দেশে যুগ যুগ ধরে বাঙালির রসনায় খেজুর গুড়ের প্রাধান্য পেয়ে আসছে। শীতের মৌসুমে নানান রকমের পিঠা-পুলি তৈরিতে রাজশাহীর খেজুর গুড়ের জুড়ি নেই। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও তীব্র শীত উপেক্ষা করে রাজশাহীর হাট গুলোতে জমে উঠেছে জমজমাট খেজুর গুড়ের ব্যবসা। প্রশাসনের সঠিক নজরদারির ফলে এ বছর উৎপাদন ও বিক্রি বেড়েছে ভেজালমুক্ত খেজুর গুড়ের।
রাজশাহীতে খেজুর গুড় তৈরিতে এ অঞ্চলের পুরুষদের সঙ্গে নারীদেরও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূুমিকা। পুরুষরা গাছ থেকে রস সংগ্রহ করার পরে চুলায় জ্বাল দেওয়া থেকে গুড় প্রস্তুত করে নারীরা। এখন দেশের চাহিদা মিটিয়ে খেজুর গুড় যাচ্ছে দেশের বাইরেও। মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ-আমেরিকাসহ অনেক দেশ থেকে আসছে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা।
সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছে, এ বছর মোট ৯৬ কোটি টাকার ব্যবসা হবে খেজুর গুড়ের। এদিকে রাজশাহী ও নাটোরসহ আশেপাশের জেলায় শীত মৌসুমে কয়েক শতকোটি টাকার খেজুর গুড় উৎপাদন ও বাণিজ্য হয়। এতে কর্মসংস্থান হচ্ছে হাজার হাজার পরিবারের। যার মধ্যে রাজশাহীতে ৬ হাজার পরিবার এর সাথে সরাসরি যুক্ত। আর নতুন ভাবে তরুণরাও এই ব্যবসায় যুক্ত হয়ে নিজেদের ভাগের পরিবর্তন ঘটাচ্ছে।
স্থানীয় গুড় ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এখন দেশের সবচেয়ে বেশি গুড় তৈরি হয় রাজশাহীও নাটোর জেলাতে। এ ছাড়াও নওগাঁ, পাবনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় কিছু গুড় উৎপাদন হচ্ছে। এর পরে যশোর, মাদারীপুর ও ফরিদপুর এলাকায় গুড় উৎপাদন হয়। রাজশাহীর বাঘা, চারঘাট, পুঠিয়া, দুর্গাপুরসহ নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া ও লালপুর উপজেলায় রয়েছে লক্ষ লক্ষ খেজুর গাছ। শীতের মৌসুমে এলেই হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস শুরু হয়।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র হতে জানান যায়, শুধু রাজশাহী জেলাতেই খেজুর গাছ রয়েছে ১২ লাখ এক হাজার ৭৭৫ টি। এই গাছ থেকে মৌসুমে প্রায় ৯৬ কোটি টাকার গুড় উৎপাদন হচ্ছে। রাজশাহী জেলার সবচেয়ে বেশি গাছ রয়েছে তিনটি উপজেলায়। যার মধ্যে চারঘাট উপজেলায় খেজুরগাছের সংখ্যা এক লাখ ৮৪ হাজার ২৭৫ টি। বাঘা উপজেলায় খেজুরগাছ রয়েছে এক লাখ ৫৫ হজাার ৯২৫ টি। আর পুঠিয়া উপজেলায় খেজুরগাছ রয়েছে ৫ লাখ ৮৭ হাজার ৪৫২ টি। অন্যান্য উপজেলায়ও আরো গাছ আছে। এ ছাড়া নাটোর সদর, বাগাতিপাড়া ও লালপুর উপজেলাতেও কয়েক লক্ষ গাছ রয়েছে। এসব গাছ থেকে উৎপাদিত গুড়ের সবচেয়ে বড় বাজার বসে পুঠিয়া উপজেলার ঝলমলিয়া ও বানেশ্বর হাটে।
