মাধবপুরে হারিয়ে গেছে আশির দশকের সেই অডিও ক্যাসেট এর কথা

সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ৩:৫০ অপরাহ্ণ

মাধবপুরে হারিয়ে গেছে আশির দশকের সেই অডিও ক্যাসেট এর কথা
apps

হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার আশির দশকের শেষের দিকে মাধবপুর ক্যাসেট পট্টি নামে একটি গলি পরিচিত ছিল। এ গলি দিয়ে হাটলেই বুঝা যেত শুধু অডিও সাউন্ড ও রেকর্ডের কথা। আশির দশকের মাঝামাঝি ও নব্বই দশকের শুরুতে বাংলাদেশের তারুণ্যের মাঝে ছিল দারুণ এক উত্তেজনা। অভাবনীয় উন্মাদনা। আর সে সময়টাকে অভিহিত করা যায় ক্যাসেট যুগ। মিউজিকের যুগ। ব্যান্ড এর যুগ হিসেবে। প্রায় পুরো তরুণ সমাজের চিন্তা জগতকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল ব্যান্ড মিউজিক। অল্প সময়ের মধ্যে শহর থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে ব্যান্ড মিউজিক। গীটারের টুং টাং ধ্বনিতে মোহিত হত সে সময়ের তারুণ্য। গায়ে হলুদ, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন বরণ, সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ব্যান্ড মিউজিক ছাড়া কল্পনাই করা যেত না। পাড়া মহল্লার তরুণরা গড়ে তুলেছে ব্যান্ড। বের হয় অডিও ক্যাসেট। ঝাঁকে ঝাঁকে তরুণরা ছুটেছে ব্যান্ড মিউজিকের পেছনে। বিনোদনের অনুসঙ্গ হয়ে ওঠে ক্যাসেট ও ব্যান্ড মিউজিক। সময়টা ছিল সৃজনশীল এবং একই সঙ্গে ভাল কিছু করার প্রত্যাশা। এ পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজারের মত অডিও ক্যাসেট বের হয়েছে বাংলাদেশের ক্যাসেট যুগে।

এর মধ্যে আধুনিক, রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সংগীত, পল্লীগীতি, কবিতা, ব্যান্ড ও সলো শিল্পীদের ক্যাসেট ছিল। কিন্তু চাহিদা ছিল সবচেয়ে বেশি ব্যান্ডের ক্যাসেটের। ব্যান্ডের জনপ্রিয়তার কারণে এক সময় সলো ক্যাসেট করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। অনেক সলো আর্টিস্ট জনপ্রিয়তা পাবার আশায় নামমাত্র একটা ব্যান্ড গঠন করে ক্যাসেট রিলিজ ও টিভিতে গান গেয়েছেন। ভালভাবে ইনস্ট্রুমেন্ট বাজাতে পারতো না এমন তরুণেরাও প্রফেশনাল মিউজিসিয়ানদের সাহায্য নিয়ে ব্যান্ডের ক্যাসেট বের করেছে ব্যান্ড মিউজিককে ভালোবেসে। একের পর এক ব্যান্ডের ক্যাসেট আসতে থাকে বাজারে। ভালো গানের সঙ্গে অনেক খারাপ গানও ঢুকে পরে। এত এত হিট গানের মাঝে হারিয়ে যায় অনেক ভালো ব্যান্ডের গান ও ব্যান্ড। লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায় তারা নানা কারণে।

 

প্রচারের অভাবও ছিল অনেক ক্ষেত্রে। সেই সব সুরেলা ক্লাসিক গান আজ অনেক বছর পর ইউটিউবে। কোথায় হারিয়ে গেল সেই ব্যান্ডগুলো। বাংলা ব্যান্ডের সেই দিনগুলো কই? এমন গানের কথা মিউজিক সুর কি আর আসবে? আহা কি সুর..কি লিরিক.. অনেক শুনেছি তারপরও বারবার শুনতে মন চায়। এ ধরনের ব্যান্ড বাংলাদেশে আর কখনো হবে না। ’৯০ দশকের মত হৃদয় ছোঁয়া গান আজ আর শুনিনা। যাকে বলে এভারগ্রীন। সে সময় এমন কিছু ব্যান্ড ছিল যাদের নাম অনেকেই জানেন না। তেমনি একটি ব্যান্ড ওয়েভস। বাংলাদেশের প্রথম হ্যাভিমেটাল ব্যান্ড। জার্মানীতে ১৯৮১ সালে ইফতেখার, মাহামুদ ও মিঠু তিন বন্ধু মিলে গড়ে তুলেন ওয়েভস। ১৯৮৩ সালে মিউজিক করার জন্য বাংলাদেশে আসে ওয়েভস। তাদের সঙ্গে যোগ দেন সুইডেন থেকে মিনু ও জার্মানী থেকে কামাল। মিনু বাংলাদেশের প্রথম মেটাল নারী ব্যান্ড মেম্বার। বিদেশ থেকে তারা সব আধুনিক যন্ত্র নিয়ে আসে ঢাকায়।

