালরি ঠিক রেখে আগের অভ্যাস মতো নাশতাটা সন্ধ্যায়, মধ্যাহ্ন ভোজ তারাবির পর রাতের খাবারটা শেষ রাতে খেতে হবে।
ব্যায়াম ও রোজা
ব্যায়াম, শরীর চর্চা সুস্থ জীবনের নিশ্চয়তা দেয়। সেজন্য এটা অপরিহার্য, সে রোজাদার বা আহারি যেই হোক। তিনটি জিনিস মনে রাখতে হবে-হয়রান হয়ে যেতে হয় এমন কিছু করা যাবে না, ডিহাইড্রেশন পরিহার করতে হবে আর ডায়াবেটিক হলে হাইপগ্লাইসেমিয়া না হয় সেটি খেয়ালে নিতে হবে। ব্যায়াম মন শরীর দুটিই সতেজ রাখে বডি মাংসপেশিকে শক্ত করে। ব্যায়ামে কিছু হরমোন নিঃসৃত হয় বিশেষ করে যারা নিয়মিত ব্যায়ামে অভ্যস্ত তাদের জন্য নিয়মের ব্যত্যয় হলে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। রোজার সময় কায়িক শ্রম কমানোই ভালো। দিনের কাজ রাতে শিফট করতে পারলে আরও ভালো; ব্যায়ামের সময় কমানো যেতে পারে। দিনে ৪৫ মিনিট না করে ত্রিশ মিনিটে আবদ্ধ না থেকে পর্যায়ক্রমে ১০, ২০, ২৫, ৩০ মিনিট ব্যায়াম করা যেতে পারে। ব্যায়ামের জন্য ইফতারের আগে বা সেহরির আগে এমন সময় বেছে নেওয়া যেতে পারে। তারাবির পরও হতে পারে। ইফতারির দুঘণ্টা পর করা ভালো তবে এক ঘণ্টার মধ্যে ব্যায়াম করা ঠিক নয়।
লেখক : মেডিসিন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ, বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
Development by: webnewsdesign.com