স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে ৫ হাজারের বেশি শিশু

বুধবার, ২৫ জানুয়ারি ২০২৩ | ৪:০৬ অপরাহ্ণ

স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে  ৫ হাজারের বেশি শিশু
স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে ৫ হাজারের বেশি শিশু
apps

কেউ ব্যস্ত গরু-ছাগল পালনে, কেউ আবার খেত-খামারের কাজ নিয়ে। বিকেলে সবার সময় কাটে বাজারের চায়ের দোকানে টিভি দেখে। এদের সবার বয়স ৮ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণের কোনো সুযোগ নেই সেখানে। এসব শিশুর কাউকে দেওয়া হয়নি ৬টি রোগের কোনো টিকাও। অনেকটা ভবঘুরে জীবনযাপন করছে তারা। স্বাস্থ্যঝুঁকিসহ অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে বেড়ে উঠছে এসব শিশুরা। নোয়াখালী হাতিয়ার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চরগাসিয়ার চিত্র এটি।

স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৩ সাল থেকে এই চরে মানুষের বসবাস শুরু হয়। প্রতিদিন ট্রলারে করে নদী পাড়ি দিয়ে লোকজনকে উপজেলা সদরে যাতায়াত করতে হয়। এখানে ৬টি সমাজে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার পরিবার বসবাস করছে। এসব পরিবারের বিদ্যালয়ে যাওয়ার মতো শিশুর সংখ্যাও ৫ হাজারের বেশি নয়। দীর্ঘ ১০ বছরের চেয়ে বেশি সময় ধরে বসবাস করলেও এই চরে এখনও গড়ে ওঠেনি রাস্তাঘাট, স্কুল ও মাদরাসা। সরকারি সুযোগ-সুবিধাও অনুপস্থিত এই চরে।

চরের উত্তর পাশে বারোআউলিয়া সমাজ। এই সমাজের নামানুসারে গড়ে উঠেছে বারোআউলিয়া বাজার। বাজারের উত্তর পাশে খালের পাড়ে একখণ্ড জমিতে বসবাস করেন মো. সেলিম (৪৭)। পেশায় দর্জি সেলিম একসময় বসবাস করতেন চানন্দী ইউনিয়নের কেরিং চরে। নদী ভাঙনের কবলে পড়ে এখন এই চরে এসে বসবাস করছেন তিনি।

সম্প্রতি তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছোট তিনটি শিশু নিয়ে স্ত্রী নারগিস রান্নার কাজ করছেন।বাহিরে বাতাসে রান্না করা যাচ্ছে না, তাই শোবার ঘরেই চুলা তৈরি করে রান্না করছেন। শিশুরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খেলা করছে। সবার শরীরে ধুলাবালু লেগে রয়েছে।

নারগিস জানান, প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই চরে। তাই, শিশুরা বাড়িতে অবস্থান করছেন।তিন সন্তানের মধ্যে সবার বড় আয়েশা। বয়স ৯ বছর হলেও এখনও প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা দেওয়া যাচ্ছে না তাকে। চরে কোথাও প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। তাই, বাড়িতে থেকে সংসারের কাজ করে দিন কাটে তার। একই অবস্থা দ্বিতীয় সন্তান আমেনারও। তারও বয়স ৭ বছর। এদের কাউকে দেওয়া যায়নি ৬টি রোগের টিকা।

সেলিমের বাড়ির দক্ষিণ পাশে কৃষক আজগর হোসেনের বাড়ি। সাংবাদিকদের দেখে এগিয়ে এসে কথা বলেন তিনি। আজগর জানান, বিদ্যালয় নেই এই চরে, তাই ছেলে-মেয়েরা পড়ালেখা করতে পারছে না। চরে বসবাস করা এসব শিশুদের কোনো টিকা দেওয়া হয়নি। সরকার শিশুদের দেওয়া টিকা কার্যক্রমের ওপর যেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে, তা এই চরে অনুপস্থিত। দুটি মেয়ে-সন্তানসহ তার চার সন্তানের কেউ টিকা পায়নি। বড় ছেলেটি বারোআউলিয়া বাজারের মসজিদে কোনোমতে চালু হওয়া নুরানি মাদরাসায় যায় মাঝেমধ্যে। বর্ষায় রাস্তা না থাকায় তা-ও যাওয়া সম্ভব হয় না।

