বস্ত্রখাতের উৎপাদনমুখী রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ‘সিলেট টেক্সটাইল মিলস’র বন্ধ তালা খোলা হয় না দীর্ঘ ১৩ বছর। কার্যক্রম বন্ধ থাকার ফলে প্রতি বছর বিশাল অংকের আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। পাশাপাশি সিলেটের অর্থনীতিতেও হচ্ছে বড় লোকসান।
তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকায় সিলেট টেক্সটাইল মিলের যন্ত্রপাতিতে মরিচা ধরতে শুরু করেছে। বিকল হয়ে পড়ছে মূল্যবান কিছু মেশিন। সম্প্রতি বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন (বিটিএমসি) পিপিপি (অর্ধেক প্রাইভেট পার্টনারশিপ) পদ্ধতিতে ঢাকার দুটি মিল চালুর উদ্যোগ নিলেও সিলেটেরটি নিয়ে নেই কোনো সিদ্ধান্ত।
জানা যায়, ১৯৭৮ সালে সিলেটে শিল্প সম্প্রসারণের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় সিলেট টেক্সটাইল মিল। ফরাসি, এডিবি ঋণ এবং বিশ্বব্যাংকের অর্থ সংস্থা আইডিএ’র অর্থায়নে ১৯৭৭ সালের ১৭ আগস্ট এ টেক্সটাইল মিলের জন্য ২৮ দশমিক ৮১ একর জমি ক্রয় করা হয়। পরের বছর তৎকালীন বাণিজ্য উপদেষ্টা এম সাইফুর রহমান এই মিলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে মিলটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। ১৯৮৩ সালের জুনে মিলটি পরীক্ষামূলক উৎপাদনে যায়। এরপর কয়েক বছর কারখানাটি লাভের মুখ দেখলেও অব্যবস্থাপনার কারণে ধীরে ধীরে লোকসান গুণতে থাকে।
অব্যাহত লোকসানের কারণে ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে মিলটি বন্ধ করে দেয়। এসময় শতাধিক শ্রমিককে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হলেও পুণরায় চালুর আশায় কর্মরত থেকে যান ৭৭৩ জন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবারো চালু হয় টেক্সটাইল মিলটি। কিন্তু ২০০১ সালে আবারো বন্ধ হয়ে যায় সিলেট টেক্সটাইল মিল। এরপর শ্রমিকদের বেতনও বকেয়া পড়তে থাকে। ২০০৩ সালের ৩০ জুন বকেয়া বেতন পরিশোধ না করেই অনেকটা জোর করে সাড়ে সাত শতাধিক শ্রমিককে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল কর্পোরেশন। পরে আন্দোলন করে বকেয়া বেতন আদায় করেন শ্রমিকরা। কিন্তু শ্রমিকদের কল্যাণ তহবিলের টাকা পরিশোধ করেনি বিটিএমসি।
এদিকে, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর মিলটি পুণরায় চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করে। এসময় তোড়জোড় করে মিলটি কয়েকদিন চালুও ছিলো। শ্রমিকদের দাবির মুখে তৎক্ষালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মিলটি পুরোদমে চালুর আশ্বাস দেন। এমনকি তিনি ও তৎকালীন শ্রমমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া পৃথকভাবে মিলটি পরিদর্শনও করেন। কিন্তু সেই উদ্যোগ আর আলোর মুখ দেখেনি। সেই থেকেই বন্ধ পড়ে আছে উৎপাদনমুখী রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠান।
এর ১০ বছর পর ২০১৮ সালের ২৯ নভেম্বর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে সিলেট টেক্সটাইল মিলসহ বন্ধ থাকা ১৬ টি কারখানা চালুর সিদ্ধান্ত হয়। এরপর বিটিএমসি’র প্রকৌশলীসহ উর্ধতন কর্মকর্তারা মিলটি পরিদর্শনে আসেন। তবে সেই উদ্যোগও বাস্তবায়ন হয়নি।
এর আগে ২০১২ সালে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রীসভার বৈঠকে মিলটি বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ সিদ্ধান্তের ফলে মিলটি বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিআইডিএ) অধীনে চলে যায়। এরপর ২০১৩ সালে মিলটি বিক্রির উদ্যোগ নেয় বিআইডিএ। ওই বছরের ৭ ডিসেম্বর সিলেট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ড্রাস্টিজ’র এক সভায় বেসরকারিকরণ কমিশনের সদস্য মোহাম্মদ গোলাম কুদ্দুস মিলটি বিক্রির কথা জানান। তখন ভূমি ও মিলের সম্পদের বাজারমূল্য ধরা হয় প্রায় ২৬৬ কোটি টাকা। কিন্তু ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় কারখানাটি বিক্রি করা হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এর আগে বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে মিলটি বিক্রির জন্য দুবার টেন্ডারও আহবান করা হয়। কিন্তু কাগজপত্রে ত্রুটির কারণে প্রথম দফা টেন্ডার বাতিল করা হয়। দ্বিতীয় দফায় মাত্র ১৫ কোটি টাকা দর উঠায় বিক্রির উদ্যোগ এগোয়নি।
সম্প্রতি ঢাকার দুটি টেক্সটাইল মিল অর্ধেক বেসরকারিকরণ করে ফের চালু করেছে। কিন্তু সিলেটের কারখানা নিয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
এ বিষয়ে সিলেট টেক্সটাইল মিলের হিসাবরক্ষক ও ইনচার্জ অনুকূল বিশ্বাস জানান, ২০০৮ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে সিলেট টেক্সটাইল মিল। সম্প্রতি বিটিএমসি অর্ধেক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) পদ্ধতিতে টঙ্গি ও ঢাকার দুটি টেক্সটাইল মিল চালু করেছে। তবে সিলেটেরটি নিয়ে কী সিদ্ধান্ত এখনও জানা যায়নি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কয়েকটিতে মরিচা ধরলেও যন্ত্রপাতি আছে আগের মতোই। সরকারের নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী সেগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
অনুকূল বিশ্বাস আরও জানান, বর্তমানে সিলেট টেক্সটাইল মিলে তিনিসহ ৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত। এর মধ্যে দুজন অন্যত্র দুটি কারখানায় কাজ করেন, তবে বেতন ইস্যু হয় এ মিল থেকে। বাকি ৪ জন কাজ করছেন ‘১৩ বছর ধরে বন্ধ’ কারখানায়।
Development by: webnewsdesign.com