বিয়ে, শিশুর জন্ম, জন্মদিন, সুন্নতে খতনা (মুসলমানি), শিশুর প্রথম ভাত খাওয়ার অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন শুভদিনে এক সময় সোনার অলংকার উপহার দেওয়া রীতিতে পরিণত হয়েছিল। শুধু কাছের আত্মীয় নয়, কিছুটা দূরের আত্মীয়রাও শুভদিনে উপহার হিসেবে সোনার অলংকার দিতেন। বিশেষ করে মধ্যবিত্তরা বিশেষ অনুষ্ঠানে ছোট আংটি, গলার চেইন, হাতের বালা অনেকটা হাসিমুখেই উপহার হিসেবে দিতেন।
সময়ের বিবর্তনে পাল্টে গেছে সেই দৃশ্যপট। সোনার অলংকার উপহার দেওয়ার সেই রীতি হারিয়ে গেছে অনেকটাই। কাছের আত্মীয়ের শুভদিনের অনুষ্ঠানেও এখন মানুষ একেবারে বাধ্য না হলে হাসিমুখে খুব একটা সোনার অলংকার উপহার হিসেবে দেন না। এর মূল কারণ সোনার অস্বাভাবিক দাম। এতটাই দাম যে পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা দিয়ে ছোটখাটো সোনার অলংকারও হয় না।
সোনার অস্বাভাবিক দামের কারণে শুধু মধ্যবিত্ত নয়, উচ্চবিত্তরাও অনেকে অলংকার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। একেবারে বাধ্য না হলে এখন কেউ সোনার অলংকার কিনছেন না। ফলে অলংকার ব্যবসায়ও এক ধরনের মন্দা দেখা দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানান, এখন সোনার অলংকার বিক্রি একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। কোনো কোনো ব্যবসায়ীর তিন থেকে চারদিনেও কোনো অলংকার বিক্রি হচ্ছে না। বিক্রি না থাকায় কর্মীদের বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছেন অনেক ব্যবসায়ী।
করোনা মহামারি শুরুর পর থেকেই সোনার অলংকার ব্যবসায় মন্দা শুরু হয়। করোনা মহামারির মধ্যে আয় কমে যাওয়ায় অনেকে জমানো সোনা বিক্রি করেন। ফলে বছর দুয়েক আগেও সাধারণ মানুষ সোনা কেনার চেয়ে বিক্রি করেছেন বেশি। এখন সাধারণ মানুষ সোনার অলংকার যেমন কিনছেন না, তেমনি বিক্রিও খুব একটা করছেন না। এতে মনে হচ্ছে, স্বল্পআয়ের মানুষের কাছে সোনার অলংকার খুব একটা জমা নেই।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে বায়তুল মোকাররম মার্কেটে সোনার অলংকার কিনতে এসেছেন আলেয়া বেগম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, চাচাতো বোনের বিয়ে। তাই তার জন্য সোনার অলংকার কিনতে এসেছি। কিন্তু ১০ হাজার টাকার মধ্যে তেমন কোনো অলংকার পাওয়া যাচ্ছে না। কয়েকটি দোকান ঘুরেছি, কোথাও ২০ হাজার টাকার নিচে ভালো আংটি বা কানের দুল পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, চাচার একটাই মেয়ে। তার বিয়েতে অলংকার না দিলে সম্মান থাকে না। তাই অনেক খোঁজাখুঁজি করে ২২ হাজার টাকা দিয়ে একজোড়া কানের দুল কিনেছি। এত টাকা দিয়ে উপহার দিচ্ছি, তারপরও পছন্দ হবে কি না চিন্তায় আছি। শখ করে হাসিমুখে কাউকে যে সোনার কিছু উপহার দেবো সেই উপায় নেই।
তাঁতিবাজারে কথা হয় আরফানুল ইসলামের সঙ্গে। পুরান ঢাকার এ বাসিন্দা বলেন, প্রায় ৩০ বছর ধরে পুরান ঢাকায় বসবাস করছি। আমার আত্মীয়-স্বজন অনেকেই গ্রামে থাকেন। আগে দেখেছি, গ্রামেও ছোটখাটো অনুষ্ঠান হলে কাছের আত্মীয়কে ছোট করে হলেও সোনার অলংকার উপহার দিতেন। এমনকি কিছুটা দূরের আত্মীয়ের অনুষ্ঠানেও দাওয়াত খেতে গিয়ে সোনার অলংকার উপহার হিসেবে দেওয়া হতো। কিন্তু এখন এটা খুব একটা দেখা যায় না। কারণ এখন সোনার অনেক দাম।
