ডা. নাজমা আক্তার
প্রতি বছরের মতো এবারও বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে হজ পালনের জন্য সৌদি আরব যাচ্ছেন। এ পুরো ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সুষ্ঠুভাবে পালনের জন্য প্রত্যেকের মানসিক প্রস্তুতির পাশাপাশি শারীরিক প্রস্তুতিরও প্রয়োজন, বিশেষ করে ডায়াবেটিস রোগীদের।
হজ পালনের দীর্ঘ আনুষ্ঠানিকতার অনেক সময় এসব রোগীর ডায়াবেটিসের নিয়মকানুন যেমন-নির্দিষ্ট সময়ে পরিমিত আহার বা শারীরিক ব্যায়াম, নিয়মিত রক্তের সুগার পরীক্ষা ব্যাহত হওয়ার আশংকা থাকতে পারে। আর ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে নানা রকম ইনফেকশনে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও অনেকাংশে অন্যদের তুলনায় বেশি থাকতে পারে। কখনো কখনো পানিশূন্যতা, হিট স্ট্রোক বা রক্তের সুগার বেড়ে যাওয়া বা হাইপো বা কমে গিয়ে সংকটাপন্ন অবস্থাও তৈরি হতে পারে।
* ডায়াবেটিস রোগীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি
এসব ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে রক্তের সুগার বেড়ে যাওয়া, রক্তের সুগার কমে যাওয়া, পানিশূন্যতা, হিট স্ট্রোক, নানা ধরনের ইনফেকশন (যেমন-ডায়রিয়া, শ্বাসতন্ত্রের ইনফেকশন ইত্যাদি) ও পায়ের ক্ষত বা আলসার। তবে হজযাত্রার আগে কিছু প্রস্তুতি ও হজ পালনের সময় কিছু সতর্কতা একজন ডায়াবেটিস হজ পালনকারীকে নির্বিঘ্নে হজ পালনে সহায়তা করতে পারে।
* হজপূর্ব প্রস্তুতি
▶ হজযাত্রার আগেই প্রত্যেক ডায়াবেটিস রোগীর তার চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। একজন চিকিৎসক হজ পালনে ডায়াবেটিস রোগীর সতর্কতা থাকার ব্যাপারগুলো পরামর্শ দেবেন, মুখে খাওয়ার ওষুধ বা ইনসুলিনের মাত্রা নির্ধারণ করে দেবেন ও ডায়াবেটিসের সুগার বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়ার লক্ষণ, পূর্বসতর্কতা ও প্রতিরোধে করণীয় নিয়েও পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
▶ প্রত্যেক রোগীই তার চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন বা চিকিৎসাপত্র সঙ্গে রাখবেন।
▶ হজ পালনকালীন প্রয়োজনীয় ওষুধের তালিকা অনুযায়ী সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
▶ হজ পালনের কমপক্ষে দুই সপ্তাহ আগেই ইনফ্লুয়েঞ্জা ও মেনিনজাইটিসের (মেনিনগোকক্কাল) ভ্যাকসিন বা টিকা নিতে হবে।
▶ প্রত্যেকেই যথেষ্ট পরিমাণে ওষুধ, ইনসুলিন, ইনসুলিনের পেন বা কলম, সিরিঞ্জ, নিডলস ও রক্তের সুগার চেক করার গ্লুকোমিটার সঙ্গে রাখতে হবে বা গুছিয়ে নিতে হবে।
▶ সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা পেতে সবাই ছাতা সঙ্গে নেবেন।
▶ পায়ের ক্ষত এড়াতে আরামদায়ক জুতা ও কটনের নরম মোজা নিতে হবে।
▶ ইনসুলিন কখনো বিমানের লাগেজে দেওয়া যাবে না। এতে ইনসুলিন জমে গিয়ে কার্যকারিতা হারাতে পারে। প্রয়োজনে হাত ব্যাগে ইনসুলিন বহনকারী কোল্ড কনটেইনার বা বক্স ব্যবহার করা যেতে পারে।
▶ হ্যান্ড স্যানিটাইজার নিতে ভুল করবেন না।
* হজ চলাকালীন সতর্কতা
▶ অতিরিক্ত ইনসুলিন হজ ক্যাম্পের ফ্রিজে সংরক্ষণ করতে হবে। আর হজ চলাকালীন প্রয়োজনীয় ইনসুলিন শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাক্সের মধ্যে রাখতে হবে।
▶ নিয়মিত রক্তের সুগার চেক করতে হবে। বিশেষ করে তাওয়াফের আগে ও পরে।
▶ সঙ্গে সব সময় চকোলেট বা খেজুর রাখুন।
▶ হজ ক্যাম্পে আগেই জানিয়ে রাখুন আপনি একজন ডায়াবেটিস রোগী। প্রয়োজনে হজ ক্যাম্পের চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
* খাদ্য গ্রহণে সতর্কতা
▶ হজ ক্যাম্পে সুষম খাবার গ্রহণ করুন। শাকসবজি, ফলমূল ও আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ করুন।
▶ অতিরিক্ত মসলাদার বা মিষ্টান্ন পরিহার করুন।
▶ সারা দিনে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন।
▶ অতিরিক্ত চা, কপি বা সুগার সমৃদ্ধ পানীয় পরিহার করুন।
▶ রক্তের সুগার কমে গেলে (২৭০ মি. গ্রাম) সঙ্গে সঙ্গে ২-৩টি খেজুর অথবা ১ চা চামচ মধু বা অর্ধেক গ্লাস ফলের জুস খেয়ে নিন। ১৫ মিনিট পর আবার রক্তের সুগার চেক করুন ও প্রয়োজনে মেডিকেল টিমের সাহায্য নিন।
* পায়ের যত্নে সতর্কতা
ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের হজ পালনের সময় পায়ের যত্নে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কখনই খালি পায়ে হাঁটা যাবে না। আরামদায়ক সুতার ও মোজা ব্যবহার করতে হবে। প্রতিদিন ক্যাম্পে গিয়ে ভালো করে পা সাবান-পানি দিয়ে পরিষ্কার করে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে হবে। কোনো ক্ষত, কাটাছেঁড়া, ফোসকা থেকে রক্তের পরিবর্তন ইত্যাদি দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
একটি সঠিক পূর্বপরিকল্পনা, চিকিৎসকের পরামর্শ ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় একজন ডায়াবেটিস রোগীর পক্ষেও একটি সুস্থ, সুষ্ঠু ও নিরাপদ হজ পালন সম্ভব। লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, হরমোন ও ডায়াবেটিস রোগ বিভাগ, মার্কস মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, মিরপুর, ঢাকা।
Development by: webnewsdesign.com