মহান ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস : আমাদের চাওয়া পাওয়া

শনিবার, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১২:১৮ অপরাহ্ণ

মহান ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস : আমাদের চাওয়া পাওয়া
apps

একুশে ফেব্রুয়ারি মানেই ফাল্গুন আর ফাল্গুন মানেই বসন্তÍ। বাসন্তিÍ কৃষ্ণচূড়ার মাথায় ফোটে রক্ত রঙের পুষ্পরাজি, তা বাতাসে দুলে মনে করিয়ে দেয় একুশের ভাষা শহীদদের কথা, ভাষা সংগ্রামের কথা। বাংলা ভাষা-রাষ্ট্রভাষা হওয়ার জন্য আমরা গর্বিত। হয়তো বা আরও গর্বিত হওয়া সম্ভব ছিল বাংলা ভাষা যদি ব্রিটিশ ভারতের এক আধা রাজ্যের রাষ্ট্র ভাষার পরিবর্তে গোটা স্বাধীন ভারতেরই রাষ্ট্রভাষা হতো।
আমাদের পূর্ব প্রজন্মের মনীষীরা এ ব্যাপারে তৎপর থাকলেও সংকীর্ণমনা রাজনীতির ডামাডোলে তা চাপা পড়ে যায়। কংগ্রেস মহল হিন্দির পক্ষে আর প্রভাবশালী কিছু মুসলমান উর্দুর পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন। এ দুই মতবাদের বিপক্ষে বাংলাভাষী অঞ্চল হতে বাংলাকে ভারতের সাধারণ ভাষা করার জন্যও দাবি তোলা হয়। এ নিয়ে বহু বৈঠক হয়। বিভিন্ন বৈঠকে শহীদুল্লাহ, প্রমুখ মনীষী ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার দাবি উত্থাপন করেন। এ দাবিতে জনমত সৃষ্টি হলেও প্রতিবাদের মুখে আর তৎকালীন সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপের জন্য তা অর্জিত হয়নি।
প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি যেমন ইতিহাসের সেই গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, তেমনি আমাদের আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড় করায়। এই দীর্ঘ সময়ে মাতৃভাষার মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমরা কী করতে পেরেছি?
আমাদের ভাষা আন্দোলন কেবল ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্যে সীমিত ছিল না। এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে ছিল আমাদের স্বাধিকার ও আত্মপরিচয়ের প্রত্যয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে। ১৯৯৯ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি লাভ করার পর পৃথিবীর প্রায় সব দেশ এই দিবসটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্যাপন করে থাকে মাতৃভাষার মর্যাদার স্মারক হিসেবে। ফলে একুশে ফেব্রুয়ারির মহিমা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের গৌরব ও আনন্দের বিষয়। কিন্তু সেই আনন্দ ম্লান হয়ে যায় যখন ইউনেসকোর তাগিদ সত্ত্বেও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিশ্ববাসীকে জানানোর কোনো উদ্যোগ সরকারের পক্ষ থেকে না নেওয়ার খবর পত্রিকায় আসে। এমনকি আন্তর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউট নামের যে প্রতিষ্ঠানটি ২০০১ সালে মহা ঢাকঢোল পিটিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, সেই প্রতিষ্ঠানটিও এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। এটি দুর্ভাগ্যজনক।
ভাষা আন্দোলনের মর্মবাণী ছিল এর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন। ভাষা আন্দোলনের কয়েক বছরের মধ্যেই পাকিস্তান সরকার বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয়। স্বাধীনতার পর থেকে এটি পালিত হয়ে আসছে জাতীয় শহীদ দিবস হিসেবে। কিন্তু ভাষাশহীদদের প্রধান যে অঙ্গীকার সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন, সেটি আমরা করতে পারিনি স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও। দেশে ৩০ শতাংশের মতো মানুষ এখনো শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, কোন শিক্ষাকে স্থায়ী করিতে চাইলে, গভীর করিতে হইলে, ব্যাপক করিতে হইলে তাহাকে চিরপরিচিত মাতৃভাষায় বিগলিত করিয়া দিতে হয়৷