আজগর আরও জানান, এই নুরানি মাদরাসাটি স্থানীয় এক হুজুরের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। ভালো কোনো লেখাপড়া সেখানে হয় না। চরে এই ধরনের আরও ৩টি নুরানি মাদরাসা রয়েছে। এসব মাদরাসার শিক্ষকদের যোগ্যতা নিয়েও হতাশা ব্যক্ত করেন তিনি।

সরেজমিনে চরের বিভিন্ন প্রান্তে হেঁটে দেখা যায়, ছোট ছোট শিশুরা খেতে-খামারে কাজ করছে। অনেকে চরের খোলা মাঠে গরু ছাগল লালনপালন করছে।

বিকেলে বারোআউলিয়া বাজারের চায়ের দোকানে দেখা যায়, এসব শিশুরা টিভি দেখায় মগ্ন। এদের মধ্যে একজন রাপুল (১০)। রাপুল চরের পশ্চিম পাশে ইসলামপুর সমাজে বসবাস করেন। আলাপকালে রাপুল জানায়, সারাদিন পরিবারের বড়দের সঙ্গে কাজ করেন। বিকেল হলে বাজারের টিভি দেখতে চলে আসেন। চরে এসেছে ৬ বছর বয়সে। চরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় পড়ালেখা করতে পারছে না।

বাজারের মা ফামের্সি নামে একটি ওষুধের দোকানে মালিক রনজিৎ চন্দ্র দাস। সবাই তাকে রনজিৎ ডাক্তার হিসাবে চেনে। রনজিৎ জানান, চরে ৭ বছর ধরে পল্লী চিকিৎসক পেশায় আছেন তিনি। জ্বর, সর্দি ও কাশি হলে মানুষজন তার কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খেয়ে থাকেন। জটিল রোগ হলে সবাইকে নদী পাড়ি দিয়ে উপজেলা সদর ওচখালী যেতে হয়।

রনজিৎ আরও জানান, এই চরে শিশুদেরকে টিকা দেওয়া হয় না। জন্মের পর সবাই টিকা ছাড়াই বড় হচ্ছেন। এতে হাম, যক্ষাসহ বড় রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায় তাদের।

এই বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিদর্শক আবু সালেহ মো. কবির জানান, চরগাসিয়ায় বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই। সেখানে সোলারচালিত বিদ্যুৎ ব্যবহার করে সবাই। শিশুদের দেওয়া টিকা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখতে হয়। এজন্য সেখানে টিকা কার্যক্রম চালানো যাচ্ছে না। এ ছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। একটি ট্রলার দিনে একবার যায়, পরদিন ফিরে আসে। দিনে ফিরে আসার সুযোগ নেই।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) কামরুল ইসলাম জানান, নতুন জেগে ওঠা এই চরে মানুষজন বসবাস শুরু করেছে কয়েক বছর আগ থেকে। সেখানে স্থানীয় সরকার কার্যক্রমও অনুপস্থিত। চরে একটি আশ্রয়কেন্দ্র ও নেই। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু করার মতো কোনো অবকাঠামো পাওয়া যাচ্ছে না। তবে কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করার জন্য প্রাস্তাব পাঠানো হয়েছে।

এ ব্যাপারে হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম হোসেন বলেন, চরগাসিয়া একটি নতুন জেগে ওঠা চর। ১নং হরনী ইউনিয়নের অংশ এটি। ভৌগলিক কারণে অনেক উন্নয়ন সেখানে চাইলেও সম্ভব হয় না। সম্প্রতি এই চরকে সিডিএসপি প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়নের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসকসহ ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তা এই চর পরিদর্শন করে এসেছেন।

Development by: webnewsdesign.com