মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে আদা, রসুন ও পেঁয়াজের দাম। ফলে চট্টগ্রামের ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার আবারও অস্থির হয়ে উঠছে। পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, চীনে করোনাভাইরাসের অজুহাত দেখিয়ে আমদানিকারকরা বাজারে এই তিনটি পণ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এতেই তৈরি হয়েছে সংকট। চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে সরবরাহের ঘাটতি দেখিয়ে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম কমপক্ষে ১০ টাকা, রসুন ৩০ টাকা এবং আদার দাম ২০ টাকা বাড়ানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করার পর দেশের বাজার নির্ভর হয়ে পড়ে মিয়ানমার ও চীনের ওপর। কিছুদিন আগেও মিয়ানমার ও চীন থেকে পেঁয়াজ এনে ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করা হচ্ছিল। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে বাজারে চীনের পেঁয়াজ সরবরাহ এক প্রকার বন্ধই রয়েছে। এতে প্রভাব পড়েছে মিয়ানমার থেকে আমদানি করা পেঁয়াজের দামেও।গত সপ্তাহে মিয়ানমারের প্রতিকেজি পেঁয়াজ ৮৫ টাকা থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল।
মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) খাতুনগঞ্জে সেই পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৯৫ থেকে ১০০ টাকায়।
এ বিষয়ে খাতুনগঞ্জের হামিদউল্লাহ মার্কেটের পেঁয়াজের আড়তদার মেসার্স বাচা মিয়া ট্রেডার্সের মালিক মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, ‘মিয়ানমার ও চীন থেকে যখন সরবরাহ স্বাভাবিক ছিল, তখন চীনের পেঁয়াজের দাম ৪০/৫০ টাকায় নেমে এসেছিল। ওই সময় মিয়ানমারের পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৬৫ থেকে ৭০ টাকায়। গত সপ্তাহ থেকে চীনের পেঁয়াজ আর বাজারে আসছে না। এরপর গত শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) মিয়ানমারের পেঁয়াজের কেজি ৮০ থেকে ৮৫ টাকায় উঠে যায়। সপ্তাহের মাঝামাঝিতে এসে আবারও বেড়ে ১০০ টাকায় পৌঁছেছে।’
তিনি আরো জানান, প্রতিদিন খাতুনগঞ্জে মিয়ানমারের কমপক্ষে ৪০ ট্রাক পেঁয়াজ ঢোকে। প্রতি ট্রাকে ১৩-১৪ মেট্রিকটন করে পেঁয়াজ থাকে। চীনের পেঁয়াজ ঢুকে ৪-৫ ট্রাক। কিন্তু এক সপ্তাহ ধরে চীনের কোনো পেঁয়াজ বাজারে আসছে না।
মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, ‘আমরা শুনেছি চীনে করোনাভাইরাসের কারণে শিপমেন্ট বন্ধ আছে। যারা আগে এলসি খুলেছিল তাদের চালানও আসছে না। নতুন করে কেউ এলসিও খুলতে পারছে না। আবার ভারত পেঁয়াজ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা খুব শিগগিরই তুলে নেবে- এমন একটা প্রচারণাও রয়েছে। ভারত রফতানি শুরু করলে চীন, পাকিস্তান, মিশর, হল্যান্ডের পেঁয়াজ তো কেউ খাবে না। সেজন্যও চীন থেকে পেঁয়াজ আনতে আগ্রহী নয় আমদানিকারকরা। সব মিলিয়ে বাজারে একটা সংকট সৃষ্টি হয়েছে।’
এদিকে, দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ২৪ লাখ মেট্রিকটন। অর্থাৎ মাসে ২ লাখ মেট্রিকটন ও দিনে প্রায় ৭ হাজার মেট্রিকটন, যার বড় অংশই আমদানির মাধ্যমে মেটাতে হয়। গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিলে দেশের বাজারে চরম ঘাটতি দেখা দেয়। কারণ, বাংলাদেশে আমদানি করা পেঁয়াজের সিংহভাগই আসে ভারত থেকে বিভিন্ন স্থলসীমান্ত দিয়ে। এর বাইরে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে আসে মিয়ানমারের পেঁয়াজ।