আমাদের দেশে প্রতিবছরই একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হয় সরকারিভাবে শহীদ দিবস হিসেবে। ১১ জ্যৈষ্ঠ যেমন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় কাজী নজরুল ইসলামকে, ২৫ বৈশাখ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে, ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়াকে ঠিক তেমনি ২১শে ফেব্রুয়ারিতে আমরা স্মরণ করি বাংলা ভাষার সংগ্রামের অমর শহীদদের। এ দিনে শহীদদের স্মৃতিফলকে মাল্য দান করা হয়। চলে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, স্মরণসভা বক্তাদের ভাষণ ইত্যাদি। বিভিন্ন স্থানে পৃথক সভার মাধ্যমে চলে ভাষা সংগ্রামের শহীদদের বীরত্ব গাথা নিয়ে আলোচনার এক অঘোষিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা। রাজধানী ঢাকাতে কেন্দ্রীয়ভাবে শহীদ দিবস উদযাপিত হলেও দেশের সর্বত্র দিবসটি গুরুত্বসহকারে পালিত হয়। পত্র-পত্রিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ দিবসটি যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে দেশের বাইরেও বিভিন্ন স্থানে উদযাপিত হয়ে থাকে।
বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত নিবন্ধে ভাষা আন্দোলনকে সামনে রেখে অনেকেই আলোচনা করেন। বাংলা ভাষার সংকট, সমস্যা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে যেমন আলোচনা হয় তেমনি ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস নিয়েও কথা হয়। বাংলা ভাষার সংকট নিয়ে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা কেবলমাত্র বছরের নির্দিষ্ট একটি দিনের গন্ডিতেই আবদ্ধ থাকে। অথচ একুশের আন্দোলন বাংলাদেশের বাইরে বলতে গেলে গোটা বিশ্বেই প্রচারিত।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা ভাষা। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ছোট্ট হলেও রাষ্ট্রভাষা বাংলা ভাষা হওয়ার কারণে বিশ্ব ভাষা অঙ্গনে বাংলা ভাষার স্থান অনেক উঁচুতে স্বীকার করতেই হয়। এটা গোটা বিশ্বের বাংলাভাষীদের কাছে গৌরবের ব্যাপার। বিশেষ করে জাতিসংঘের সদর দপ্তর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তÍর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে বাংলা ভাষাকে যথোচিত সম্মান প্রদান করায় এ ভাষা ও দেশের মান এবং পরিচিতি যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে।
১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে দেশ ভাগের প্রাক্কালে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য উর্দুভাষী ড. জিয়াস উদ্দিন আহমদ এ অভিমত ব্যক্ত করেন যে, কংগ্রেস স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে হিন্দিকে গ্রহণ করার পর স্বাভাবিকভাবেই উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা উচিত। জিয়াস উদ্দিন সাহেবের বক্তব্যকে খন্ডন করে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা নামে এক নিবন্ধ প্রকাশ করে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। নিবন্ধটি আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালের ২৯ জুলাই তারিখে।
পূর্ব পাকিস্তানের জবান শীর্ষক এক নিবন্ধে আব্দুল মনসুর বলেন, উর্দু নিয়ে এ ধস্তাধস্তি না করে আমরা যদি সোজাসুজি বাংলাকেই পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও জাতীয় ভাষারূপে গ্রহণ করি, তাহলে পূর্ব-পাকিস্তান প্রবর্তনের সাথে সাথে আমরা বাংলার শিক্ষিত সম্প্রদায় নিজেরাই পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, শিক্ষাগত, অর্থনৈতিক ও শিল্পায়নে হাত দিতে পারব। এ লেখাটি প্রকাশিত হয় মোহাম্মদীতে ১৯৪৩ সালে।
