দেশে টানা লকডাউনে এবার মাথায় হাত পড়েছে রাজশাহী অঞ্চলের আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের। বাজারে এখন বিক্রি হওয়া ফজলি আমের যেন ক্রেতা খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। আবার এই সময়ের সর্বোচ্চ আকর্শণীয় আমপ্রপালিরও চাহিদা কম। ল্যাংড়া বিক্রি হচ্ছে পানির দামে।
রাজশাহীতে ভ্যান চালকরা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে প্রতিকেজি আম বিক্রি করছেন ১০-২০ টাকা কেজি দরে। যার আমের ইতিহাসে সর্বনিম্ন দামে বিক্রি হচ্ছে এবার-এমনটিই বলেছেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
তাঁরা এও বলছেন, আমের এমন দরপতন কখনো দেখেননি তাঁরা।এর আগে কখনোই আমের শেষ সময়ে এসে দাম কমেনি। বরং দিনের পর দিন দাম বেড়েছে। প্রতিটি জাতের আমের শেষদিকে গিয়ে সেটি আকাশচুম্বি হয়েছে। ফজলি, গোপাল ভোগ, ল্যাংড়া, হিমসাগর থেকে শুরু করে নানা জাতের আমগুলোর দাম শেষদিকে গিয়ে ৪-৫ হাজার টাকা মণ পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে রাজশাহী অঞ্চলেই। কিন্তু এবার কোনো আমই আড়াই হাজার টাকাই ক্রস করতে পারেনি এখন পর্যন্ত।
এমনকি হিমসাগর, গোপাল ভোগ শেষ হয়েছে দুই হাজার থেকে সর্বোচ্চ পঁচিশ টাকা দামের মধ্যেই। শেষ দিকে গোপাল ভোগ, ল্যাংড়া, হিমসাগরের দাম উল্টো কমেছে। মোটা দাগে রাজশাহীর আমের চিত্র এটি। আর ভিতরের চিত্র আরও খারাপ। বিশেষ করে যারা আমচাষি এবং যারা আগেই বাগান চুক্তিতে কিনে রেখেছিলেন তাদের যেন মাথায় হাত পড়েছে এবার। যারা এক লাখ টাকায় বাগান কিনে রেখেছেন তাদের অন্তত ৫০ হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে। ফলে বছরের এই সময়ে আম কেনা-বেচা করে যারা কিচু টাকা ঘরে তুলে সারা বছর সংসার চালানোর স্বপ্ন দেখেন তাঁরা এখন ঋণ-দেনায় জড়িয়ে পড়েছেন।
রাজশাহীর পবা সিলিন্দা এলাকার মো: জামাল উদ্দিন বলেন, ‘যে বাগানের দাম কিছুদিন আগেও এক লাখ টাকা বলে গেছেন ব্যবসায়ীরা। এখন সেটি যেন কেনারও কোনো লোক নাই। বাগান থেকে আম পেড়ে বাজারে গিয়ে বিক্রি করলে সর্বোচ্চ হয়তো ৭৫ হাজার টাকার আম বিক্রি হবে। কিন্তু তাতে খরচ হবে আরও প্রায় ২৫ হাজার টাকা। ফলে এক লাখ টাকার বাগানে এখন আম বিক্রি করে একজন চাষির পকেটে ঢুকছে বা আসবে সাকূল্যে ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু এই বাগান পরিচর্যা এবং সারা বছর জমি ফেলে রেখে আমচাষ না করে এর চেয়েও বেশি টাকার ফসলই উৎপাদন সম্ভব।’
এদিকে গতকাল রাজশাহীর বানেশ্বর বাজারে এক মণ ফজলি আম বিক্রি হয়েছে ৪০০-৫৫০ টাকা দরে। আমের ইতিহাসে রাজশাহীতে এটিই সর্বনিম্ন দামে ফজলি বিক্রি হচ্ছে। এর আগে কখনোই ৮০০ টাকার নিচে ফজলি আম বিক্রি হয়নি। কিন্তু এবার অর্ধেকেরও কম দামে বিক্রি হচ্ছে সেই আম। অন্যদিকে ল্যাংড়া আমও সর্বোচ্চ কাম দামে বিক্রি হতে দেখা গেছে এবার। শুরুতেই এ আম বিক্রি হয়েছে ৯০০ টাকা মণ দরেও। এখনো ৯০০-১২০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে ল্যাংড়া জাতের আম। অন্যদিকে আম্রপালি বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ দেড় হাজার টাকা দরে।