তবে তা পরিমাণে খুবই কম। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে জাহাজের মাধ্যমেও পেঁয়াজ আসে, যার পরিমাণ খুবই নগণ্য বলে জানিয়েছেন আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কৃষিজাত পণ্য আমদানির জন্য অনুমতি নিতে হয় বন্দরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্র থেকে। সংস্থাটির চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক মো. আসাদুজ্জামান বুলবুল বলেন, ‘করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরুর আগেই চীন থেকে পেঁয়াজ আমদানি কমেছে। কারণ যারা আমদানিপত্র খুলেছিলেন তারা পরে আর পেঁয়াজ সেভাবে আনেননি। তবে এরপরও চীন থেকে কিছু পেঁয়াজ নিয়মিত আসছে। বাজারে সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবার মতো অবস্থা তো আমরা দেখছি না।’
দেশের রসুন ও আদার বাজার পুরোটাই চীননির্ভর। কিছু রসুন দেশে উৎপাদন হলেও বড় অংশের যোগান দিতে হয় চীন থেকে আমদানির মাধ্যমে। গত সপ্তাহে নগরীর খাতুনগঞ্জে রসুন বিক্রি হয়েছিল কেজিপ্রতি ১৪০ টাকা। এ সপ্তাহে তা বেড়ে হয়েছে ১৭০-১৮০ টাকা। গত সপ্তাহে আদা বিক্রি হয়েছে ১১০ টাকায়। এ সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকায়।
এ বিষয়ে খাতুনগঞ্জের আড়তদার মেসার্স অছিউদ্দিন সওদাগরের মালিক রহুল আমিন চৌধুরী রিগ্যান বলেন, ‘পুরোটাই আমদানিকারকদের কারসাজি। তারা বাজারে আদা-রসুন সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। বলছে, করোনাভাইরাসের কারণে শিপমেন্ট হচ্ছে না। করোনাভাইরাসের প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে এক-দুই সপ্তাহ ধরে। চীন থেকে জাহাজে পণ্য তুললে বাংলাদেশে পৌঁছাতে সময় লাগে ২৫ দিন। তাহলে ২৫ দিন আগে যেসব রসুন-আদা দেশে এসেছে, সেগুলো কোথায় গেল? আমদানিকারকদের কারণে আদার দাম একদিনের ব্যবধানে ২৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।এছাড়া বাড়ছে রসুনের দামও।’
প্রায় একই বক্তব্য এসেছে উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় পরিচালক ড. আজহার আলীর কাছ থেকেও।
তিনি বলেন, ‘চীন পণ্য রফতানি বন্ধও করেনি। বাংলাদেশে চীন থেকে রসুন-আদা আসা বন্ধও হয়নি। এটা চলমান আছে। জানুয়ারি পর্যন্ত আগের তিনমাসে চীন থেকে রসুন-আদা আমদানিতে কোনো হেরফের নেই।’
এ ছাড়া কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে বাড়তি মুনাফার জন্য সবসময় বিভিন্ন অজুহাত খোঁজে। করোনাভাইরাসও তেমনি একটি অজুহাত। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত বিকল্প বাজার তৈরি করে ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করা।’
গতবছরের শেষে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম এ ভাইরাস সংক্রমণের বিষয়টি ধরা পড়ে। ধীরে ধীরে তা বিশ্বের ২৫টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এতে এ পর্যন্ত চীনসহ বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা চারশ ছাড়িয়ে গেছে।
বিভিন্ন দেশে মানুষ থেকে মানুষে নভেল করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার খবর আসতে থাকায় গত ৩০ জানুয়ারি এ ভাইরাস নিয়ে বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা জারি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
Development by: webnewsdesign.com