১৯৪৪ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য নিবন্ধে কবি ফররুখ আহমদ লিখেনÑ পাকিস্তানের অন্তÍত পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা যে বাংলা হবে এ কথা সর্ববাদী সম্মত হলেও আমাদের এ পূর্ব পাকিস্তানেরই কয়েকজন তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তি বাংলা ভাষার বিপক্ষে এমন অর্বাচীনের মতো মত প্রকাশ করেছেন, যা নিতান্তÍই লজ্জাজনক। অবশ্য শেষ পর্যন্তÍ তা টিকেনি।
দেশ স্বাধীন হলো। ১৯৪৭ সালের ১লা সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কজন অধ্যাপক বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রদের উদ্যোগে পাকিস্তান তমুদ্দুন মজলিস নামে এক সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। মোহাম্মদ তোয়াহার ভাষায়, বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা যায় কিনা তা নিয়ে বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রমহলে প্রথম চিন্তার সূত্রপাত করে এ সংগঠন। এরাই প্রথম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি তোলে এবং ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত করে। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের কিছু কর্মকর্তা রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রশ্নে নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করেন। প্রথম দিকে ছাত্রছাত্রীদের বাংলাভাষা রাষ্ট্রভাষা করার প্রশ্নে বেশ অসুবিধাজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেয়াওত খাঁ ছিলেন অবাঙালি। তিনি অবশ্য রাষ্ট্রভাষা বাংলার সমর্থক এবং রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্যও ছিলেন। অধ্যাপক খাঁর ভাষায় পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ সারা পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ, তারা বাংলা ভাষায় কথা বলেন। কাজেই বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ন্যায্য, স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত।
১৯৪৮ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে করাচিতে গণপরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ অধিবেশনে ভাষা প্রশ্নে পূর্ব-পাকিস্তানের বেশির ভাগ সদস্যই সরকারি প্রস্তাবের ওপর সংশোধনী বক্তব্য রাখেন। তারা বলেন, রাষ্ট্রভাষা সে ভাষাই হওয়া উচিত বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ যে ভাষা ব্যবহার করেন। যদি ২৯ নং বিধিতে ইংরেজি ভাষা সম্মানজনক স্থান পেতে পারে, পরিষদের কার্যাবলী উর্দু এবং ইংরেজির মাধ্যমে চলতে পারে, তাহলে বাংলা যা ৪ কোটি ৪০ লাখ লোকের ভাষা কেন সম্মানজনক স্থান পাবে না? কাজেই এ ভাষাকে প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত নয়। এ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বিবেচনা করা হোক। কিন্তু সংশোধনী এ প্রস্তাবটি সরকারি বেশির ভাগ সদস্যদের বিরোধিতার মুখে অগ্রাহ্য হয়।
এদিকে গণপরিষদে বাংলা ভাষার দাবি অগ্রাহ্য হওয়ার পর ঢাকায় বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সিদ্ধান্তÍ নেয়া হয় আন্দোলন গড়ে তোলার। তমুদ্দুন মজলিসসহ বিভিন্ন সংগঠন ও নেতৃবৃন্দ সংবাদপত্রে বিবৃতির মাধ্যমে জনগণকে সংগ্রামে এগিয়ে আসার জন্য আবেদন জানান। গড়ে ওঠে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ও বাংলাভাষা প্রচার তহবিল। সংগ্রামের প্রয়োজনে পরিষদের কলেবর বৃদ্ধি করে ১৯৪৮ এর ৭ মার্চ ঢাকায় ধর্মঘট এবং ১১ মার্চ দেশের সর্বত্র সাধারণ ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্তÍ নেয়া হয়।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১১ মার্চ ১৯৪৮ আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। বিচারপতি আব্দুর রহমানের ভাষায়, ১১ মার্চের আন্দোলন না হলে ’৫২-এর আন্দোলন হতো না। ১৯৪৮-এর ১১ মার্চ রাষ্ট্র ভাষার দাবি নিয়ে যে আন্দোলন শুরু হয়, ১৯৫২-এর ২১শে ফেব্রুয়ারিতে তা পূর্ণতা পায়। ভাষাসৈনিকদের মতে, ’৪৮ সালের ১১ মার্চ ছিল ভাষা সংগ্রামের ইতিহাসে প্রথম সংগঠিত গণবিক্ষোভ। সভা, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ, মিছিল, ছাত্র-ছাত্রীদের পিকেটিং এবং পুলিশের লাঠিচার্জের ফলে ঢাকা শহর বিক্ষোভের নগরীতে পরিণত হয়। গ্রেপ্তার ও পুলিশি জুলুমের প্রতিবাদে ১২, ১৩ ও ১৪ মার্চ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়।
