কুয়শাঘেরা সকাল মনে হয় শ্বেত হিমালয়। পিচঢালা সরু পথের দু-ধারে সারি সারি খেজুর গাছে ঝুলানো রসের হাঁড়ি সত্যিই চমৎকার দেখায়। জিবের জল জানান দেয় খাওয়ার আগ্রহ। গ্রামগঞ্জের চিরচেনা রীতি অনুযায়ী ঘরে ঘরে খেজুর রস দিয়ে শুরু হয় পৌষ-পার্বণের রকমারি পিঠার আয়োজন। মূলত হেমন্তের নতুন ধান ঘরে আসার পরপরই গ্রামগঞ্জে শুরু হয় পিঠাপুলির এ মহোৎসব।
চলে শীতের শেষ সময় পর্যন্ত। এ যেন মহান আল্লাহ তায়ালার অনন্য নেয়ামত। তাঁর হুকুমে আসমান থেকে বর্ষিত পানি দ্বারা উৎপাদিত হয় আতপ চাল। অন্যদিকে খেজুর গাছ থেকে সংগ্রহ করা হয় সুমিষ্ট রস। গ্রামের বৌ-ঝিরা আতপ চাল গুঁড়া করে খেজুর রস দিয়ে তৈরি করেন নানা ধরনের পিঠা। সে পিঠা খেয়ে তৃপ্ত হয় মন।
নাজমা বেগম উপজেলার নগরপাড়া বাজারে হরেক রকমের পিঠা বিক্রি করেন। চিতই, ভাপা, চাপটি, রুটিসহ আরো অনেক রকমের মজাদার খাবার তৈরি করেন তিনি। স্বামী মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর হল। অভাবের সংসার। ছোট ছোট ছেলেদেও নিয়ে সংসারের হাল ধওে নামজা বেগম। বিভিন্ন ধরনের পিঠার সাথে রয়েছে হরেক রকমের ভর্তা। আরো আছে শীতের সুস্বাধু মজাদার হাঁসের মাংস।বিকেল হলেই শুরু হয় নাজমা বেগমের পিঠা বিক্রি নিয়ে জীবন সংগ্রাম।
তিনি বলেন, এখন আল্লাহর রহমতে ভালই আছি। বেচা বিক্রিও ভাল। অনেক দুর দুরান্ত থেকে মানুষ আসে। কেউ ভর্তা আবার কেউ হাসের মাংস দিয়ে মজা কওে বিভিন্ন ধরনের পিঠা খাচ্ছে। আমার জীবন সংসার চলে যাচ্ছে।
শুধু নাজমা বেগম নয়। এমন শত শত নাজমা বেগমদেও জীবন জীবিকার অবলম্বন এখন শীতের পিঠা। কয়েক শতাধিক পিঠার দোকান রয়েছে রূপগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায়।
আরো একজন জীবন সংগ্রামী বুলু বেগম। নগরপাড়া বাজারেই জীবন যুদ্ধে বেচে থাকার লড়াই কওে যাচ্ছেন স্বামীকে সাথে নিয়ে। ফুচকা, চটপটিও তৈরি করেন এখানে। বুলু বেগম বলেন, ছোট্ট বেলায় শখের বশে মায়ের সাথে পিঠা বানিয়েছিলাম। আর এখন পেশা হিসেবে নিয়েছি। ভালই চলছিল পিঠার দোকান। মাঝপথে করোনার কারণে বেচাবিক্রি কমে গেছে।
তিনি আরো বলেন, এখানে শুধু পিঠাই বানাই না। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য শীতের পিঠাপুলিকে বাঁচিয়ে রেখেছি। আমার পিঠাঘরের পিঠা স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশে তৈরি করা হয়। ফুলপাতের পিঠার সাথে আমার তৈরি পিঠার বিরাট তফাৎ রয়েছে। বুলু বেগম ছাড়াও রূপগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে ফুটপাতে আড়াই শতাধিক মৌসুমী পিঠা তৈরির কারিগররা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। প্রকৃতিতে বইছে শীতের সমীরণ।
পিঠার অন্যতম উপাদান চালের গুঁড়া হলেও এর সঙ্গে লাগে গুড়, চিনি, নারকেল, ক্ষীরসহ নানা উপকরণ। সকালবেলা বাড়িতে বাড়িতে খেজুরের রসে ভেজানো পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে। এ সময় গ্রামে বেড়াতে আসেন শহুরে স্বজনরা। জামাই-ঝি, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশী সবাই মিলে পিঠা খাওয়ার আসরটা জমজমাট হয়ে ওঠে। হাসি-আনন্দে প্রাণবন্ত হয় চারপাশের পরিবেশ।
