বিশ্বজুড়ে ২০১৯ ছিলো বিক্ষোভের বছর

সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯ | ৪:০০ অপরাহ্ণ

বিশ্বজুড়ে ২০১৯ ছিলো বিক্ষোভের বছর
apps

২০১৯ সালে বিশ্বের প্রায় সব প্রান্তে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন সরকার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আর গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন। হংকং থেকে বলিভিয়া, ফ্রান্স থেকে লেবানন পর্যন্ত দেখা গেছে আন্দোলনের উত্তাপ। ভয়েস অব আমেরিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৬০ এর দশকের পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সবচেয়ে বেশি বিক্ষোভ দেখা গেছে চলতি বছর। এ বছর ছোটো-বড়ো ১৮৪৮টি বিক্ষোভ হয়েছে।
লাগাতার বিক্ষোভ চলছে হংকংয়ে। বন্দি প্রত্যর্পণ নিয়ে সরকারি একটি বিলের বিরোধিতা করে গত জুনে বিক্ষোভের ডাক দেয় চীনের নিয়ন্ত্রণে থাকা হংকংয়ের বাসিন্দারা। লাখো মানুষের আন্দোলনের মুখে বিতর্কিত বিলটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবিতে এখনো বিক্ষোভ চলছে হংকংয়ে। প্রায়ই বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের বলপ্রয়োগের অভিযোগ উঠছে। চীন সরকারের অনড় অবস্থানেও বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছে হংকংয়ের বাসিন্দারা।

লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশে ক্ষোভের বিস্ফোরণ দেখা গেছে। গত অক্টোবরে বিক্ষোভ হয়েছে লাতিন আমেরিকার দেশ বলিভিয়ায়। নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ এনে রাজপথে বিক্ষোভ করছে বিরোধী দল ও সাধারণ মানুষ। এই বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে গেছেন প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস।
নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ এনে ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে বিরোধীরা। যদিও সেনাবাহিনীর সমর্থনে এখনো টিকে আছেন তিনি। গত অক্টোবরে চিলিতেও ব্যাপক আন্দোলন দানা বাধে। জ্বালানি তেলের উচ্চ মূল্য এবং দেশটির দুর্বল মুদ্রার কারণ দেখিয়ে চিলি সরকার বাস ও মেট্রোর ভাড়া বৃদ্ধি করলে প্রতিবাদে রাস্তায় নামে সাধারণ মানুষ। আন্দোলনের মুখে চিলির মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়ার ঘোষণা দেন দেশটির প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ান পিনেরা। অক্টোবরেই লাতিন আমেরিকার আরেক দেশ ইকুয়েডরে প্রবল বিক্ষোভ হয়। সরকারি খরচ কমানোর অংশ হিসেবে সরকার হঠাত্ করেই জ্বালানিতে ভর্তুকি বন্ধ করার ঘোষণার পর বিক্ষোভ শুরু হয়। আন্দোলনের মুখে সরকার শেষ পর্যন্ত জ্বালানি তেলে ভর্তুকি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।

আন্দোলন হয়েছে স্পেনের কাতালোনিয়ায়। গত ১৪ অক্টোবর কাতালোনিয়ার স্বাধীনতাপন্থি নেতাদের কারাবন্দি করার প্রতিবাদে স্পেনের বার্সেলোনার রাস্তায় নেমে আসে লাখ লাখ মানুষ। ২০১৭ সালে বার্সেলোনায় ‘অবৈধ’ গণভোট আয়োজন করা এবং স্বাধীনতা ঘোষণার কারণে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে বেশ কয়েক জনকে সম্প্রতি দোষী সাব্যস্ত করে কারাদ- দেওয়া হয়। কিন্তু এই রায় ঘোষণার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিক্ষোভে নামে কাতালোনিয়ার মানুষ। এখন আন্দোলন কিছুটা কমে আসলেও যে কোনো সময় ক্ষোভে ফুঁসে উঠতে পারে কাতালানরা।
মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ ইরাকে রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা জানিয়ে বিক্ষোভ করেছে জনগণ। ইরাকি সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা মেধার ভিত্তিতে সরকারি কাজে নিয়োগ না দিয়ে জাতিগত ও অন্যান্য বিবেচনায় নিয়োগ দিচ্ছে। গত অক্টোবরে সরকারের এই বৈষম্যের নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভে সহিংসতায় দুই শতাধিক ইরাকি নিহত হয়েছেন। আন্দোলনের মুখে গত নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী আব্দুল মাহদি পদত্যাগ করেছেন।

মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ লেবাননে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে জ্বালানি, তামাক এবং হোয়াটসঅ্যাপ কলের ওপরে নতুন করারোপের সিদ্ধান্তে। আন্দোলনের মুখে সরে দাঁড়ান প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি। দুর্নীতির অভিযোগে মিশরীয় সরকারের বিরুদ্ধেও বিক্ষোভ হয় প্রায় একই সময়ে। যদিও কঠোরভাবে সেই বিক্ষোভ দমন করেছেন প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল-সিসির সরকার। পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য আবদেল আজিজ বুতেফিকা প্রার্থী হতে চাইলে গত ফেব্রুয়ারিতে আলজেরিয়ায় ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। আন্দোলনের মুখে সরে দাঁড়ান প্রধানমন্ত্রী বুতেফিকা।
দক্ষিণ এশিয়ায় বিক্ষোভ হয়েছে পাকিস্তান এবং ভারতেও। পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ হয়েছে। গত ২৭ অক্টোবর থেকে মওলানা ফজলুর রেহমানের নেতৃত্বে জামিয়াত উলেমা-ই-ইসলাম (এফ) এই বিক্ষোভ করে। যদিও শেষ পর্যন্ত আন্দোলন সফল হয়নি।
ভারতে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর বিক্ষোভ হয়েছে। তবে সরকারের বহুমুখী পদক্ষেপে সেই আন্দোলন দানা বাঁধতে পারেনি। বছরের শেষে এসে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাশ করে কেন্দ্রীয় সরকার। এই আইনের প্রতিবাদে ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ করেছে। এখন পর্যন্ত বিক্ষোভে সহিংসতায় মারা গেছেন ২৫ জন। আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এই আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছে। চলতি বছর রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে বিক্ষোভ হয়েছে নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগে। ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে লন্ডনের রাস্তায়ও। ফ্রান্সে পেনশন রীতি সংস্কারের প্রতিবাদে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে। কম আয়ের মানুষেরা বিক্ষোভ করেছে যা ইয়োলো ভেস্ট আন্দোলন নামে পরিচিতি পেয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবিতে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অতীতের চেয়ে এখন বেশি আন্দোলনের অন্যতম একটি বড়ো কারণ হলো যোগাযোগ মাধ্যমের বিস্তৃতি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে মানুষের ক্ষোভ যত সহজে প্রকাশ পেয়েছে তত সহজে বিক্ষোভকারীদের জড়ো করেছে। ফ্রেঞ্চ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্সের থিয়েরি ডা মন্টব্রিয়াল বলেন, এর ফলে শীর্ষ থেকে নিচ পর্যন্ত ক্ষমতা প্রয়োগের চিরায়ত যে ব্যবস্থা রয়েছে তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

Development by: webnewsdesign.com