সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইনে খসড়া মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন এবং আইনটি পাস করার জন্য সংসদে উত্থাপনের পেছনে ভিন্ন কারণ দেখছে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। দীর্ঘদিন থেকে সুজন ইসি নিয়োগ আইন করার জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়ে আসছে। আইন প্রণয়নে তারা সরকারের কাছে একটি খসড়াও প্রদান করেছে। কিন্তু সেই খসড়া আমলে না নিয়ে সরকার তড়িঘড়ি করে একটি প্রশ্নবিদ্ধ খসড়া আইন সংসদে পাসের জন্য উত্থাপন করছে বলে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটি দাবি করেছে। সুজন- নেতৃবৃন্দের মতে, খসড়া আইনে নাগরিক সমাজের মতামতের প্রতিফলন ঘটেনি। আইনটিতে বেশকিছু ত্রুটি রয়েছে যেগুলো সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই আইনের মাধ্যমে যে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ হবে তা অতীতের দু’টি নির্বাচন কমিশনের মতো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন আয়োজন করবে। মূলত ক্ষমতাসীনরা যেনতেন নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতায় আসার জন্য নিজের পছন্দের লোক দিয়ে নির্বাচন কমিশন সাজাতে এই আইন পাস করছে বলে মনে করছেন তারা।
‘প্রস্তাবিত নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন: নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনটি ভার্চ্যুয়াল প্ল্যাটফরমে অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী অতিথি সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমার প্রশ্ন হচ্ছে এই আইনের ফলে সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদের ওপর কি কোনো প্রভাব ফেলবে? আমরা কমিশনে থাকাকালীন যে খসড়াটি প্রস্তাব করেছিলাম সেখানে বলা ছিল সুপারিশকৃত নামগুলো প্রথমে সংসদের বিশেষ কমিটিতে যাবে, সেখানে আলোচনা হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে। এই কমিটিতে সব দলের সমানুপাতিক অংশগ্রহণ থাকে। তাহলে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা কম থাকে। সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, বর্তমান সরকার কী ধরনের সার্চ করবে সেটা আগে থেকেই অনুমেয়। তারা সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীলদের খুঁজে পাবেন। দু’জন নাগরিককে রাষ্ট্রপতি মনোনয়ন দেবেন। রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতা হঠাৎ করে কীভাবে এলো তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তিনি আরও বলেন, কোন ১০ জনের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হচ্ছে আমরা জানবো না। হঠাৎ দেখা যাবে ৫ জনের নামে নির্বাচন কমিশন গঠন হবে।
ড. শাহদীন মালিক বলেন, সারাবিশ্বে কর্তৃত্ববাদী সরকারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা এমনভাবে নির্বাচনের খেলা করে যেন তারা জয়ী হয়। এর প্রথম ধাপ পছন্দের নির্বাচন কমিশন গঠন করা। এটা এই আইনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করছে। নির্বাচন নিয়ে যে খেলা হচ্ছে, আগামী নির্বাচনে সরকারি দল যেন জিতে সেটাই মনে হচ্ছে। তিনি সন্দেহ পোষণ করে বলেন, বর্তমান সরকার যেন জয়ী হয় সেটা নিশ্চিত করার জন্য এই আইন হচ্ছে। ছলচাতুরি করার জন্য এই আইন বেছে নিয়েছে। আমরা আইন করার জন্য দুই মাস আগে বলেছিলাম। সরকার বুঝালো, আমাদের দাবির প্রেক্ষিতে আইন করে দিলো। এটা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো লোক দেখানো আইন হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের উদ্দেশ্য ছিল নাগরিকদের ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে নিরাপত্তা দেয়া। উল্টো ওই আইন সরকার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। নির্বাচন কমিশন আইনকে ক্ষমতায় আসার অস্ত্র হিসেবে সরকার ব্যবহার করবে। সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠনের আইন গুরুত্বপূর্ণ। কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে না পারলেও বিতর্কিত নির্বাচন ঠেকাতে পারে। নির্বাচনে বিতর্কের সম্ভাবনা দেখা দিলে নির্বাচন স্থগিত করতে পারে, এমনকি তদন্ত সাপেক্ষে ফলাফলও বাতিল করতে পারে। সরকারের আইনে বলা হয়েছে কমিটি পেশাজীবী ও রাজনৈতিক দল থেকে আহ্বান করবে। নাম আহ্বান করাই কি অনুসন্ধান? আবার যে সব যোগ্যতা-অযোগ্যতা নির্ধারিত করা হয়েছে তার আলোকে হাজার হাজার ব্যক্তিকে বিবেচনায় রাখা সম্ভব, যে কাউকে নিয়োগ দিলেই হলো। কাদের নাম বিবেচনায় আছে আমরা কিছুই জানবো না। দুই মাস আগে আইনমন্ত্রীর কাছে আমাদের খসড়ার কপি গেলে উনি সময় নেই বললেন। এখন কারও সঙ্গে আলোচনা না করেই আইন পাসের জন্য তড়িঘড়ি করছেন। তাদের মতো করে নির্বাচন করার জন্যই আলোচনা না করে এই আইন করা হচ্ছে।
