কানাডা, যুক্তরাজ্য, হংকং ও স্লোভাকিয়ার চারটি প্রতিষ্ঠানের হয়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান বিডি মাল্টিটেক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) দেশি ওই প্রতিষ্ঠানের জন্য আশীর্বাদ। প্রতিষ্ঠানটির অনেক কাজ সহজ করে দিয়েছে এআই প্রযুক্তি। কাজের ক্ষেত্রে কমেছে সময় ও শ্রম। রয়েছে বিপরীত চিত্রও। এআইয়ের কারণে আয় কমেছে অনেক ফ্রিল্যান্সারের। অনেকের কাজ থাকলেও কমেছে মজুরি। কেউ আবার কাজ হারানোর শঙ্কায়।
বিডি মাল্টিটেকের স্বত্বাধিকারী মাইনুর রহমান মিল্কী বলেন, এআইয়ের জন্য এখন আমাদের ডিজিটাল বিপণন, এসইও (সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন), গ্রাফিক ডিজাইন, লোগো তৈরি, ওয়েব ডেভেলপমেন্টের কাজ সহজ হয়ে গেছে। এছাড়া মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও হিসাবরক্ষণের কাজ এখন হচ্ছে নিমিষে। ফলে ওইসব প্রতিষ্ঠানের কাজে সময় ও শ্রম কম দিতে হচ্ছে।
তবে এআই নিয়ে এর উল্টো বলেছেন কয়েকজন ফ্রিল্যান্সার। শিহাব হুসাইন নামে এক ফ্রিল্যান্সার জানান, এআইয়ের জন্য কনটেন্ট রাইটিংয়ের কাজ হারিয়েছেন তিনি। শিহাব বলেন, আগে হংকংয়ের একটি প্রতিষ্ঠানে কনটেন্ট রাইটিংয়ের কাজ করতাম। প্রতিষ্ঠানটি এখন এআই দিয়ে সম্পূর্ণ কনটেন্ট লেখাচ্ছে। এখন সেগুলো শুধু এডিটিংয়ের কাজ আমরা করছি।
তিনি বলেন, আরেক প্রতিষ্ঠান আগে ৪শ শব্দের কনটেন্টের জন্য ১৫ থেকে ২০ ডলার পে (পরিশোধ) করতো। এখন সেটা এআইয়ের মাধ্যমে চায়, বিলের এক-চতুর্থাংশ অফার করছে। শিহাব বলেন, আগে যে কপি লিখতে একজন কপিরাইটারের দুই-তিন ঘণ্টা লাগতো, এআই দিয়ে তা ১০ মিনিট বা আরও কম সময়ে লেখা যাচ্ছে। তৈরি লেখাগুলো আবার খুঁটিয়েও দেখা যাচ্ছে এর মধ্যে। ফলে পেমেন্ট কম দিচ্ছে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো।
ঢাকার ফ্রিল্যান্সার তৌহিদুর রহমান ফটোগ্রাফি ও প্রোগ্রামিংয়ের কাজ করতেন। তিনি বলেন, এখন এআই দিয়ে সহজ প্রোগ্রামগুলো তৈরি করা যায়। ছোটখাটো অ্যাপের জন্য আর প্রোগ্রামিংয়ের কাজ আসে না, প্রোগ্রামিংয়ের কাজ কমেছে।
তিনি এ-ও বলেন, আগে প্রচুর ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড রিমুভের কাজ হতো। এখন এগুলো এআই দিয়ে দুই সেকেন্ডে নিখুঁতভাবে করা যায়। এসব কাজে আগে যেমন পেমেন্ট ছিল, এখন আর নেই।
অর্থাৎ, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এখন ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য কল্যাণের পাশাপাশি বিপত্তিও নিয়ে এসেছে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো দেশে ফ্রিল্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রে এআই প্রযুক্তির ঝুঁকিই বেশি। এতে কাজ হারাবে অনেক স্বল্পশিক্ষিত ফিল্যান্সার। আবার কাজ থাকলেও কমে যাবে আয়।
এআই এমন একটি প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রায় সব ধরনের কাজ করানো সম্ভব। চ্যাটজিপিটি ও বার্ডের মতো জেনারেটিভ এআই অনেক কাজই এখন মানুষের চেয়েও দ্রুত এবং নিখুঁতভাবে করে দিতে পারে। বাকি কাজগুলো শতভাগ না হলেও সেটা অন্য একজন মানুষের সাহায্যে শতভাগ সম্পূর্ণ করা সম্ভব। এতে কয়েকজন মানুষের কাজ একজন করতে পারছে।
