“মেলা তো শুধু মেলা নয় গো ভাই, এতো জীবন নিয়ে খেলা। ছোট্ট বেলা থেকেই কেলনা নিয়ে মেলায় মেলায় ঘুরে বেড়ান নুরুল হক মিয়া। করোনায় কারণে কয়েক বছর ধওে মেলা বন্ধ থাকায় বেচাকিনি নাই। ধারদেনা কওে আর সংসার চালাতে পারছি না। অন্য কাজও শিখিনি। তাই মেলাই ভরসা। এইবার যদি ঐতিহ্যবাহী গোলাকান্দাইল মেলাডা হয়, বউ পোলাপান নিয়ে চারডা ডাল ভাতের জোগাড় করতে পারমু। যদি চলে মেলো তবে চলে আমাগো জীবনের খেলা।” মেলা চললেই চলে নুরুল হকের মত হাজারো লোকের জীবন নামক খেলা অর্থাৎ জীবিকা।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার গোলাকান্দাইল শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী মেলা শুরু হওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনছে। গোলাকান্দাইল হাটের মাঠে এ মেলা বসলেও এর বিস্তৃতি ছড়িয়ে পড়তো গ্রামের ভেতরের সড়কেও। পহেলা মাঘ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শিবপূজাকে কেন্দ্র করে বসতো এই মেলা। ১৫দিেেনর এ মেলা চলতো মাসব্যাপী। এই মেলা হয়ে উঠতো সাধারণ মানুষের এক মিলন মেলা। গরিব-ধনী-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণীর মানুষ এ মেলায় অংশ নিতো। সব বয়সের মানুষের আগমনে এ মেলা স্থানীয়দের মিলন মেলায় পরিণত হয়ে উঠতো।
মেলায় মেলায় মুড়ি মুরকি, তক্তা, মোয়াসহ বিভিন্ন মুখরোচক মজা/ খাবার বিক্রেতা শহিদুল্লাহ মিয়া বলেন, “হুনতাছি এবার গোলাকান্দাইলের মেলা অইব (হবে)। আবার নাকি করোনাও বাড়তাছে। করোনায় বাণিজ্য মেলা হইতে পারলে গোলাকান্দাইলের মেলার সমস্যা কি? ওখানে তো বিদেশীসহ বড় বড় লোকেরা আইব। ওটা না হলেও তাগর কোনো সমস্যা নাই। বছর বছর এভাবে মেলা বন্ধ থাকলে তো আমরা না খেয়ে মরার উপক্রম।
আবহমান বাংলার সব গ্রাম্য মেলার মতোই এই মেলায়ও থাকতো নানা খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। নানা জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসতো বিক্রেতারা। ক্রেতারা হুমরি খেয়ে পড়তো মেলায়। তারা তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে নিতো এখান থেকে। গ্রামের সাধারণ মানুষের বিনোদনের এক সুবর্ণ সুযোগ করে দিতো এই মেলা। সার্কাস , যাত্রাপালা, পুতুলনাচ, যাদুসহ নানা আনন্দদায়ক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকতো এই মেলায়।
কাঠ, বাঁশ,বেত আর লোহার সামগ্রীতে ঠাসা গোলাকান্দাইল মেলার প্রধান আকর্ষণ বালিশ মিষ্টি। বড় বড় কড়াইতে চিনির সিরায় ভেসে থাকা রসগোল্লা দেখতে বালিশের মতো। তৃপ্তি সহকারে খাওয়ার জন্য এ মিষ্টির বিকল্প নেই। মহিষের দুধের ছানা থেকে এ মিষ্টি তৈরি হওয়ায় খাওয়ার সময় একটু মহিষালি গন্ধ পাওয়া যায়। এছাড়া মরণকুপ নামের মটর সাইকেল কসরতও প্রতি বছর থাকতো এই মেলায়। আর মাটির তৈরি নানা সরঞ্জামাদি পাওয়া যেতো এ মেলায়। এছাড়াও শিশুদের জন্য থাকতো নাগরদোলা।
পহেলা মাঘ আয়োজিত শতবর্ষী এ মেলাকে কেন্দ্র করে গোলাকান্দাইল এলাকায় চলতো আনন্দ যজ্ঞ। কয়েক বছর ধরে এই মেলা বসছেনা নানা কারণে। তবে এ বছরও ১৪ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনছে পুরো রূপগঞ্জসহ আশপাশের উপজেলার ক্রেতা-বিক্রেতা ও বিনোদনপ্রেমীরা। কয়েক বছর ধরে মেলা না হলেও মেলার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমেনি বিন্দু পরিমাণও। মেলা নিয়ে দর্শকদের খানিক মন খারাপ। কারণ মেলা হবে কি হবে না তা নিয়ে মানুষের মনে নানান প্রশ্ন।
মুড়াপাড়া এলাকার এক গৃহবধু বলেন, আমি ছোট বেলা আমার বাবার সাথে গোলাকান্দাইল মেলায় গিয়েছিলাম তখন বাবা আমার জন্য মাটির খেলনা কিনে দিয়েছিলো। আর কিনাকাটা শেষে মেলায় সার্কাস দেখিয়েছিলেন। তখন সার্কাস অনেক ভালো লেগেছিলো। এখন তো স্বামীর বাড়ি এছাড়া ছেলে মেয়ে বড় হয়েছে। তাই কোনো মেলায় যেতে পারি না। তার পরও যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু শুনছি কয়েক বছর ধরে মেলা হচ্ছে না। তবে এবার চিন্তা করেছি যদি মেলায় সার্কাস আসে তাহলে বাড়ির সবাই যাবো।
