সিলেটের পান আবার রপ্তানি হবে ব্রিটেনে  

বুধবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ২:২৭ অপরাহ্ণ

সিলেটের পান আবার রপ্তানি হবে ব্রিটেনে  
apps

সিলেট অঞ্চলে উৎপাদিত পান রপ্তানি হতো বৃটেনে। তবে বৃটেনের নিষেধাজ্ঞার কারণে দীর্ঘদিন ধরে সে দেশে পান রপ্তানি বন্ধ ছিলো। এতে ক্ষতির মুখে পড়েন এখানকার ব্যবসায়ীরা।

অবশেষে ব্রিটেন বাংলাদেশি পানের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে যাচ্ছে। ফলে পান খেয়ে মুখ লাল করবে সে দেশের বসবাসকারী এশিয়ানরাও।

দেশটির পান রপ্তানির ইস্যু দেখভলকারী সংস্থা ‘ইউকে- ফুড স্ট্যান্ডার্ড এজেন্সি’ (এফএসএ) এ বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। সব কিছু ঠিক থাকলে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই পানে বহাল নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার সুসংবাদ পেতে পারেন দেশের পান রপ্তানিকারকরা।

টানা ছয় বছর নিষিদ্ধ থাকার পর চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল বাংলাদেশে উৎপাদিত পান ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোতে রপ্তানির সুযোগ উন্মুক্ত হয়।

পানে ক্ষতিকর ‘সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া’ পাওয়ার পর ছয় বছর ইইউর নিষেধাজ্ঞায় পড়েছিল বাংলাদেশ। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়, যা ধাপে ধাপে ২০২০ পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

ইইউ তার বাজারে আবার পান রপ্তানির সুযোগ পেতে কমিশন কয়েকটি শর্ত প্রতিপালনের তাগিদ দেয়। শর্তগুলো ছিল-পান সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়ামুক্ত হতে হবে, উৎপাদন থেকে শিপমেন্ট পর্যন্ত উত্তম কৃষি চর্চা (গ্যাপ), গুড হাইজিন প্র্যাকটিসেস (জিএইচপি), গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিসেস (জিএমপি) অনুসরণ করতে হবে, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন অ্যাক্রিডিটেড ল্যাব থেকে সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়ামুক্ত সার্টিফিকেট প্রভৃতি প্রদান করতে হবে।

এর সবগুলো শর্ত পূরণের পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। এই ইউনিয়নভুক্ত দেশ মোট ২৭টি দেশ। এরা অভিন্ন মুদ্রায় লেনদেন করে এবং এক দেশের পণ্য অন্য দেশে অবাধে যাতায়াত করে। এসব দেশগুলোর বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে ইইউরোপীয় ইউনিয়ন কমিশন।

বাংলাদেশের পানের ওপর বহাল থাকা নিষেধাজ্ঞা চলতি বছর মে মাসে তুলে নেয়া হয়েছে ইইউ কমিশনের সিদ্ধান্তের আলোকেই। যা মেনে নিয়েছে সদস্যভুক্ত সবকটি দেশ।

ইইউ থেকে চলতি বছরের জানুয়ারিতে আনুষ্ঠানিক ব্রেক্সিট নেয়ার পর যুক্তরাজ্য অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে তাদের সরকারের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে। ফলে বাংলাদেশের পান রপ্তানির ক্ষেত্রে ইইউ কমিশনের সিদ্ধান্ত অন্যরা কার্যকর করলেও যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রে সেটি কার্যকর হয়নি।

এমন প্রেক্ষাপটে যুক্তরাজ্যের বাজারেও পান রপ্তানির সুযোগ চেয়ে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের অনুরোধ করে বাংলাদেশ।

এরই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাজ্যের লন্ডনে বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর এসএম জাকারিয়া হক বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে পান রপ্তানির ইস্যুটি দেখভলকারি সংস্থা ‘ইউকে- ফুড স্ট্যান্ডার্ড এজেন্সি’ (এফএসএ) এর সিনিয়র ইমপোর্টস স্ট্রাট্যাজি ম্যানেজার অলিভিয়া সিটরনির সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

এ যোগাযোগের পর থেকেই যুক্তরাজ্যের বাজারেও এখন পান রপ্তানির বাঁধা কেটে যাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হতে শুরু করে।

এর আগে সরকার প্রয়োজনীয় শর্তপূরণ সাপেক্ষে বাংলাদেশের সক্ষমতা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য প্রমাণ দাখিল করে ইইউ কমিশনে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর পানে বাংলাদেশের অর্জিত স্ট্যান্ডার্ড এর সন্তুষ্টি সাপেক্ষে ইইউ কমিশন তার আগের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয়।

