মুক্তমত : ধর্ষিতা নারী বাকি জীবনও ‘ধর্ষণ’র শিকার হয়

বৃহস্পতিবার, ০৯ জানুয়ারি ২০২০ | ৬:০০ অপরাহ্ণ

মুক্তমত : ধর্ষিতা নারী বাকি জীবনও ‘ধর্ষণ’র শিকার হয়
apps

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষক মজনুকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। তাকে মাদকাসক্ত এবং ‘সিরিয়াল রেপিস্ট’ হিসেবে অভিহিত করেছেন তারা। গ্রেপ্তারের পরও বিচার নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। কারণ, বাংলাদেশে ধর্ষণের মামলায় শেষ পর্যন্ত মাত্র শতকরা তিনভাগ ঘটনায় অপরাধী শাস্তি পায়।

ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় শাস্তি পায় মাত্র শূন্য দশমিক তিন ভাগ অপরাধী। এই পরিস্থিতিতে ২০১৯ সালে ধর্ষণ বেড়েছে দ্বিগুণ। অন্যদিকে ধর্ষণের শিকার শতভাগ নারীকেই পরবর্তী জীবনে ভুক্তভোগী হয়েই বেঁচে থাকতে হয়।
ধর্ষণের শিকার নারী ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা। তিনি ধর্ষণের বিচার ও তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে দুটি উদাহরণ দেন।

১. ভিকারুননিসা স্কুলের ছাত্রী ধর্ষণের বিচারের সময় অভিযুক্ত শিক্ষক পরিমল জয়ধরের পক্ষে ৬-৭ জন অ্যাডভোকেট ছিলেন। তারা আদালতে প্রচণ্ড হইচই করে মেয়েটির শারীরিক গঠন নিয়ে আদালতকে বলছিলেন। তার শরীরের বর্ণনা দিচ্ছিলেন। তারা প্রমাণের চেষ্টা করছিলেন, পরিমলের যা শারীরিক গঠন তাতে ওই মেয়ের সম্মতি ছাড়া কিছু হয়নি।
২. টাঙ্গাইলের এক নারী তার দেবরের হাতে ধর্ষণের শিকার হন। তার স্বামী প্রবাসী। ঘটনার সময়ও তিনি প্রবাসে ছিলেন। ধর্ষণের পর ওই নারীকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টাও করা হয়। মামলা আদালতে ওঠার পর তার স্বামী তাকে তালাক দেন। আর আদালতে বলেন, তার স্ত্রী দুশ্চরিত্রা।
ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা বলেন, তদন্ত, বিচার প্রক্রিয়া এবং আইনের মধ্যেই অনেক উপাদান ও ফাঁক আছে যা ধর্ষণের শিকার নারীর জীবন দুর্বিষহ করে তোলে৷

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ১৬ বছরের বেশি বয়সী কোনো নারীর সম্পত্তি ছাড়া অথবা ভয়ভীতি, প্রতারণা বা প্রলোভন দেখিয়ে যৌন সহিংসতা করলেই তা ধর্ষণ। আর ১৬ বছরের নীচে হলে সম্মতিতে হলেও তা ধর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হবে। ধর্ষণের পর যেকোনভাবেই মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
এই আইনের তেমন কোনো সমালোচনা নেই। সমালোচনা আছে তদন্ত, সাক্ষ্য আইন ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে। সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারায় ধর্ষণের শিকার নারীকে আদালতে ‘সতীত্বের’ পরীক্ষা দিতে হয়। আর এর সুযোগ নেয় ধর্ষকের আইনজীবীরা।

ফাতেমা সুলাতানা শুভ্রা জানান, ভিকটিমের শারীরিক আলামত সংগ্রহের নামে যে ডাক্তারি পরীক্ষা হয় তাও ভয়াবহ। আমি গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি, ওয়ার্ড বয়দের মাধ্যমে এই পরীক্ষার সময় অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। আর এই পরীক্ষায় শরীরের অনেক স্পর্শকাতর অঙ্গের মাপ উল্লেখ করা হয়, যা ধর্ষকের পক্ষে যায়। যেমন স্তনের আকার যদি বড় হয় তাহলে নারীকে ‘হ্যাবিচুয়েটেড’ প্রমাণের চেষ্টা চলে৷
তিনি বলেন, একটি উদাহরণ দেই৷ কোনো নারী যদি বৃহস্পতিবার রাতে থানায় রিপোর্ট করেন তাহলে তার পরীক্ষা হবে রবিবার। ৪৮ ঘণ্টা পার হওয়ার পর তো আর আলামত তেমন পাওয়া যায় না।

