শুক্রবার বলে কি অসুস্থ হতে নেই ?

মঙ্গলবার, ০২ আগস্ট ২০২২ | ১২:২২ অপরাহ্ণ

শুক্রবার বলে কি অসুস্থ হতে নেই ?
apps

হাসান তারিখ (২৭) রাজধানীর পান্থপথ এলাকায় একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) এসেছেন বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে। চিকিৎসকের চেম্বারের সামনে কথা হয় এই ব্যস্ত মানুষের সঙ্গে। কথায় কথায় জানালেন দুঃখের কথা। কর্মজীবী মানুষের জন্য বহির্বিভাগে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ নাকি মোটেও সহজ নয়।

তারিখ বলেন, আমাদের জন্য সরকারি হাসপাতালে বহির্বিভাগের সেবা গ্রহণ অনেকটা যুদ্ধের মতো। কর্মস্থলে ছুটি না পাওয়া গেলে এই সেবা মিলে না। অথচ জরুরি সেবা তো এমন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সীমাবদ্ধ হওয়ার কথা নয়। ওয়ার্কিং ডে’তে আমাদের চিকিৎসা গ্রহণ করা দুরূহ হয়ে ওঠে। কিন্তু শুক্রবার কিংবা ২৪ ঘণ্টা সরকারি হাসপাতালে বহির্বিভাগ চালু থাকলে সাধারণ কর্মজীবী মানুষ সেবাগ্রহণ করতে পারবে। এতে সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা হবে। একই সঙ্গে মধ্যবিত্ত কর্মজীবী মানুষের চিকিৎসাব্যয় কিছুটা হলেও কমেও আসবে।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা জানান, ছুটি সবারই প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের যেহেতু চিকিৎসক কম এবং চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি। এ জন্য শিফটিং পদ্ধতিতে সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগ চালু থাকলে আমাদের সেবাগ্রহণের সুযোগ হয়।

কারণ জরুরি সেবার অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যেমন পুলিশ স্টেশন, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন রোস্টার পদ্ধতিতেই কিন্তু সপ্তাহে সাত দিন সেবা দিয়ে আসছে। বহির্বিভাগের ক্ষেত্রে রোস্টার পদ্ধতি চালু করা সম্ভব হলে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন সহজ হবে।এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগনিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ সময় সংবাদকে বলেন, এটা সত্যি আমরা যদি জনগণকে বেশি করে স্বাস্থ্যসেবা দিতে চাই, তাহলে স্বাস্থ্যসেবার প্রাপ্যতা বাড়াতে হবে। শুধু শুক্রবার নয়, অন্যান্য দিনগুলোর ওয়ার্কিং ডে’তে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আউটডোর খোলা থাকে। যারা কর্মজীবী মানুষ, যারা স্কুলে যায় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ে তারা এই সময়ে আসতে পারছে না। তার মানে আমরা তাদের স্বাস্থ্য সেবার প্রাপ্যতা বন্ধ করে দিচ্ছি। তাকে আসতে হলে ছুটি নিয়ে আসতে হবে।

রোস্টার বা শিফট ডিউটি হলে কারও কাজ বেশি করার প্রয়োজন পড়ছে না। আমরা যদি আউটডোরটাকে ভোর ৬টা থেকে খুলি তাহলে আমরা এটা তিন শিফটে এটা চালাতে পারব। সে ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবার প্র্যাপ্যতা বেড়ে যাবে। যে কোনো মানুষ তার স্বাস্থ্যসেবাটা তার সুবিধাজনক সময়ে নিতে পারবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা এটা চাই কি না?সম্প্রতি রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আউটডোর ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতালের ডিউটি আওয়ার শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন চিকিৎসা নিতে আসা মানুষ। অনেকেই ভোররাত থেকেই সিরিয়ালে দাঁড়িয়েছেন। চিকিৎসাপত্র নেয়ার পর শুরু হয় আরেক ম্যারাথন দৌড়। চিকিৎসক রোগী দেখে চিকিৎসাপত্রে লিখে দেন নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা।