এখন যুক্তরাজ্যের বাজারেও বাংলাদেশের পান রপ্তানির সুযোগ তৈরি করতে দেশটির বা ইউকে ফুড স্ট্যান্ডার্ড এজেন্সির (এফএসএ) কাছে অনুরূপ দালিলিক প্রমাণপত্র উপস্থাপন করতে হবে।

সম্প্রতি এমন বার্তা দিয়ে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের লন্ডন হাইকমিশন অফিস থেকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। ওই চিঠিতে বাণিজ্য সচিব ও কৃষি সচিবকে উদ্দেশ্য করে কমার্শিয়াল কাউন্সিলর এস এম জাকারিয়া হক চিঠি দেন।

চিঠিতে যুক্তরাজ্যে নিষিদ্ধ পান রপ্তানির বাজার খুলতে বাংলাদেশের সক্ষমতা প্রমাণ করে এমন সব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যতদ্রুত সম্ভব লন্ডন হাইকমিশনে পাঠানোর পরামর্শ দেন তিনি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ বলেন, ‘বিশ্বের যে কোনো দেশে পান রপ্তানির মত সক্ষমতা বাংলাদেশ অর্জন করেছে। একটা সময় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। তার থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশ এখন ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অর্জন করেছে। যে কারণে ইইউ কমিশন বাংলাদেশকে পুনর্বিবেচনা করেছে। এর ফলে ইইউর দেশগুলোতে বাংলাদেশের পান রপ্তানি বাড়তে শুরু করেছে।’

যুক্তরাজ্যের বাজারে পান রপ্তানির সুযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নিঃসন্দেহে এটা বাংলাদেশের জন্য দারুণ সংবাদ। ইইউর পর পান রপ্তানির বাঁধা ছিল যুক্তরাজ্যের বাজারে। এখন সেখানেও রপ্তানি অনুমোদন পাওয়ার একটি ইতিবাচক আবহ তৈরি হচ্ছে। আমরা আশা করছি শিগগিরই এর একটি সুরাহা হবে।’

ভবিষ্যতে রপ্তানি পণ্যে যেন কোনো ত্রুট না থাকে এবং দেশের পণ্যের মান নিয়ে যাতে বিদেশিরা প্রশ্ন তুলতে না পারে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকার কথাও বলেন সচিব।

নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগে ২০১২-১৩ সালে ১৮ হাজার ৭৮০ টন ও ২০১৩-১৪ সালে ১৩ হাজার ২৫০ টন পান রপ্তানি হয়। যার মূল্য যথাক্রমে ৩৮ মিলিয়ন ও ৩০ মিলিয়ন ইউএস ডলার।

যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে

বাংলাদেশ ইইউ আরোপিত শর্তপূরণে অনেকগুলো ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এর মধ্যে রয়েছে পান আবাদের এলাকা নির্বাচন, চুক্তিভিত্তিক চাষ, উত্তম কৃষি চর্চার আলোকে কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, মনিটরিং, ট্রেসিবিলিটি বা শনাক্তকরণ, পানের স্যাম্পল টেস্ট, কৃষক নির্বাচন ও প্রশিক্ষণ, রপ্তানিকারকদের প্রতিনিধিদের প্রশিক্ষণ, নিয়মিতভাবে পানের জমির মাটি ও পানি পরীক্ষা, রপ্তানি বাজারের জন্য নিরাপদ ও বালাইমুক্ত পান উৎপাদন নির্দেশিকা প্রভৃতি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রপ্তানি উইং) হাফিজুর রহমান বলেন, ‘রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের একটি হলো নিষিদ্ধ বাজারেও পান রপ্তানির পুনরায় সুযোগ পাওয়া। এর জন্য বিদেশে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নিয়োজিত কমার্শিয়াল কাউন্সিলরা দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। এখন যুক্তরাজ্যের বাজারেও পান রপ্তানির যে সম্ভাব্য সুযোগ তৈরি হতে যাচ্ছে এটি তারই একটি কর্মপ্রচেষ্টা।’

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক ও বাংলাদেশ ফ্রুটস ভেজিটেবলস অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফভিএপিইএ) সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ বসবাস করে। সেখানে পানসহ বাংলাদেশি উৎপাদিত বিভিন্ন ভেজিটেবল পণ্য দারুণভাবে সমাদৃত। কিন্তু ব্রেক্সিট হওয়ার কারণে ইইউর সিদ্ধান্ত এখন ব্রিটেনে বাস্তবায়ন হয়নি। তবে ইইউর সিদ্ধান্তের আলোকে আবেদন ও যথাযথ প্রমাণ দাখিল সাপেক্ষে ব্রিটেনে পান রপ্তানির সুযোগ তৈরি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। প্রয়োজন শুধু উদ্যোগের।

‘যতদূর শুনেছি, এ বিষয়ে সরকার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিল করতে যাচ্ছে। আমরা আশা করি এর মাধ্যমে যুক্তরাজ্যেও পান রপ্তানি উন্মুক্ত হবে।’

Development by: webnewsdesign.com