পরিস্থিতি বিবেচনায় পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব করেন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ আলোচনার টেবিলে সাত দফা দাবির চুক্তিপত্রের খসড়া পেশ করে। আলোচনায় আরো একটি নতুন শর্ত জুড়ে দিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইত্তেহাদ তার সম্পাদকীয়তে লিখা হয়: ‘বিরাট শক্তি আর দুর্জয় বিরোধিতার মধ্যে সংগ্রাম করে বাংলা ভাষা আন্দোলনকারীরা যে সাফল্য লাভ করেছে তা ইতিহাসে সোনার হরফে লেখা থাকবে।’ কায়দে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তখন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল। তিনি ১৯ মার্চ বিকালে ঢাকায় আগমন করেন। ২১ মার্চ রেসকোর্সের ময়দানে এক সংবর্ধনা সভায় তিনি ঘোষণা করেন; ‘একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে।’ ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন: ‘এটা আমার বিশ্বাস যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হওয়া উচিত।’ বছর চারেক পর ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পল্টনের এক জনসভায় খাজা নাজিম উদ্দিন পুনরায় ঘোষণা করেন; ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ এ ঘোষণা ছিল প্রকৃতপক্ষে পূর্বোক্ত চুক্তির খেলাপ।
১১ মার্চের চুক্তিকে স্মরণ করে প্রতিবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা দিবস উদযাপিত হতো। ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রভাষা দিবস উদযাপন কমিটির নেতৃত্বে খাজা নাজিম উদ্দিনের ঘোষণার প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে দিনই বুদ্ধিজীবী রাজনৈতিক নেতা ও সাংস্কৃতিক র্কর্মীদের এক বৈঠকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পরিচালনার প্রয়োজনে ৪০ জনেরও অধিক কর্মকর্তা নিয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়।
সর্বদলীয় কর্মপরিষদের উদ্যোগে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিকালে এক জনসভায় সরকারের চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের নিন্দা ও বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্তÍ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তÍ গৃহীত হয়। পরবর্তী ২১শে ফেব্রুয়ারি পূর্ব-পাকিস্তানব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট পালনের সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্তÍও গৃহীত হয়।
এদিকে ২০ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে এক মাসের জন্য ঢাকার সর্বত্র ধর্মঘট, সভা, মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। একুশের সাধারণ ধর্মঘটকে সফল করে তুলতে ১৪৪ ধারা বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়। কর্মপরিষদ জরুরি আলোচনায় বসে। আলোচনা সভায় আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণের প্রশ্নে দেখা দেয় বিতর্ক। অবশেষে সভায় ১১-৪ ভোটে গণতান্ত্রিক উপায়ে ১৪৪ ধারা না ভেঙে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তÍ গৃহীত হয়। অপরদিকে ফজলুল হক ও সলিমুল্লাহ হলে ছাত্রদের অপর দুটি সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্তÍ গ্রহণ করা হয়।
একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা শহরের ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক আমতলায় জড়ো হয়। বেলা সাড়ে ১২টার সময় গাজীউল হকের সভাপতিত্বে সভার কাজ শুরু হয়। সর্বদলীয় কর্মপরিষদের পক্ষ থেকে শামসুল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার জন্য ছাত্রছাত্রীদের প্রতি আবেদন জানিয়ে শান্তিÍপূর্ণ আন্দোলন চালানোর আহ্বান জানান। এদিকে আহ্বায়ক আব্দুল মতিন আন্দোলনের পেক্ষাপটে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্তÍ ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর ছেড়ে দেন। সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদের চেতনায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্তেÍ অটল থেকে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে অব্যাহতভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রতিবাদী মিছিল বের হতে থাকে। প্রতিবাদী মিছিলের গতি রোধ করতে সরকারি পক্ষ হতে চলে পুলিশের কাঁদুনে গ্যাস, লাঠিচালনা আর গুলিবর্ষণ। ফলে শহীদ হন রফিক, জব্বার, বরকতসহ আরো কজন। বাঙালির রক্তের বিনিময়ে রচিত হলো ভাষা আন্দোলনের অন্য এক অধ্যায়। প্রকৃতপক্ষে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের উত্তাল জোয়ার ছিল ২১, ২২, ২৩ এবং ২৪ ফেব্রুয়ারি অবধি। পরে পুলিশি নিষ্পেষণে তা স্তিমিত হয়ে আসে। শুধু ঢাকা শহরেই এ জোয়ার ছিল না, ছিল তৎকালীন গোটা পূর্ব পাকিস্তানে।
১১ মার্চ ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন তৎকালীন সরকারকে বাংলা ভাষার স্বপক্ষে চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছিল। অথচ রক্ত দিয়েও বায়ান্নতে টলানো যায়নি। ১১ মার্চের আন্দোলনের চুক্তি স্বাক্ষরিত না হলে মূল চুক্তি লঙ্ঘনের প্রশ্নই আসত না।
কমর উদ্দিন আহমদ বাংলাদেশ ইতিহাস সোসাইটির সভাপতি। ১১ মার্চের আন্দোলনের পর ১৫ মার্চ যে ৭ দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল সে চুক্তির রূপকার ছিলেন জনাব আহমদ। তিনি ১৯৭৯ সালের জুন মাসে এক সাক্ষাৎকারে দুঃখ করে বলেন, আজও ভাববার বিষয় ভাষার দাবি কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হয়েছে!
অনেকের মতে, ২১শে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনে চূড়ান্তÍ সাফল্য আসেনি। একুশের পর বাইশে ফেব্রুয়ারি অধিক গুলি বর্ষিত হয় এবং সেদিনই বেশি লোক গুলিতে মারা যায়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম কর্মী এবং সে সময় মেডিকেলের তৃতীয় বর্ষের জনৈক ছাত্রের প্রকৃত অভিজ্ঞতায় ২১শে ফেব্রুয়ারি মূলত ছিল ছাত্র আন্দোলন আর ২২ ফেব্রুয়ারি তা দুর্বার গণআন্দোলনে রূপান্তÍরিত হয়। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বাংলা রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে শাসনতান্ত্রি¿ক মর্যাদার স্বীকৃতি পায় ৫৫ সালের আন্দোলনের পর।
বায়ান্নর পর থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস উদযাপন করার মধ্য দিয়েই ভাষা আন্দোলন গণমানসে উদ্দীপিত ছিল। ১৯৫৩-৫৪ সালে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু না হলেও ১৯৫৫ সালে আন্দোলন ভিন্ন পথে হাঁটতে শুরু করে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর ফজলুল হক মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। কিছু দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব-পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার ভেঙে দিয়ে কেন্দ্রীয় শাসন জারি করে। গভর্নর হয়ে আসেন-ইস্কান্দার মির্জা। ১৯৫৫ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি কর্মসূচির মধ্যে ছিল শহীদ মিনার ও মাজারে ফাতেহা পাঠ, আমতলায় ছাত্রসভা ও ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার প্রচেষ্টা। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই ব্যাপক পুলিশি তৎপরতা চলে, গ্রেপ্তার করা হয় দলে দলে ছাত্রদের। গ্রেপ্তারের আওতা থেকে ছাত্রীরাও রেহাই পায়নি। এ বছরই ব্যাপক সংখ্যায় ছাত্রছাত্রী গ্রেপ্তারবরণ করে। ১৯৫৫ সালের পরই বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে শাসনতান্ত্রিক স্বীকৃতি লাভ করে।