তিনি বলেন, একটি বিয়ে বা জন্মদিনের অনুষ্ঠানে পাঁচ হাজার টাকা উপহার দিলে মানুষ খুশি হয়। কিন্তু পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে এখন একেবারে ছোট কোনো অলংকারও পাওয়া যায় না। অথচ আগে এক-দেড় হাজার টাকা দিয়ে সোনার ছোট অলংকার কেনা যেত। যে কারণে স্বজনরা, বিশেষ করে মধ্যবিত্তরা কাছের আত্মীয়ের অনুষ্ঠানে গেলে সোনার অলংকার উপহার হিসেবে দিতেন।
মানুষ যে এখন খুশি মনে উপহার হিসেবে সোনার অলংকার দিচ্ছে না, তা সোনার দামের দিকে তাকালেও বোঝা যায়। দেশের বাজারে সোনার দাম নির্ধারণের দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)। সবশেষ গত ২৪ আগস্ট ঘোষণা দিয়ে ২৫ আগস্ট থেকে দেশের বাজারে সোনার নতুন দাম নির্ধারণ করেছে অলংকার ব্যবসায়ীদের এ সংগঠনটি। বর্তমানে এ দামেই দেশের বাজারে সোনা বিক্রি হচ্ছে।
সবচেয়ে ভালো মানের বা ২২ ক্যারেটের এক ভরি (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) সোনার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ২৪৪ টাকা। এছাড়া ২১ ক্যারেটের এক ভরি সোনা ৯৬ হাজার ৬৩৬ টাকা, ১৮ ক্যারেটের এক ভরি সোনা ৮২ হাজার ৮১৪ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির এক ভরি সোনা ৬৯ হাজার ৫১ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশের বাজারে এর আগে কখনো সোনার এত বেশি দাম নির্ধারণ করা হয়নি।
অবশ্য বাজুস নির্ধারিত দামে সোনার অলংকার কিনতে পারেন না সাধারণ ক্রেতারা। কারণ বাজুস নির্ধারিত দামের সঙ্গে ভ্যাট ও মজুরিসহ সোনার অলংকার কিনতে হয়। বাজুস নির্ধারণ করা দামের ওপর ভ্যাট দিতে হয় ৫ শতাংশ। আর ভরিপ্রতি মজুরি ধরা হয় ন্যূনতম ৩ হাজার ৪৯৯ টাকা। ফলে বর্তমান দাম অনুযায়ী, ভালো মানের এক ভরি সোনার গহন কিনতে হলে ক্রেতাকে ১ লাখ ৯ হাজার ৮০৫ টাকা গুনতে হবে।
২৫ আগস্ট নতুন দাম নির্ধারণ করার আগে চলতি বছর দেশের বাজারে আরও ১৭ বার সোনার দাম কমানো বা বাড়ানোর ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ, বছরের প্রথম আট মাসেই দেশের বাজারে সোনার দাম ১৮ বার নির্ধারণ করা হয়েছে। এক বছরের প্রথম আট মাসে দেশের বাজারে আগে কখনো এতবার সোনার দাম নির্ধারণ করার ঘটনা ঘটেনি। গত বছর প্রথম আট মাসে সোনার দাম ১৭ বার নির্ধারণ করা হয়।
অন্যদিকে, বিশ্ববাজার ও দেশের বাজারে সোনার দামের মধ্য বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। বিশ্ববাজারের তুলনায় দেশের বাজারে প্রতি ভরি সোনা প্রায় ১৪ হাজার টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এ প্রতিবেদন লেখার সময় বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স (২৮ দশমিক ৩৫ গ্রাম) সোনার দাম ছিল ১ হাজার ৯২৩ ডলার। তাতে প্রতি ডলার ১১০ টাকা করে ধরলে এক ভরির দাম দাঁড়ায় ৮৭ হাজার টাকা।