আর এই পরীক্ষা করাতে গেলে ঝক্কি-ঝামেলার শেষ নেই। কিছু কিছু পরীক্ষার সিরিয়ালের জন্য অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘদিন। অনেকেই এই ঝামেলা এড়াতে দ্বারস্থ হন বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। সেখানে একটা একটা পরীক্ষায় খরচ হয় মোটা অঙ্কের টাকা। যাদের সাধ্য নেই তারা এই দীর্ঘ ভোগান্তি পেরিয়ে পরীক্ষা করান।কথা হয় চিকিৎসা নিতে আসা সাদিয়া আফরিনের সঙ্গে। তিনি জানান, তার কিছু মেয়েলি সমস্যা হচ্ছে। এখানে সাতসকালে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে ডাক্তার দেখিয়েছি। ডাক্তার প্রেসক্রিপশনে বেশ কয়েকটি পরীক্ষার কথা লিখেছেন। সেগুলোর কয়েকটার জন্য টাকা জমা দিয়েছি। বাকি দুটি টেস্ট বাইরে থেকে করাব। এখানে করাতে গেলে ১০-১৫ দিন অপেক্ষা করতে হবে। এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার মতো সময় আমার নাই।ঢাকা কলেজের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী নাসরুল্লাহ সঙ্গে কথা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগের সামনে। চিকিৎসা নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় এই শিক্ষার্থী বলেন, সপ্তাহে ৬দিন ক্লাস থাকে। ইচ্ছে থাকলেও বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ হয় না। এ জন্য বাধ্য হয়েই আমাদের প্রাইভেট চেম্বারে চিকিৎসকের দারস্থ হতে হয়।

ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, আমরা এসডিজিতে স্বাক্ষর করেছি, সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করব বলে। সেটা যদি আমরা করতে চাই, তাহলে অবশ্যই স্বাস্থ্যসেবা সস্প্রসারণ করতে হবে। এ জন্য আমাদের আউটডোর, ইনডোর ও ইমার্জেন্সি সব ধরনের সেবাই সম্প্রসারণ করতে হবে। এ জন্য অনেক দেশ সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবায় এগিয়ে গেছে। আমাদের সরকারকে চিন্তা করতে হবে। আমরা যদি এটা যদি আমরা না করি তাহলে কয়েকটি ঘটনা ঘটবে, আমাদের স্বাস্থ্যসেবায় খরচ বেড়ে যাবে। এটা যদি নিশ্চিত না করা যায় তাহলে মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে আরও বঞ্চিত হবে।এদিকে ২০২১ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এক হাজার মানুষের জন্য যেখানে একজন ডাক্তার থাকার কথা। কিন্তু সেখানে দেশে ২৩ হাজার মানুষের জন্য রয়েছে মাত্র একজন ডাক্তার। স্বাস্থ্যসেবা পেতে মানুষকে এমনিতেই সবচেয়ে বেশি ব্যয় করতে হয়। বিশেষায়িত চিকিৎসা পেতে মানুষকে ৬৮ শতাংশেরও বেশি অর্থ ব্যয়। ১২ শতাংশ মানুষ অসুস্থ হলে আনুষ্ঠানিক চিকিৎসা গ্রহণ করেন না।

১৭ শতাংশ নাগরিক সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন আর ৪০ শতাংশকে নির্ভর করতে হয় বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ওপর। ছুটির দিনে বহির্বিভাগ চালু করা সম্ভব হলে ব্যক্তির ব্যয় কিছুটা হলেও সংকোচন করা সম্ভব হবে।জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগনিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক এই পরিচালক বলেন, আমরা একটা নীতিমালা করেছিলাম। সেটা হলো- উপজেলাগুলোতে যত মানুষ আছে, তার ৮০ ভাগ যেন আমরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা পূরণ করতে পারি। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যে চিকিৎসক আছে সেটা দিয়েও এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। তবে এসব জায়গায় আমাদের পরীক্ষাগার বাড়াতে হবে। তাহলেই আমার উপজেলার ৮০ ভাগ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারবো। আমাদের কিন্তু প্রতিনিয়ত কনসাল্টট্যান্ট তৈরি হচ্ছে।