১৯৫৬ সালের ২৯ জানুয়ারি পাকিস্তান ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের সংবিধান গৃহীত হয়। সংবিধানে ভাষা সংক্রান্তÍ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রভাষা বাংলাকেও স্বীকার করে নেয়া হয়।
অনুচ্ছেদটি হলো : (১) ২১৪ (১)  THE STATE LANGUAGE OF PAKISTAN SHALL BE URDU AND BENGALI| ১৯৬২ সালের ১লা মার্চ পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান THE CONSTITUTION OF REPUBLIC OF PAKISTAN চালু করেন। এ সংবিধানেও জাতীয় ভাষা সংক্রান্তÍ অনুচ্ছেদটি নিম্নরূপ ২১৫ (১)THE NATIONAL LANGUAGES OF PAKISTAN ARE BENGALI AND URDU. তারপর পূর্ব পাকিস্তানের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা দিয়ে গড়িয়েছে অনেক পানি, আর বাঙালির ইতিহাস ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার আন্দোলনে উত্তরণ ঘটেছে। সে অন্য ইতিহাস।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও আমরা মাতৃভাষাকে শিক্ষার বাহন করতে পারিনি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বাংলা চালু থাকলেও বাংলা এখনো উচ্চশিক্ষার বাহন হয়নি। বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, প্রকৌশলসহ বহু বিষয়ে বাংলায় পাঠ্যপুস্তক রচনা করা সম্ভব হয়নি। ফলে এসব বিষয়ে শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। অথচ জাপান, কোরিয়াসহ বহু দেশ মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষার সব দরজা খুলে দিয়েছে, যাদের লোকসংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম।
প্রতিবছরই একুশে ফেব্রুয়ারি সামনে রেখে আমরা সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রবর্তনের কথা বলি। নিরক্ষরতামুক্ত দেশ গড়ার কথা বলি। কিন্তু সর্বস্তরে মাতৃভাষা বাস্তবায়নে এক কদম এগিয়েছি, সে কথা বলা যাবে না। এ ক্ষেত্রে যাদের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত, তাদের নিষ্ক্রিয়তা বা অবিমৃশ্যকারিতা আমাদের পীড়িত ও ব্যথিত করে। অন্যদিকে সরকারি কাজকর্মে বাংলা চালু থাকলেও ব্যবসা-বাণিজ্য, উচ্চশিক্ষা, গবেষণাসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ইংরেজি প্রাধান্য পেয়ে আসছে। বাংলায় আইন প্রণীত হলেও উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা চালু হয়নি। কয়েক বছর আগে উচ্চ আদালত বাংলা ভাষা ব্যবহারে শৃঙ্খলা আনতে একটি কমিটি করে দিলেও তার কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। যে দেশে ভাষার জন্য মানুষ জীবন দিয়েছে, সেই দেশে মাতৃভাষার অবমাননা অত্যন্ত লজ্জাকর।
যদি আমরা নিজেদের আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে দাবি করি, তাহলে শিক্ষা, সরকারি-বেসরকারি দপ্তরসহ সর্বস্তরের বাংলা ভাষা প্রচলনে আমাদের একটি মহাপরিকল্পনা নেওয়া এবং দ্রুততম সময়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। সেটিই হতে পারে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রেষ্ঠ উপায়। জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সবার মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক।

লেখক : জেমস আব্দুর রহিম রানা, ( সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট ), যশোর।

 

 

Development by: webnewsdesign.com