প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও অন্যান্য কমিশনার নিয়োগের জন্য ১০ জনের নামের তালিকা চূড়ান্ত করেছে সার্চ কমিটি, যা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার। মঙ্গলবার সার্চ কমিটির শেষ বৈঠকে নামগুলো চূড়ান্ত করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সুপারিশকৃত নামের মধ্য থেকে ৫ সদস্যের নতুন ইসি গঠন করে বৃহস্পতিবার প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে। নতুন সিইসি ও অন্য চার কমিশনার শপথ নিয়ে দায়িত্বভার গ্রহণ করতে পারেন আগামী রোববার। সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি তাদেরকে সুপ্রিমকোর্টে শপথবাক্য পাঠ করাবেন। নতুন ইসিকে বরণ করে নিতে প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্র জানায়, সার্চ কমিটি প্রস্তাবিত ১০ জনের তালিকা পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিয়ে রাষ্ট্রপতি তার মধ্য থেকে একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য চারজনকে কমিশনার নিয়োগ দেবেন। কারণ সংবিধানের ৪৮-এর ৩ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘সংবিধানের ৫৬(৩) দফা মতে রাষ্ট্রপতি শুধু প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫-এর(১) দফা মতে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তার অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন- তবে শর্ত থাকে, সে ক্ষেত্রে কোনো আদালত সেই সম্পর্কে কোনো প্রশ্নের তদন্ত করিতে পারিবেন না।’ সংশ্লিষ্টরা জানান, বৃহস্পতিবার সার্চ কমিটির সদস্যরা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে তাদের সুপারিশকৃত নামের তালিকা প্রদান করবেন। ওইদিনই ইসি গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হলে রোববারের মধ্যে তারা শপথ নেবেন।
ইসি গঠন আইনে বলা হয়েছে, ‘আইনে বেঁধে দেওয়া যোগ্যতা, অযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সুনাম বিবেচনা করে সিইসি পদের জন্য দুইজন এবং নির্বাচন কমিশনারের চারটি পদের জন্য আটজনের নাম তারা প্রস্তাব করবে রাষ্ট্রপতির কাছে। সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার পদে কাউকে সুপারিশের ক্ষেত্রে তার তিনটি যোগ্যতা থাকতে হবে। তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে; বয়স ন্যূনতম ৫০ বছর হতে হবে; কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধা সরকারি বা বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত পদে বা পেশায় অন্তত ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।’
মঙ্গলবার বিকালে সুপ্রিমকোর্টের জাজেস লাউঞ্জে সার্চ কমিটির প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের সভাপতিত্বে সার্চ কমিটির শেষ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কমিটির সদস্য হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এসএম কুদ্দুস জামান, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মুসলিম চৌধুরী, সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হক। এর আগে রোববারের বৈঠকের পর সার্চ কমিটির প্রধান সাংবাদিকদের জানিয়ে ছিলেন, প্রস্তাবিত ১০ জনের নাম প্রকাশ করা হবে না। মঙ্গলবার প্রায় ৪ ঘণ্টা বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, সার্চ কমিটি তাদের বৈঠক শেষ করে ১০ জনের নাম চূড়ান্ত করেছে। তারা বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার কাছে এটা জমা দেবেন। পরে রাষ্ট্রপতি যেভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন, সেভাবে হবে।
এদিকে নতুন ইসিকে বরণ করে নেওয়ার সব প্রস্তুতি এরই মধ্যে শেষ করেছে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়। কর্মকর্তারা জানান, তারা নতুন সিইসি ও অন্য কমিশনারদের বসার কক্ষ ও সভাকক্ষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নাতার কাজ শেষ করেছেন। কক্ষগুলো রঙ করা থেকে শুরু করে ফার্নিচার পরিবর্তনসহ সব কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ১২, ১৩ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি মোট তিনদিনে চার দফায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মোট ৪৭ জন বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে বৈঠক করে সার্চ কমিটি। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন, ব্যক্তি পর্যায় থেকে প্রস্তাবিত ৩১৫ জনের নাম ১৪ ফেব্রুয়ারি রাতে প্রকাশ করা হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশও করা ওই তালিকায় অধিকাংশই ছিলেন অধ্যাপক, বিচারপতি, সাবেক সচিব, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা। তবে সেখান থেকেই যে ১০ জনের তালিকা করতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা আইনে নেই। কমিটি নিজস্ব বিবেচনা থেকেও তালিকা চূড়ান্ত করতে পারে। ওই তালিকা থেকে পাঁচজনকে বেছে নিয়ে রাষ্ট্রপতি গঠন করবেন ত্রয়োদশ নির্বাচন কমিশন।
তাদের মধ্যে একজন হবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি), বাকিরা নির্বাচন কমিশনার। আর তাদের ওপরই থাকবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ভার। তবে সার্চ কমিটির প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান জানান, প্রস্তাবিত নামের মধ্য থেকেই তারা ১০ জনের নাম চূড়ান্ত করেছেন। প্রস্তাবের বাইরে নিজেরা কোনো নাম সুপারিশ করবেন না।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, দেশের ইতিহাসে চতুর্থবারের মতো সিইসি ও কমিশনারবিহীন সময় পার করছে নির্বাচন কমিশন। এর আগে বিচারপতি মো. আবদুর রউফের নেতৃত্বাধীন কমিশন ১৯৯০ সালের ২৫ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৫ সালের ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে। এরপর বিচারপতি একেএম সাদেক নেতৃত্বাধীন কমিশন ১৯৯৫ সালের ২৭ এপ্রিল থেকে ১৯৯৬ সালের ৬ এপ্রিল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে। মধ্যে ৯ দিন সিইসিশূন্য ছিল ইসি। মোহাম্মদ আবু হেনার নেতৃত্বাধীন কমিশন ১৯৯৬ সালের ৯ এপ্রিল থেকে ২০০০ সালের ৮ মে পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে। এর মধ্যে দুদিন সিইসি শূন্য ছিল কমিশন। এমএ সাঈদ নেতৃত্বাধীন কমিশন ২০০০ সালের ২৩ মে থেকে ২০০৫ সালের ২২ মে পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে। তাদের দায়িত্ব গ্রহণের আগে ১৫ দিন সিইসিশূন্য ছিল ইসি। এরপর বিচারপতি এমএ আজিজ কমিশন দায়িত্ব পালন করে ২০০৫ সালের ২৩ মে থেকে ২০০৭-এর ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত।
২০০৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব নেয় এটিএম শামসুল হুদা কমিশন। দায়িত্ব নেওয়ার আগে ১৩ দিন কমিশনে কোনো সিইসি ছিলেন না। ২০০৯ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শামসুল হুদা কমিশন বিদায় নেয়। একই বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ নেতৃত্বাধীন কমিশন। তবে পরে শপথ নেওয়ায় নির্বাচন কমিশনার শাহ নেওয়াজ ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব নেয় কেএম নূরুল হুদা কমিশন। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি এই কমিশন বিদায় নেওয়ায় বর্তমানে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারশূন্য ইসি।
Development by: webnewsdesign.com