আমরা এতো টাকা খরচ করে কনসালট্যান্ট বানাচ্ছি কিন্তু তাদের আমরা সঠিক ব্যবহার করতে পারছি না। এটা খুবই দুঃখজনক কথা। এখন আমাদের সরকারে এ বিষয়ে পরিষ্কার হওয়া দরকার এ বিষয়ে সদিচ্ছা পোষণ করছে কি না?তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে আমাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী আরও দারিদ্র্যসীমার মধ্যে ঢুকে পড়বে। সুতরাং এগুলো বিবেচনা করে আমাদের উচিত সাপ্তাহিক দিন বলে কথা না, ২৪ ঘণ্টা আউটডোর-ইনডোর-ইমার্জেন্সি খোলা রাখতে হবে। এগুলো শিফট অনুযায়ী চালাতে হবে। সংবিধানে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। যখন অসুস্থতা হবে, তখনই যেন আমি স্বাস্থ্যসেবাটা পাই। এগুলো করতে না পারলে স্বাস্থ্যসেবায় আমরা খুব বেশি আগাতে পারব না। শিফট অনুযায়ী করলে আমাদের এসডিজি বাস্তবায়নে সহায়ক হবে। রোস্টার বা শিফট ডিউটি হলে কারও কাজ বেশি করার প্রয়োজন পড়ছে না। আমরা যদি আউটডোরটাকে ভোর ৬টা থেকে খুলি তাহলে আমরা এটা তিন শিফটে এটা চালাতে পারবো।

সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবার প্র্যাপ্যতা বেড়ে যাবে। যে কোনো মানুষ তার স্বাস্থ্যসেবাটা তার সুবিধাজনক সময়ে নিতে পারবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা এটা চাই কি না? মুখে বা লিখিত বলি স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ বাড়াতে চাই, কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি সংকুচিত করছি।আমরা জুজুর মতো ভয় পাই, আউটিডোর বাড়ালে আমাদের চিকিৎসকদের ডিউটি আওয়ার বেড়ে যাবে। আসলে কিন্তু শিফটিং ডিউটিতে চিকিৎসকদের ডিউটি আওয়ার বাড়ছে না। অনেক দেশ সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবায় এগিয়ে গিয়েছে। এগুলো না করলে আমরা খুব বেশি আগাতে পারব না স্বাস্থ্যসেবায়।ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক সময় সংবাদকে বলেন, আমাদের দেশে এটা একটা ট্রাডিশন। বছরের পর বছর আমরা হাসপাতলের সার্ভিস এভাবে দিয়ে যাচ্ছি। তবে ইমার্জেন্সি সার্ভিস চলমান থাকে। আমি আমাদের ঢাকা মেডিকেলে কলেজের কথা বলতে পারি, এখানে প্রতিদিন এক হাজারের বেশি রোগীকে চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়। সব ধরনের রোগীকে এখানে চিকিৎসা দেয়া হয়। কেউ এসে ফেরত চলে গেছে এমনটা না, সবাইকেই চিকিৎসা সেবা দেয়।

শিফটিং ডিউটির বিষয়ে তিনি বলেন, এটা আসলে নীতিনির্ধারকদের বিষয়। এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। সরকার থেকে আমাদের যে আদেশ আসে, সেটা আমরা পালন করে থাকি।স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, সারা পৃথিবীতে আউটডোর ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে না। কোথাও নাই। ইমার্জেন্সি যেটা সেটা ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে। তবে ইমার্জেন্সিতে সেভাবে কনসালটেন্সি অ্যাভেলেবল নাই। আমরা একটা প্ল্যান করছিলাম ৮টা-৫টা করা যায় কি না। এবং শুক্র-শনি দুদিন ছুটি করে বাকি দিন রোস্টারে চালানো যায় কি না। এ রকম একট নির্দেশনা মন্ত্রী মহোদয় আমাদের দিয়েছিলেন।

আমাদের দেশে চিকিৎসক স্বল্পতার কারণে প্রচলিত নিয়ম ভেঙে শিফটিং ডিউটির মাধ্যমে পুনর্বিন্যাস করা যায় কি না। এ ছাড়াও জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এটাকে নতুন করে ভাবার সুযোগ আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেটা তো অবশ্যই রয়েছে। তবে, কথা হচ্ছে রুটিন সেবা অর্থাৎ আউটডোর সেবা পৃথিবীর কোথাও ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে না। এটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। তবে মন্ত্রী এ বিষয়ে আমাদের টাচ দিয়েছেন। এ বিষয়ে আমার পরিকল্পনা তৈরি করছি। একটা পরিবর্তন আমরা আনতে যাচ্ছি। আমরা সবার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলছি। হুট করে আনলেই এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব না। ধীরে ধীরে এটা বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলেই এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

Development by: webnewsdesign.com