গোলাকান্দাইলের এই মেলার বিষয়ে কথা হয় আড়াইহাজার উপজেলার এক বাঁশি বিক্রেতা আলী হোসেনের সাথে। তিনি বলেন, আমি মেলায় মেলায় বাঁশি বিক্রি করে সংসার চালাই। গোলাকান্দাইল মেলায় ৪০ বছর যাবত বাঁশি বিক্রি করেছি। তবে কয়েক বছর ধরে মেলা হয় না বলে ঠিক মতো বাঁশিও বানাই না। দেখি যদি মেলা হয় তাহলে বাঁশি বানাইয়া রাখবো যাতে বিক্রি করতে পারি।
রূপগঞ্জ উপজেলার কাঞ্চন পৌরসভার আমীর হোসেন নামের এক বাসিন্দা বলেন, গোলাকান্দাইল ছাড়াও দেশের ৬৪ জেলায় বিভিন্ন মেলায় আমি অংশগ্রহণ করি। আর মেলায় মেলায় বাচ্ছাদের জন্য টমটম গাড়ি তৈরি করে বিক্রি করেই সংসারের খরচ নির্বাহ করি। তিনি আরও বলেন, মেলায় মেলায় ঘুরেই তার জীবনের আনন্দ খুঁজেন। তবে গোলাকান্দাইল মেলাটা একটু ব্যতিক্রম কারণ এই মেলা এক মাস হয়। এখানে বেচাকেনা করতে পারলে অনেক টাকা ইনকাম করতে পারি। তাই এবছর এই মেলার আশায় রয়েছি এবং গাড়ি তৈরি করার জন্য সারঞ্জম কিনে রেখেছি।
অপর বিক্রেতা মোঃ শামীম। জন্মের পর থেকে বাবাহারা এ বেলুন বিক্রেতা ৭ বছর বয়স থেকেই বেলুন বিক্রির সাথে জড়িত। আড়াইহাজার উপজেলার কল্যান্দী গ্রামের এ বেলুন বিক্রেতা জীবনের ৫যুগ পার করেছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মেলায় ঘুরে ঘুরে। সাধারণত শিশুরা তার কাছ থেকে বেলুন কিনে নিয়ে যায়। অনেক শিশু বাবা মায়ের সাথে মেলায় এসে বেলুন কিনে দেয়ার জন্য বায়না ধরে। যারা তাদের সন্তানদের বেলুন কিনে দিতে চান না তা দেখে খারাপ লাগে শামীমের। বেলুন কিনার পর শিশুদের হাসি মুখটা তার খুব ভালো লাগে।
সেই আনন্দে নিজের জীবনের সার্থকতা খুঁজেন এ বেলুন বিক্রেতা। তিনি অনেক সময় বিনে পয়সায় ছোট্ট শিশুদের বেলুন উপহার দেন। দুই ছেলে এক মেয়ের এ জনক নিজের সামান্য আয় দিয়ে সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করার চেষ্টা করছেন। তবে করোনা ভাইরাসের কারণে অনেক দিন অনেক কষ্ট করেছি। হাট-বাজারেও ঠিকমতো বেলুন বিক্রি করতে পারি না। এখন একটাই আশা গোলাকান্দাইল মেলা নিয়। এই মেলাটা হলে ঠিকমতো ব্যবসা করতে পারবো। আর ঠিকমতো ডাল-ভাত খেয়ে বাঁচতে পারবো।
গোলাকান্দাইল মেলার প্রধান আকর্ষণ বালিশ মিষ্টি বিক্রেতা গোলাকান্দাইল এলাকার শিবু বলেন, গোলাকান্দাইল মেলার প্রধান আকর্ষণ ছিলো আমাদের বালিশ মিষ্টি। আমি ছোট থেকে এই মেলায় বাবার সাথে মিষ্টি বিক্রি করতাম। আমি নিজেও মিষ্টি বিক্রি করেছি। কিন্তু আজ কয়েক বছর ধরে দেশের নানা পরিস্থিতির কারণে মেলা হয় না। তাই মিষ্টিও বিক্রি করতে পারি না। বাবুল নামে একজন গানের শিল্পী অনেক আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, আগে আমরা মেলায় যেতাম গিয়ে দেখতাম বিভিন্ন ধরনের খেলাসহ সার্কাস আসতো। তবে কয়েক বছর ধরে গোলাকান্দাইল মেলায় সার্কাস আসছেনা। এবার যদি গোলাকান্দাইল মেলায় সার্কাস আসতো তাহলে শিশু-কিশোররা ফি-ফায়ার,পাবজির মতো বিভিন্ন গেমসে ঝুঁকে যেতো না। শিশু-কিশোররা বেশি পছন্দ করেন সার্কাস।
এমনিতেই দিন দিন সার্কাসের জনপ্রিয়তা কমে যাচ্ছে আবারও করোনা পরিস্থিতি। শিশু-কিশোররা ফি-ফায়ার,পাবজিসহ বিভিন্ন গেমসে ঝুঁকে যাওয়ায় বিভিন্ন খেলাধুলার প্রতি তাদের আগ্রহ দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। রওশন সার্কাসের ম্যানেজার কিবরিয়া বলেন, দীর্ঘদিন যাবৎ করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মেলা বন্ধ থাকায় আমাদের সার্কাস পার্টিরাও খেয়ে না খেয়ে কোনো মতো বেঁচে আছে।
তবে এবার যদি রূপগঞ্জে এ মেলাটি হয় তাহলে আমাদের সার্কাস পার্টির জন্য অনেক উপকার হবে। এ বিষয়ে রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহ্ নুসরাত জাহান বলেন, জেলা প্রশাসকের অনুমতি বাদে কোনো মেলা হবে না। তবে কেউ যদি জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিয়ে আসে তাহলে মেলা হবে। এছাড়া এখন করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় বেশি জনসমাগম ঝুঁকিপূর্ণ।
Development by: webnewsdesign.com