“লাঙলের ফলায় জীবন”

বুধবার, ০৪ আগস্ট ২০২১ | ৩:২৫ অপরাহ্ণ

“লাঙলের ফলায় জীবন”
apps

প্রখর রোদে কপালের ভাঁজে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। দু’হাতের শিড়া-উপশিড়াগুলো চামরার উপর জেগে উঠেছে। কুঠার আর হাতুড়ী চালাতে চালাতে হাতের পাঞ্জা লৌহসম শক্ত হয়ে আছে। কথা বলতে গেলেই আলতো হাসিতে হলদে আবারণের দাঁতগুলো বেড়িয়ে আসছে। গায়ে ছেঁড়া গেঞ্জি আর পড়নে ময়লাটে লুঙ্গি।

পায়ের আঙ্গুলগুলো ফাঁকা হয়ে একি ওদিক ছড়িয়ে পড়ছে। তবুও গৌড়বদীপ্ত হয়ে মানব সভ্যতার ঐতিহ্য রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে এই শ্রমিকরা। এরা হলো লাঙল তৈরীর শ্রমিক।

জমি চাষের জন্য এক সময় দেশে লাঙল ছিল কৃষকের অন্যতম হাতিয়ার। বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত লাঙলের চাহিদা থাকে তুঙে। ভোলা অঞ্চলের লাঙলের শ্রমিক ছাড়াও বাউফলের বগা এবং নওমালা ইউনিয়নের কিছু পরিবার এই কাজ করছেন। এক সময় দিন-রাত জেগে লাঙল তৈরীর কাজ করতে হতো শ্রমিকদের।

লাঙলের এতটাই চাহিদা ছিল যে, শ্রমিকরা যথাসময়ে খাওয়ারও সময় পেতেন না। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বৃহত্তম বাউফলের কালাইয়া বাজারই ছিল লাঙল বিক্রির অন্যতম স্থান। তখনকার সময়ে প্রতিটি লাঙল কাঠভেদে ফলাসহ বিক্রি হতো ৪০ থেকে ৭০ টাকায়। লাঙলের জন্য স্থানীয় ক্যাজা, সুন্দরী এবং কড়াই গাছের গুঁড়ি ব্যবহার করা হয়।

স্বল্প পূঁজির এই কাজে বেশ স্বাচ্ছন্দেই তাদের পরিবার-পরিজনসহ জীবনযাত্রা পরিচালনা করতে পাড়তেন। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে কৃষি কাজে আধুনিকতার ছাপ পড়ায় লাঙল এখন মিউজিয়ামের শো-রুমে স্থান পাচ্ছে। লাঙলের পরিবর্তে এখন জমি চাষ করা হচ্ছে ট্রাকটরসহ অন্যান্য যন্ত্র দিয়ে।

কিন্তু এরপরেও হাতে গোনা কিছু কৃষক এখনো লাঙলের উপরই নির্ভরশীল রয়েছেন। এখন প্রতিটি লাঙল ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে ক্যাজা কিংবা সুন্দরী কাঠ এখন পাওয়া যায় না বিধায় কড়াই কাঠ দিয়েই লাঙল তৈরী করা হচ্ছে। কিছু কৃষক জানান, কলের লাঙল দিয়ে চাষ করলে মাটি ঠিকভাবে কর্ষণ হয় না।

লাঙল দিয়ে চাষ করলে মাটি ঠিকভাবে কর্ষণ করা যায়। ফসল এবং ফলন ভাল হয়। শুধু পরিশ্রম একটু বেশি। একারণেই পূরোণো কিছু গৃহস্থ্য এখনো রাঙল দিয়েই চাষাবাদ করছেন।

প্রতিবছরই বৈশাখ মাস থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত লাঙল তৈরী করে কৃষকের কাছে বিক্রি করতে বাউফলের কালাইয়া হাটে আসেন। বছরের বাকি সময়টাতে তেমন একটা দেখা যায়না।

আধুনিক সভ্যতার কঠিন বাস্তবতায় স্ত্রী-পুত্র-পরিজনের মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দিতে বংশ পরম্পরায় এই শ্রমিকরা শক্ত গাছের গুঁড়িতে কুঠার আর হাতুড়ী চালিয়ে লাঙল তৈরী করে হাটে হাটে বিক্রি করে যাচ্ছেন।

ভোলা জেলার লালমোহন উপজেলা থেকে ষাটোর্ধ আবুল হোসেন নামের এক শ্রমিক লাঙল তৈরী করে বিক্রির জন্য খন্ড খন্ড গাছের গুঁড়ি নিয়ে প্রতি সোমবার বাউফলের কালাইয়া বাজারে হাজির হন। একই সাথে বাউফল ও পার্শ্ববর্তী উপজেলা থেকেও লাঙলের শ্রমিকরা কালাইয়া বাজারে আসেন।

তবে আগের তুলনায় এখন মাত্র দু-চারজন ছাড়া লাঙল শ্রমিকদের তেমন দেখা যায়না। কথা বলে জানা গেছে, লাঙল তৈরীর এই শ্রমিকরা অর্থনৈতিকভাবে এখন আর ভাল নেই। আধুনিক যন্ত্রের সাথে প্রতিযোগিতায় তারা টিকতে পারছেননা। বিকল্প কোন কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করতে পারেননি তারা।

যার কারণে “দিন আনে দিন খায়” অবস্থায় তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে বেচে রয়েছেন। বংশ পরম্পরায় এই কাজই করতে গিয়ে অন্য কোন কাজে পারদর্শী হতে না পাড়ায় টানাপোরণের মধ্য দিয়েই তাদের সংসার চলছে।

ভোলা জেলার লালমোহনের লাঙল শ্রমিক ষাটোর্ধ বয়সী আবুল হোসেন বলেন, “বাবা কিতা আর কইতাম, এহোন আর পারি না, সংসার চালাইত এই বয়সে এহোনো কালোইয়া আডে আই, গরে খাওন নাই, কিতা করমু, লাঙল আর চৈলে না” তয় লাঙলের ফলায়ইতো জীবনডা চালাইতাম” বৃদ্ধ ওই শ্রমিকের কথায় বোঝা গেল, তাদের পরিবার অর্থকষ্টে রয়েছে।

আর্থিক কষ্টে রয়েছেন এই পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট বাউফলে লাঙল শ্রমিকরাও। সরকারের নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচীর মধ্যে এরা রয়েছেন কি না সেটা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে এদের মুখের অবয়ব বলে দিচ্ছে এরা দারিদ্রতাকে সাথী করেই হয়তো কোন বেলা খেয়ে আর কোন বেলা না খেয়েই বেচে রয়েছেন।

কালাইয়া ইসলামিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তুষার কান্তি ঘোষ বলেন, আমরা কৃষকের ছেলে। শিক্ষা-দীক্ষা নিয়ে এখন চাকুরী করছি। তবে লাঙল আমরাও বইছি। এই পেশার সাথে সংশ্লিষ্টদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়া দরকার। এই লাঙল আমাদের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। বাঙালি জাতির কৃষ্টি।

Development by: webnewsdesign.com