বানেশ্বর ও ঝলমলিয়ার ব্যবসায়ীদের হিসাব অনুযায়ী,শুধু বানেশ্বর হাটেই সপ্তাহে দুইদিন হাটে ২২৫ লক্ষ টাকার খেজুর গুড় বিক্রি হয়। বানেশ্বরের হাটে দুইদিন প্রতি সপ্তাহে ১৫ থেকে ১৮ টি ট্রাকে গুড় লোড হয়ে ঢাকাসহ সারা দেশে যায়।
বানেশ্বর হাটের পাইকারি গুড়ের আড়ত কাজীর হাট ট্রেডার্সের মালিক সাইফুল ইসলাম বলেন,‘সপ্তাহের দুই দিন মঙ্গলবার ও শনিবার বানেশ্বর হাট বসে। ২২৫ লক্ষ টাকার গুড় বেচাকেনা হয়। এই গুড় ঢাকা, সিলেট, চট্রোগ্রম, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, চাঁপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। এর পর ঢাকা থেকে দেশের বাইরে পাঠানো হয়’।
ঢাকার পাইকারী ব্যাপারী শংকর বাবু জানান,‘ঝলমলিয়া ও বানেশ্বরে হাটে সবচেয়ে বেশি গুড় আসে। এই খেজুর গুড় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছে। এই গুড় দেশের চাহিদা মিটিয়ে আমেরিকা, কানাডা, লন্ডন, সৌদি আরবসহ ইিেউরাপের দেশেও যাচ্ছে বলে জানান তিনি’।
পুঠিয়া উপজেলার নয়াপাড়া গ্রামের গাছি শাহাজাহান আলী বলেন, আমার ‘একশত’ খেজুর গাছ রয়েছে। প্রতিদিন প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ কেজি খেজুর গুড় উৎপাদন হয়। প্রতি সপ্তাহে এলাকায় চারদিন হাট বসে। সেই হাট গুলোতেই গুড় বিক্রি করি। তিনি আরো বলেন, খুব ভোরে গাছ গুলো থেকে রস সংগ্রহ করতে হয়। গাছ থেকে রস আনার পর রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করে বাড়ির মেয়েরা’।
নয়াপাড়া এলাকার আরেক গাছি শফিকুল ইসলাম জানান,‘শীতের মৌসুমে গুড় তৈরি করেই আমাদের পরিবারের অর্থনৈতিক আয় হয়। যা দিয়ে জমির ফসল উৎপাদন বাসার বাজার-সদাই ও শশ্যর জন্য সার কীটনাষক কিনতে হয়। ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগার হয়’। তিনি জানান,‘শীতের সময় ছয় মাস গুড় থাকলে সংসার চালানোর আর চিন্তা থাকে না। এ বছর ১০০ টাকার উপরে খেজুর গুড় বিক্রি করেছি। প্রথমে দাম ভালো ছিলো। কিন্তু এখন দাম কিছুটা কমতে শুরু করেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, রাজশাহীতে খেজুর গুড় উৎপাদনের সঙ্গে প্রায় ৩০ হাজারে বেশি মানুষ সম্পৃক্ত। এ বছর রাজশাহীতে ৯৬ কোটি টাকার খেজুর গুড়ের বাণিজ্য হবে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মোজদার হোসেন বলেন,‘রাজশাহী জেলায় এ বছর প্রায় ৫০০- ৯৩ দশমিক ৪৭ হেক্টোর জমিতে গাছের সংখ্যা রয়েছে ১২ লাখ এক হাজার ৭৭৫ টি। গাছ প্রতি রস উৎপাদন ৮০ কেজি আর গুড় হবে ৮ কেজি করে। যার বাজার দাম ১০০ টাকা কেজি। মোট গুড় উৎপাদন হবে ৯ হাজার ৬০০ শত ১৪ দশমিক ২ মেট্রিকটন। গড়ে কেজিপ্রতি গুড়ের দাম ১০০ টাকা ধরলেও এ মৌসুমে ৯৬ কোটি টাকার গুড়ের বাণিজ্য হবে।
Development by: webnewsdesign.com