মানবাধিকারকর্মী এবং মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খানও ধর্ষণের শিকার নারীদের আইনি সহায়তা দিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। তিনি বলেন, আইন কঠোর থাকলেও সাক্ষ্য আইনে অনেক সমস্যা আছে। ট্রাইব্যুনালে ১৮০ দিনে বিচার শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বছরের পর বছর ঝুলে থাকে। এই দীর্ঘ সময় ধর্ষণের শিকার নারী বিচার চাইতে গিয়ে পদে পদে ধর্ষণের শিকার হন। তিনি যখন প্রথম থানায় অভিযোগ করেন, তখনই তাকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। মামলা নেয়ার আগেই নানা প্রশ্নে তাকে বিপর্যস্ত করা হয়।
তিনি বলেন, ভিকটিমের সাক্ষ্য গোপন কক্ষে নেয়ার বিধান থাকলেও তা কার্যকর নেই। আর এখন নারী ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষার কথা বলা হলেও বাস্তবে সেটা সবখানে হচ্ছে না।

তিনি জানান, বিচার না পাওয়ায় যেটা হয়, অপরাধী ধর্ষণের শিকার নারীর সামনেই ঘুরে বেড়ায়। এটা শুধু তার জীবনকেই দুর্বিষহ করে না, তার পরিবারের সদস্যদেরও বিপর্যস্ত করে। সে গৃহবন্দি হয়ে পড়ে অথবা এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। বিচার না হওয়ায় আরো একটি সংকট হয়, ওই নারীকে মিথ্যাবাদী অ্যাখ্যা দেয়া হয়। তাকে অসৎ চরিত্রের তকমা দেয়া হয়।
তাঁর মতে, ধর্ষণকে নারীর কলঙ্কের ঘটনা হিসেবে দেখা বন্ধ না হলে এ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। এটাকে যৌন সহিংসতা হিসেবে দেখতে হবে। ধর্ষণের শিকার নারীকে ট্রমা থেকে বের করে আনতে হলে তাকেও ভাবতে হবে এটা সহিংসতা। কাউকে শারীরিকভাবে আঘাত করলে তিনি যেমন এটাকে সহিংসতা হিসেবে দেখেন, সেভাবে সহিংসতা হিসেবে দেখতে হবে। নিজের কলঙ্ক বা সব শেষ হয়ে গেছে সেই চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন এলিনা খান।
ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা বলেন, আমাকে ভাবতে হবে শরীর আমার তীর্থ নয়। তাহলে ধর্ষণের বিচার নিয়ে নারী আরো শক্ত অবস্থানে যেতে পারবেন। সমাজ ধর্ষণের কথা গোপন করতে বলে, আলামত গোপন করতে বলে। আর বিচারের সময় ধর্ষণের অনুপুঙ্খ বর্ণনা চায়। এটা সমাজের একটা খেলা, যা ধর্ষককে রক্ষায় কাজ করে।

আর মনোচিকিৎসক ডা. মেখলা সরকার বলেন, ধর্ষণ একজন নারীর জীবনে ইনজাস্টিস (অবিচার)। বিচার না পাওয়া আরো একটা ইনজাস্টিস। তাই এর জন্য ভিকটিমকেই ট্রমা থেকে বেরিয়ে এসে স্বাভাবিক জীবনযাপনের শক্তি অর্জন করতে হবে। সামাজিক বা পারিপার্শ্বিক সহায়তা থাকলে এটা তার জন্য সহজ হবে। কিন্তু মূল শক্তি ভিকটিমের মানসিক শক্তি।

Development by: webnewsdesign.com