বাজারের আম বিক্রি করতে যাওয়া দিলশাদ আলী বলেন, ‘আম্রপালি বাজারে আসছে এখন ব্যাপক হারে।এ কারণে অন্যান্য জাতের আমের দাম কমেছে। কিন্তু এর আগে কখনোই এই অবস্থা হয়নি। আম্রপালি বাজারে এলেও শেষের দিকে থাকা খিরসাপাত বা ল্যাংড়ার বাজার ছিল অন্তত ৪-৩ হাজার টাকা মণ। আবার অন্যান্য বছরের এই সময়ে যেখানে আম্রপালি বিক্রি হয়েছে ২৫০০-৩০০০ টাকা দরে, সেখানে এবার বিক্রি হচ্ছে অর্ধেম দামে।’
আমাচষি মকবুল হোসেন বলেন, অন্যানবার এই সময়ে বাজারে এলে আমের ঝুড়ি বা ক্যারেট নিয়ে টানা ব্যবসায়ীরা টানাটানি শুরু করতেন। এবার বসে থেকেও ত্রেতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আর ফজলি আমের তো ক্রেতা নাই বললেই চলে। কোনো মতে বিক্রি করে বাড়ি যেতে পারলেই যেন নিঃশ্বাস ফেলা যাচ্ছে। তারপরও ১০ হাজার টাকার আম বিক্রি করে বড় জোর পকেটে থাকছে ৬ হাজার টাকা। কারণ দাম কম হওয়ার কারণে বেশি আম গাছ থেকে পাড়তে ও যানবাহন খরচ বেশি হচ্ছে। ফলে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়েছে এবার। এতে করে আমচাষিদের লোকসান গুনতে হচ্ছে।’
আম ব্যবসায়ী মনিরুল ইসলাম বলেন,‘বাজারে প্রায় শেষ হতে যাওয়া হিম সাগর এখনো বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা মণ দরে। অথচ অন্যান্য বার এই সময়ে হিম সাগর বা খিরসাপাতা বিক্রি হয়েছে অন্তত ৪ হাজার টাকা মণ দরে। মাঝে কিছুদিন এ আম আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত দাম উঠেছিল। কিন্তু সেটি আবার কমে যায়। আমের এমন অবস্থা কখনোই হয়নি। এবার একের পর এক লকডাউন এবং করোনা আতঙ্কে আমের এমন দাম কমেছে। ফলে আমরা যারা ব্যবসায়ী তারা বড় ধরনের ক্ষতিরমুখে পড়েছি। বলা যায় এবার মাঝারি ধরনের ব্যবসায়ীরা অন্তত তিন লাখ টাকা করে লোকসান গুনবে। অথচ বছরের এই সময়ে আমরা তিন-চার লাখ টাকা লাভ করে সারা বছরের আয়ের কথা ভেবে থাকি। কিন্তু এবার লোকসানের কারণে উল্টো ঋণ-দেনায় জড়িয়ে পড়তে হবে।’
অপরদিকে রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের দেওয়া তথ্য মতে, এ জেলায় হেক্টর প্রতি গড়ে ১৫ দশমিক ৫৮ মেট্রিক টন হারে আম উৎপাদন হয়। কিন্তু এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় তার চেয়েও বেশি আম উৎপাদন হবে। এবার জেলায় ১৭ হাজার ৯৪৩ হেক্টর জমিতে আমচাষ হয়েছে। সেই হিসেবে ধরা হচ্ছে এবার রাজশাহীতেই অন্তত দুই লাখ ৪৩ হাজার ৪৮৩ মেট্রিক টন আমের উৎপাদন হবে।
Development by: webnewsdesign.com