সরকারের পক্ষ থেকে যতই উন্নয়নের দাবী করা হচ্ছে ততই উন্নয়নের নামে রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকার অপচয় ও হরিলুটের চিত্র আরো বেশী স্পষ্ট হয়ে উঠছে। একদিকে রাজনৈতিক কারণে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে জনগণের সম্পদ ও পরিবেশ-প্রকৃতির শ্রাদ্ধ করা হচ্ছে, অন্যদিকে অর্থের অভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পের বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। জাতীয় বাজেটে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে এমন বৈপরীত্য দীর্ঘদিন ধরে চলে আসলেও অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে এই অপচয়ের পরিসীমা অনেক ব্যাপক ও প্রকট আকার ধারণ করেছে। কয়েক মাস আগে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, বিগত এক দশকে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সারাদেশে এমন পৌনে তিন হাজার সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে, যা’ আদতে স্থানীয় জনগণের কোন কাজেই লাগেনি। অথচ অনেক স্থানে মানুষের দীর্ঘদিনের দাবী ও আবেদন-নিবেদনের পরও একটি সেতু বা রাস্তার দাবী পূরণ হচ্ছে না, এমন উদাহরণ অসংখ্য। মূলত, রাজনৈতিক কারণে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ এবং বহুপক্ষীয় দুর্নীতি ও অপচয়ের নিকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি করেছে এসব অপ্রয়োজনীয় ও অপরিকল্পিত প্রকল্প।
গতকাল প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেটের ১২৫টি প্রকল্পের কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই প্রকল্পগুলো সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি (আইএমইডি)’র সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরুর পর নির্ধারিত সময়সীমা পেরিয়ে বার বার সময়সীমা বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যয়বৃদ্ধির পরও তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের বদলে অসম্পূর্ণ প্রকল্পের সমাপ্তি ঘোষণার এই প্রক্রিয়া থেকেই বোঝা যায়, এসব প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে বাস্তব প্রয়োজনের চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনা অথবা দুর্নীতি-লুটপাটের উদ্দেশ্যই প্রাধান্য পেয়েছিল। প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থতা এবং অবশেষে অসম্পূর্ণ প্রকল্পকে সমাপ্ত ঘোষণার এই বাস্তবতাকে পরিকল্পনা কমিশন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আর্থিক শৃঙ্খলা পরিপন্থী হিসেবে বিবেচনা করছেন বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হলেও শত শত কোটি টাকার অপচয় ও দুর্নীতির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণের কোন সুপারিশ করা হয়নি। ফিজিবিলিটি রিপোর্ট বা সব ধরনের আনুষঙ্গিক সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই কোটি কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণের পর মাঝপথে বা অসমাপ্ত করে তা বন্ধ করে দেয়ার পর সংশ্লিষ্টদের কোন রকম জবাবদিহিতার বাইরে রাখা বা শাস্তি না হওয়ার মধ্য দিয়ে ঊর্ধ্বতন ও বহুপক্ষীয় দুর্নীতির অভিযোগই প্রমাণিত হয়।
গতমাসে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৫ জেলায় পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প ২০০৬ সালে অনুমোদিত হওয়ার পর তা বাস্তবায়নে চার দফায় সময় বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক ঋণের ৩৭১ কোটি টাকা ব্যয় করার পর প্রকল্পটি বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। ১৬৫ কিলোমিটার সঞ্চালন পাইপ বসানোর পর বিতরণ লাইনের কাজ শুরুর আগেই প্রকল্প বন্ধ করে দিয়ে প্রকল্পের জন্য ক্রয়কৃত পাইপসহ সরঞ্জামাদি বিক্রি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অর্থাৎ প্রকল্পে ইতিমধ্যে ব্যয়িত পৌনে চারশ’ কোটি টাকার পুরোটাই অপচয় হয়েছে। একদিকে অর্থাভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ খাতে স্থবিরতা ও সংকট বাড়ছে, অন্যদিকে অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্পের পেছনে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করার পর তা পরিত্যক্ত হওয়ার বাস্তবতা দেখা যাচ্ছে। প্রয়োজনীয় বাজেটের অভাবে দেশের বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হাজার হাজার শিক্ষকের এমপিও বন্ধ রয়েছে বছরের পর বছর ধরে। এমনকি অপরিহার্যতা সত্ত্বেও বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও এমপিও হচ্ছেনা। এমপিওর জন্য বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষমাণ বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা পরিবার-পরিজনসহ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তারা তাদের দাবী দাওয়া নিয়ে স্থানীয়ভাবে এবং ঢাকায় মানব বন্ধনসহ আবেদন-নিবেদন, স্মারকলিপি দিয়ে কোন ফলাফল পাচ্ছেন না। অথচ অপ্রয়োজনীয় ও পরিত্যক্ত উন্নয়ন প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকার অপচয় ও লুটপাট করা হচ্ছে। প্রকল্প গ্রহণ এবং জনগণের রাজস্বের টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ধারণ এবং লাগামহীন অপচয়ের এই কালচার অবিলম্বে স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে।
Development by: webnewsdesign.com