রূপগঞ্জের রাস্তাঘাটে, অলিগলিতে, ফুটপাতে পিঠাওয়ালীদের তৈরি পিঠা রূপগঞ্জের মানুষের সকাল-বিকালের নাস্তার অংশ। এসব পিঠাওয়ালীর দেখা মিলে উপজেলার বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে,নদীর ঘাটে,বাজারে, অলিগলির ফুটপাতে। তাদের কাছে ভাপাপিঠা, দুধ চিতই, পুলিপিঠা, পাটিসাপটাসহ নানা ধরনের পিঠা থাকে। পাড়া-মহল্লাতে গুলগুলা নামের জনপ্রিয় পিঠাটি এখন খুব কম দেখা যায়, যা নাস্তার সঙ্গে গরম গরম খাওয়া হতো।
রূপগঞ্জের মানুষের কাছে অনেক জনপ্রিয় পিঠা হল দুধকলি, ক্ষীরসা, তালের পিঠা, ডিমপোয়া, খেজুরপিঠা, চুইপিঠা, পুলি, ছিটাপিঠা, পাটিসাপটা ইত্যাদি। এর মধ্যে অনেক ধরনের পিঠা এখনও সমানভাবে প্রচলিত আছে। পিঠা তৈরিতে প্রধান উপাদান চালের গুঁড়া, নানা ধরনের গুড়, নারিকেল, দুধ, মালাই, ক্ষীরসা, বাদাম, পেস্তা, কিশমিশ ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।
সরজমিন ঘুরে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার রাস্তায় পিঠাওয়ালীদের চিতই পিঠা এবং ভাপা পিঠা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। শীতে সবার কাছে চিতই পিঠার কদর আবার একটু বেশিই বলা চলে। কারণ চিতই পিঠা নানা রকমের ভর্তার সঙ্গে মাখিয়ে খাওয়ার মজাই আলাদা। এসব ভর্তার মধ্যে রয়েছে শুঁটকি, ধনেপাতা, ডালভর্তা, সরিষা ভর্তা ইত্যাদি। এই পিঠাটি সবকিছুর সঙ্গে খাওয়া যায়। অনেকেই ভাপা পিঠার মধ্যে ইলিশ মাছের টুকরা দিয়ে পিঠা বানান। রূপগঞ্জের গ্রামাঞ্চলে ডিমচিতই পিঠা বেশ জনপ্রিয়। কলিজা ভুনা, ঝাল মাংস, বুটের ডালের সঙ্গে চিতই পিঠার জুড়ি নেই। রূপগঞ্জের দুধে-খেজুরের গুড়ের সঙ্গে ভেজানো দুধ চিতই পিঠা ছিল খুবই জনপ্রিয়।
পিঠা বিক্রির জন্য দোকানিরা বিকাল সময়টাকেই বেছে নেন। তাই শীতের সময়ে বিকাল হলেই রূপগঞ্জের রাস্তায় আর মোড়ে ভাপা পিঠা বিক্রির ধুম পড়ে যায়। গরম গরম পিঠা ধোঁয়া ওঠা চুলা থেকে নামিয়েই ক্রেতার হাতে তুলে দেন দোকানি। এই পিঠাটি মোগল আমল থেকেই জনপ্রিয়। তবে তখন এটি ছিল আরও ভিন্ন। মোগল আমলে ভাপা পিঠাতে সুগন্ধি গুড়, মালাই, জাফরান, পেস্তা, কিশমিশসহ নানা উপকরণ ব্যবহার করা হতো।
শীতের আরেকটি প্রিয় পিঠার নাম পাটিসাপটা। গ্রামের মানুষের পছন্দের পিঠা এটি। বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠানে এই পিঠা দিয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয়। রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া, গঙ্গানগর, পূর্বগ্রাম, বড়ালু, পাড়াগাও, নগরপাড়া, কামশাইর, দক্ষিণবাঘ, বাঘবের, রূপসী, তারাব বাজারসহ অনেক জায়গাতেই বিকাল হলেই বিভিন্ন ধরনের পিঠা বানাতে দেখা যায়।
একটা সময়ে পিঠা ছিল বাংলার ঐতিহ্য। সময়ের সঙ্গে সেই ঐতিহ্য অনেকটাই হারিয়ে গেছে। কিন্তু শীত এলেই রাস্তায়, পাড়া-মহল্লায় পিঠা বিক্রির ধুম পড়ে যায়। ফুটপাতে বসা দোকানগুলো স্মরণ করিয়ে দেয় পুরনো সেই ঐতিহ্যের কথা।
Development by: webnewsdesign.com