ওয়েভস রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। স্রোতাদের আগ্রহ বাড়তে থাকে মেটাল গানের প্রতি। মিনু ও মিঠু ব্যান্ড ছেড়ে বিদেশে চলে গেলে তাদের পরিবর্তে ভোকাল হিসেবে যোগদান করেন মাকসুদুল হক (ফিডব্যাক) ড্রামে মিল্টন ও গিটারে নটু। ওয়েভসের ভিন্ন ধারার গান সে সময়ে সুধী মহলে সমালোচিত হয়। নোংরা রাজনীতির কারণে ওয়েভস দেশ ছেড়ে চলে যায়। ১৯৯৬ সালে ১০ বছর পর তাদের প্রথম এ্যালবাম বাজারে আসে। ওয়েভ্সের কিছু গান ইউটিউবে দেয়া আছে (You Tube- Iftekhar sikder). আশির দশকের আরও একটি ব্যান্ড উইন্ডস। সংগীত পরিচালক মরহুম আলী আকবর রুপু এ ব্যান্ডের সদস্য ছিলেন। তিনি কী-বোর্ড বাজাতেন। গায়ক আতিক হেলাল (বর্তমানে অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী)। উইন্ডস ব্যান্ডের বেশ কয়েকটি গান লিখেছিলেন নাট্যকার আখতার ফেরদৌস রানা (ফেরদৌস হাসান)। তাদের তিনটা ক্যাসেট বের হয়েছিল। মোহাম্মদপুরের কয়েকজন তরুণ তিথি ও সোহেল মিলে গড়ে তোলেন ব্যান্ড ফেইথ। ভোকাল অনল রায়হান পার্থ (চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান ও অভিনেত্রী সুমিতা দেবীর ছোট ছেলে) ড্রামার তিথি (বর্তমান লালন ব্যান্ডের ড্রামার ও দলনেতা)। হবিগঞ্জের বাংলা ব্যান্ড জনপ্রিয় গান মিষ্টি মেয়ে চোখটি তোল।

গায়ক সবুজ। সুরেলা কন্ঠ। অনেক বছর পর আর টিভির একটি গানের রিয়ালেটি শোতে প্রথম হয়ে ফিরে এসেছিলেন। আবারও হারিয়ে গেছেন। ৮০ এর দশকের শেষে বাজারে আসে ব্লু ওয়েভস ব্যান্ডের ক্যাসেট। ভালোবাস কি না জানি না, সাগরের তলদেশে, পৃথিবীকে ঘিরে যামিনী কাঁদে ইত্যাদি তাদের জনপ্রিয় গান ইত্যাদি। ব্যান্ডের ভোকাল গিলবার্ট। পালস ব্যান্ডের চন্দ্রিমা রাত্রিতে কিংশুক সৌরভে প্রিয়তমাকে খুঁজে পাই। অরকিজ ব্যান্ডের মাতাল করা হাওয়া এই স্বপ্নের জোছনায় ইত্যাদি। এর পাশাপাশি আরও কিছু সুরেলা গান এ প্রজন্মের অনেকেই শোনেননি। ব্যান্ড মিউজিক শুধু মিউজিক ছিল না। প্রেম ভালোবাসার পাশাপাশি সেখানে রাজনীতি, সমাজ সচেতনতা, দেশ, জাতি, সমাজ, তারুণ্য, মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা, মৌলবাদ, ফাঁরাকা বাঁধের কথাও ছিল। সেই কথাগুলো আড়ালেই থেকে গেছে।

 

অপসংস্কৃতির প্রচারটাই পেয়েছে বেশি। সেই তকমা গায়ে নিয়ে থেমে থেমে এগিয়ে গেছে ব্যান্ড মিউজিক। শুধুমাত্র বড় চুল থাকার জন্য বিটিভিতে প্রচারিত হয়নি ওয়েভ্স ব্যান্ডের গান। যে সম্ভাবনা নিয়ে এগিয়ে এসেছিল ব্যান্ড মিউজিক তা ধরে রাখতে পারেনি ব্যান্ডগুলো। বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিকের অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। দলাদলি, অন্তকলহ, মাদক, পরিকল্পনার অভাব আর বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর নাক সিটকানোর জন্য সে পথ যেন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠল। ব্যান্ড মিউজিক সঠিক পথে ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে গেলে মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, ইভটিজিং এতোটা মাথাচারা দিয়ে উঠতে পারতো না আজ। ব্যান্ড সংগীতই আমাদের পৌঁছে দিতে পারতো বিশ্ব দরবারে। ব্যান্ড মিউজিক হতে পারতো বাংলাদেশের আরেক পরিচয়। হাজার হাজার মানুষ কাজ করেছে অডিও ইন্ডাস্ট্রিতে। তাদের রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়েছিল। জমজমাট ছিল সেই দিনগুলো। ক্যাসেট যুগ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। বেশ কয়েক বছর সিডি চলেছে। সিডিও হারিয়ে গেল। স্রোতারা এখন ইন্টারনেটে গান শুনে।

অ্যাপসের মাধ্যমে দু’একটি করে গান বাজারে আসছে। সে অবস্থাও নড়বড়ে বাংলাদেশের অডিও শিল্পের সুদিন এখন শুধুই অতীত ইতিহাস মাত্র। অপরদিকে যারা অডিও ক্যাসেট বিক্রি করে সংসার চালাতো তারা আজ নিরুপায় হয়ে মোবাইল চার্জার, টর্চলাইট, হাত ঘড়ি, দেয়াল ঘড়ি, কোমর বেল্ট ইত্যাদি বিক্রি করেন। মাধবপুর বাজারের ব্যবসায়ী আঃ আজিজ বলেন, অডিও ক্যাসেট বিক্রি করে যেমন তেমন ভাবে সংসার চালাতো কিন্তু এখন অডিও ক্যাসেট বিক্রি বন্ধের পর হতে নিত্যান্তই অভাব অনটনের মধ্যে জীবনযাপন করছে।

Development by: webnewsdesign.com