এখন এআই দিয়ে ট্রান্সলেট থেকে শুরু করে ডাটা এন্ট্রি, কাস্টমার সার্ভিস, প্রুফরিডিং, কপিরাইটিং, সফটওয়্যার ডেভেলপ, ওয়েব ডেভেলপ, কম্পিউটারের প্রোগ্রাম তৈরি, কোডিং এবং তথ্য বিশ্লেষণ, মার্কেট রিসার্চ, সোশ্যাল মিডিয়া রিসার্চ, টেলিমার্কেটিং, বিভিন্ন টেকনিক্যাল সাপোর্ট অ্যানালিস্ট, ই-মেইল মার্কেটার, মডারেটরের কাজ খুব সহজে করানো যায়।
বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সাররা এসব কাজের ওপর বেশি নির্ভরশীল। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠান স্থানীয় কর্মী নিলে খরচ বেশি হয় বলে বাইরে থেকে (আউটসোর্সিং) এসব কাজ করিয়ে নেন। তথ্য বলছে, দেশে এখন সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সার রয়েছেন। তাদের সব মিলিয়ে বার্ষিক আয় প্রায় ১০০ কোটি ডলার বা ১০ হাজার ৬শ কোটি টাকা (ডলার ১০৬ টাকা ধরে)। ২০০৫-০৬ সাল থেকে মূলত দেশে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ আসা শুরু হয়। তরুণরাই এ কাজে এগিয়ে। এখন বাংলাদেশ থেকে প্রায় দেড়শোর বেশি মার্কেটপ্লেসে ফ্রিল্যান্সিং করা হয়। ফ্রিল্যান্সিংয়ে সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ।
জানতে চাইলে আইটি এক্সপার্ট তানভীর হাসান জোহা বলেন, এআইয়ের জন্য ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ কমবে না। কিন্তু কাজের ধরন দারুণভাবে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে, সেটার সঙ্গে অনেক ফ্রিল্যান্সার নিজেকে মিলিয়ে নিতে পারবেন না।জোহা বলেন, ফ্রিল্যান্সিংয়ে অপেশাদারত্বমূলক কাজগুলো এআইয়ের দখলে চলে যাবে। বাংলাদেশে এমন সংখ্যা কিন্তু বেশি। ফলে পেশাদারত্বের জায়গায় পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে টিকে থাকতে হবে।
রেডনোড সার্ভিসেস লিমিটেডের ফাউন্ডার ও সিইও জোবায়ের আহমেদ বলেন, ফটোশপ, প্রুফরিডিং, কপিরাইটিং, ডাটা এন্ট্রির মতো ছোট ছোট কাজ এআই মানুষের চেয়ে ভালো করতে পারে। সেজন্য এসব কাজ হারাচ্ছেন ফ্রিল্যান্সাররা। তাই এ টেকনোলজির সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করতে না পারলে বেকারত্ব বাড়বে।
তিনি বলেন, এআই দিয়ে এখন ছোটখাটো অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট বা অন্য ধরনের প্রোগ্রামিং রিলেটেড কাজও হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এআই মালিশিয়াস অ্যাক্টরস যারা আছে তারা খুব সহজেই বিভিন্ন ধরনের ম্যালের ডেভেলপ করতে পারছে। ভাইরাস তৈরি হচ্ছে। ফলে ফ্রিল্যান্সারদেরও নিজেদের সব সময় আপডেট করতে হবে।
উদ্যোক্তারা জানান, এখন ফ্রিল্যান্সিংয়ে দুভাবে আয় হয়। একটি অ্যাকটিভ আর্নিং। এটি হচ্ছে সরাসরি গ্রাহকের সঙ্গে কাজ করে আয় করা। আরেকটি প্যাসিভ বা পরোক্ষ আয়। এটি হচ্ছে বিভিন্ন মার্কেটপ্লেস থেকে কাজ করে আয় করা। এআইয়ের জন্য প্যাসিভ ফ্রিল্যান্সারদের ঝুঁকি বেশি।
Development by: webnewsdesign.com