বিশ্ববাজারের সঙ্গে দেশের বাজারে সোনার দামে এমন পার্থক্য হওয়ার কারণ জানতে চাইলে বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিং কমিটির চেয়ারম্যান এম এ হান্নান আজাদ জাগো নিউজকে বলেন, রিসাইক্লিং করে যে সোনা পায়, তা আমরা আমাদের যে হোলসেল মার্কেট আছে সেখান থেকে কিনি। সোনা এখন আমদানি হয় না এবং কেউ সোনা আমদানি করছে না। স্থানীয় বাজারে যা পাওয়া যায়, তা দিয়ে আমাদের চলতে হচ্ছে। আমরা স্থানীয় বাজারের ওপর নির্ভর করে সোনার দাম নির্ধারণ করি।
এদিকে সোনার বাড়তি দামের কারণে ব্যবসায় মন্দা দেখা দিয়েছে বলে জানান বসুন্ধরা সিটির এক ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, এখন বিক্রি নেই বললেই চলে। মানুষ এখন সোনার অলংকার কিনছে না। আমরা বাড়তি দামে সোনা কিনে অলংকার বানাচ্ছি ঠিকই, কিন্তু ক্রেতা পাচ্ছি না। এমনও ঘটনা ঘটছে দুই থেকে তিনদিন কোনো বিক্রি নেই। আমরা বর্তমানে খুব খারাপ পরিস্থিতিতে আছি। সোনার ব্যবসা এখন একটি সিন্ডিকেটের দখলে চলে গেছে। প্রকৃত ব্যবসায়ীরা বিপাকে আছেন।
তাঁতিবাজারের ব্যবসায়ী বিশ্বজিৎ সরকার জাগো নিউজকে বলেন, আগে ছোটখাটো অনুষ্ঠানেও মানুষ সোনার অলংকার উপহার হিসেবে দিতো। কিন্তু এখন সেই রীতি প্রায় বন্ধ হয় গেছে। করোনা মহামারি শুরুর পর সোনার অলংকার বিক্রি আশঙ্কাজনক হারে কমে যায়। সোনার বাড়তি দামের কারণে দিন যত যাচ্ছে বিক্রি তত কমছে।
তাঁতিবাজারের একটি দোকানের কর্মী সুমন বলেন, আমরা সোনার অলংকার বিক্রির পাশাপাশি বন্ধকও রাখি। আগে অনেকে জরুরি প্রয়োজনে অলংকার বন্ধক রেখে টাকা নিতেন। এখন বন্ধক রাখার প্রবণতাও কমে গেছে। আবার নতুন অলংকারও খুব একটা কিনছেন না। সবমিলিয়ে আমাদের ব্যবসায় এক ধরনের মন্দা দেখা দিয়েছে।
বায়তুল মোকাররম মার্কেটের একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মী মিজানুর রহমান বলেন, এখন অলংকার বিক্রির পরিমাণ খুবই কম। মানুষ আসে, দাম শুনে চলে যায়। দাম বলার পর অনেকের মুখের দিকে তাকালে মনে হয়, আমরা অস্বাভাবিক কিছু বলেছি। আমাদের ব্যবসায় এখন যে কি খারাপ পরিস্থিতি যাচ্ছে বলে বোঝানো যাবে না।
তিনি বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে জুয়েলারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আগে দেখেছি মানুষ হাসিমুখে এসে সোনার অলংকার কিনে নিয়ে যান। এখন যারা কিনতে আসেন, অনেকের মুখে হাসি থাকে না। দেখেই বোঝা যায়, তারা হয়তো বাধ্য হয়ে কারও জন্য অলংকার কিনছেন।
সোনার অলংকারের বর্তমান ব্যবসা পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাজুসের মূল্য নির্ধারণ ও পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি এম এ হান্নান আজাদ জাগো নিউজকে বলেন, সোনার দাম বাড়া-কমার কারণে শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বে ক্রিটিক্যাল অবস্থা। আমাদের বাই ক্যাপাসিটি অনেক কম। ব্যবসায়ীদের অবস্থা খুবই খারাপ।
তিনি বলেন, আমরা সবাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, আমাদের ভবিষ্যৎ কী? এ ব্যবসায় আদৌ আমরা টিকে থাকতে পারবো কি না? এমনও দেখা যায় দুই থেকে চারদিন পর্যন্ত কোনো দোকানে বনি-বাট্টা হয় না (বিক্রি হয় না)। এমনও দোকান মালিক আছেন, তাদের কর্মচারীদের বেতন ঠিকভাবে দিতে কষ্ট হচ্ছে। কর্মচারীর বেতন তো দিতে হবে, সেই বেতন দিতে অনেক কষ্ট হয়।সূত্র : জাগোনিউজ
Development by: webnewsdesign.com