মাছ বাছাই, মাছ রৌদ্রে দেওয়া ও তার প্রয়োজনীয় পরিচর্যাসহ বিভিন্ন কাজে যুক্ত হাজারো নারী-পুরুষ। বাড়ির কাজ কর্ম সেরে বাড়তি রোজগারের জন্য মৌসুমী কর্মে নেমে পড়েন চলনবিলে এলাকার নারীরা। চলনবিল অঞ্চলের পাঁচ জেলার হাজারো নারী শ্রমিক ব্যস্ত সময় পার করছেন শুঁটকি তৈরিতে। সিরাজগঞ্জে বৃহত্তর চলনবিল এলাকায় গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা গেছে।
চলনবিল অঞ্চলের নারীদের মৌসুমি কর্মসংস্থানের পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে এ অঞ্চলের শুঁটকি খাত।
জানা গেছে, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নাটোর, বগুড়া ও রাজশাহী অঞ্চলে দেশীয় শুঁটকি তৈরি করা হচ্ছে। ভোর থেকে শুরু হয় কর্মযজ্ঞ। মাছে লবণ মাখানো, ওজন করা, বহন করে মাচায় নেওয়া, উল্টেপাল্টে দেওয়া, বাছাই করা-আরও কত কাজ! আর সব কাজই করেন নারীরা।
নাটোর শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে সিংড়া উপজেলা। সিংড়া সেতুসংলগ্ন বাজার থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরের গ্রাম নিঙ্গুইন। চলনবিলের মিঠা পানির মাছের শুঁটকির জন্য বেশ নাম আছে জায়গাটির। মৌসুমে রাস্তার পাশে বিশাল এলাকাজুড়ে শুঁটকি মাছ তৈরির কারখানা। আশপাশের গ্রামের নারীরাই প্রাণ এ শুঁটকিপল্লীর। চলনবিলের অধিকাংশ মাছ চলে আসে জেলা-উপজেলা সুদূরের আড়ত ও বাজারে। সেখান থেকে পাইকাররা শুঁটকির জন্য কিনে আনেন শত শত মণ মাছ। ভাদ্র থেকে মাঘ মাস পর্যন্ত চলে শুঁটকির জন্য মাছ সংগ্রহ। বর্ষার পানিতে চলনবিলে যেসব মাছ বেড়ে ওঠে সেসব মাছ ধরা হয় এ সময়।
এ বিষয়ে শুঁটকি ব্যবসায়ী রাশেদুল জানান, এখন মৌসুম প্রায় শেষ। তাই দিনে ১২-১২ মণ মাছ সংগ্রহ করা যায়। মৌসুমে এটা গিয়ে দাঁড়ায় ৩৫-৪০ মণে। সরকারি জায়গা লিজ নিয়ে চালানো এ পল্লীতে এখন কাজ করছেন ৪০জন নারী। ভরা মৌসুমে এক হাজার নারী কাজ করেন। মাছ ওজন করার পর লবণ মাখানো হয়। এটা মাছ দ্রুত শুকাতে সাহায্য করে, তাছাড়া মাছ ভালোও রাখে। লবণ মাখানো হলেই সেগুলো মাচায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মাছগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রোদে দেওয়া হয়। এ কাজটিও করেন নারীরাই।
শুটকির চাতাল ঘুরে দেখা যায়, এখানে শুঁটকি করা হয় শোল, বোয়াল, রায়েক, খলিসা, পুঁটি, গুঁচি, টেংরা, চান্দা, বাতাসি, কাকিলা, বেলে, মলা, চিংড়ি, টাকিসহ বিভিন্ন মাছ শুকানো হচ্ছে। শুটকির চাতালে কাজ করছেন কয়েকজন নারী শ্রমিক। তাদের মধ্যে লিপি, রাশিদা, ইতির নাম জানা গেল। তাদের মতো অনেক নারী এখানে সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করেন। মজুরি সে তুলনায় কমই বলতে হবে। ১১০ টাকা প্রতিদিন। মৌসুমে আরও বেশি সময় থাকতে হয়।
মাচায় মাছ নাড়তে নাড়তে রাশিদা জানান, কাজ করতে তার ভালো লাগে। কিন্তু অনেক সময় দেওয়া লাগে। তার তুলনায় মজুরি খুব বেশি পান না, যা পান তা দিয়ে সংসার চালানোর ক্ষেত্রে স্বামীকে সহযোগিতা করেন।
শুঁটকির মহাজন জাকির জানান, পুঁটি মাছ ৪০-৮০ টাকা কেজি কিনে শুঁটকি করে বিক্রি করেন ২৫০-৩৫০ টাকা, রায়েক ৪০-৬০ টাকায় কিনে, বিক্রি ৮০-১৪০ টাকায় বিক্রি করেন। এছাড়া খলিসা ৪০-৪০ টাকায় কিনে বিক্রি ৭০-৮০ টাকায়। বোয়াল কেনা ১০০-১২০, বিক্রি ৫০০-৬০০, শোল ৮০-১০০ টাকায় কিনে বিক্রি ৫০০-৫৫০ টাকায়। চান্দা ৩০-৩৫ টাকা কেনা, বিক্রি ১০০-১২০ টাকায়।
ব্যবসায়ীরা জানান, মিঠা পানির এ শুঁটকি নাটোর, রংপুর, সৈয়দপুর, নীলফামারীসহ বিভিন্ন এলাকায় যায়। ঢাকাসহ অন্য জেলায় আসে খুব কম। শুঁটকি মৌসুমে কাজ করে অনেক নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। বছরের ছয় মাস অন্তত তাদের কাজের অভাব থাকে না। গ্রামীণ অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে তারাও রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এ ছয় মাস তাদের মাছ কেনাও লাগে না। মহাজন নিয়মিত খেতে দেন। তবে সারাদিন বিরামহীন খেটেও পারিশ্রমিক পান সামান্যই।
Development by: webnewsdesign.com