সুজন-এর কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য বিচারপতি মো. আবদুল মতিন বলেন, আইনটি যে গুড মোটিভ নিয়ে করা হচ্ছে এরকম কোনো নজির দেখছি না। রাখঢাক করে এই করার উদ্দেশ্য হচ্ছে আগের মতোই ইলেকশন করা।
পরিবেশ আইনবিদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, এই আইন পাস হলে সার্চ কমিটির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করার জন্যই আইন করতে হবে। সেটা না হলে এরকম আইন এখনই পরিত্যাজ্য। মানুষের ভোটের অধিকার হরণ হলে সংবিধানের ষোল আনাই মিছে হয়ে যায়। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য করাই সংবিধানের মূল স্পিরিট।
সুজন সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, বার বার শুনে আসছি আইন করার সময় নেই, এখন করা যাবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপেও রাষ্ট্রপতি বলেছেন সময় নেই। এরপর হঠাৎ কী পরিবর্তন হয়ে গেল! মন্ত্রিসভায় খসড়া অনুমোদন হয়ে গেল! এখন আদালতে যাওয়ার নাগরিক অধিকার থেকে আমাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ চালিয়ে যেতে হবে।
সুজন-এর পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার। এতে বলা হয়, সুজন প্রস্তাবিত কার্যাবলী সমপাদন সময়সাপেক্ষ; এজন্য খসড়ায় কমিটির কার্য সম্পাদনের জন্য ১-২ মাস সময় রাখা হয়েছে। কিন্তু সরকারের খসড়ায় সময় রাখা হয়েছে মাত্র দশ কার্যদিবস, এত স্বল্প সময়ে কমিটি কীভাবে অনুসন্ধান ও যাচাই প্রক্রিয়া সম্পাদন করবে তা আমাদের বোধগম্য নয়। সরকার প্রস্তাবিত খসড়াতে অনুসন্ধান কার্যক্রম রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনের কাছ থেকে নাম আহ্বানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। সুজন প্রস্তাবিত খসড়ায় যেখানে কমিশনের কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে প্রণয়নকৃত আইনের অধীনে গঠিত কমিশনের জ্যেষ্ঠতম কমিশনারকে পরবর্তী প্রধান কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়ার কথা বলা হয়েছে, সেখানে সরকারের খসড়ায় ইতিপূর্বে গঠিত অনুসন্ধান কমিটি ও তৎকর্তৃক সংঘটিত কার্যাবলী এবং সুপারিশে গঠিত কমিশনকে বৈধ বলে গণ্য করার এবং উক্ত বিষয়ে আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না বলে বিধান সংযুক্ত করা হয়েছে। পূর্বের দুটি কমিশন কর্তৃক মানুষের ভোটাধিকার হরণ ও নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার দায় থেকে মুক্তি দেয়ার জন্যই এ বিধান রাখা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় দায় না নেয়া ও দায় থেকে মুক্তি লাভের যে দৃষ্টান্ত রয়েছে এটি তারই ধারাবাহিকতা। রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক ও সুশাসনের ভিত্তির ওপর শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হলে কৃতকাজের জন্য জবাবদিহিতা ও শাস্তি ভোগ না করে দায়মুক্ত করে দেয়ার এই ধারা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়াকে যথাসম্ভব বিতর্কমুক্ত রাখা এবং স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া সমপন্ন করার জন্যই নাগরিক সমাজ দীর্ঘদিন ধরে কমিশনার নিয়োগের আইন প্রণয়নের দাবি করে আসছে, যাতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যায়। একটি আইন করে পুরনো প্রক্রিয়াকে নতুন মোড়ক দিলে সে উদ্দেশ্য তো পূরণ হবেই না, উল্টো আরও বিতর্কের সৃষ্টি করবে। তাই সরকারের প্রতি সব পক্ষের মতামত এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি যুগোপযোগী ও যথাযথ আইন প্রণয়ন করার আহ্বান জানাচ্ছি।
Development by: webnewsdesign.com