ডা. সিএম শামীম কবীর
বর্ষাকালে আবহাওয়ায় গরম ও ঠান্ডার মিশ্র প্রভাব থাকে। আবার প্রচুর বৃষ্টিপাতে নদী-নালা থাকে কানায় কানায় পূর্ণ। যার ফলে বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকে। সংক্রামক ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস খুব সহজেই রোগ ছড়াতে পারে। তাই এ সমস্যা এড়াতে আমাদের বাড়তি সচেতনতা প্রয়োজন। ল্যাবএইড ডায়াগনস্টিক ও কনসালটেশন সেন্টার, উত্তরা, ঢাকা’র মেডিসিন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ডা. সিএম শামীম কবীর।
বর্ষাকালে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ডায়রিয়া, ডেঙ্গুজ্বর, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, দুই ধরনের হেপাটাইটিস (হেপাটাইটিস ‘এ’ এবং হেপাটাইটিস ‘ই’), সর্দি, কাশিসহ নানা রোগ।
* ডায়রিয়া
ডায়রিয়ার প্রধান কারণ হলো দূষিত পানি পান। বর্ষায় পানির সঙ্গে জীবাণু মিশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ডায়রিয়ার প্রকোপ বেশি দেখা যায়। এতে শরীরে পানিশূন্যতার মাধ্যমে কিডনি বিকল হয়ে মৃত্যুও ঘটাতে পারে। তাই রোগীকে খাওয়ার স্যালাইন, ভাতের মাড়, চিড়ার পানি, শরবত ইত্যাদি তরল খাদ্য বারবার খাইয়ে পানির অভাব পূরণ করতে হবে। শিশুদের ক্ষেত্রে বুকের দুধ বন্ধ করা যাবে না।
* কলেরা
কলেরা রোগ হয় রোটা ভাইরাসের সংক্রমণে। এতে রোগীর দেহে লবণ ও পানির ঘাটতি দেখা দেয়, ফলে রোগী দুর্বল হয়ে পড়ে। দ্রুত চিকিৎসা না করা হলে রোগীর জীবনহানি পর্যন্ত ঘটতে পারে।
* টাইফয়েড
বর্ষাকালে টাইফয়েড জ্বরের প্রকোপ বেশি দেখা যায়। সালমোনেলা টাইফি নামের এক ধরনের জীবাণু পানি ও খাবারকে দূষিত করে। এ দূষিত পানি অথবা খাবার খেয়ে মানুষ টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়। টাইফয়েডের বাহক এবং আক্রান্ত রোগীর মলমূত্র এ রোগের উৎস। সংক্রমিত খাদ্য, পানি ও মাছি এ রোগ ছড়ায়। এ রোগে জ্বর, কাশি, মাথাব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্য, বমি, ডায়রিয়া, পেট ফুলে যাওয়া, প্লীহা স্ফীতিসহ নানা জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
* ডেঙ্গুজ্বর
জীবাণুবাহী এডিস মশার কামড়ে এ জ্বর হয়। সাত বা ততোধিক দিন স্থায়ী উচ্চ জ্বর এ রোগের উপসর্গ। ডেঙ্গুজ্বর তিন প্রকারের হতে পারে। যেমন- সাধারণ ডেঙ্গুজ্বর, ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর (রক্তক্ষরণসহ) এবং ডেঙ্গু শকসিন্ড্রোম। সাধারণত বর্ষার সময়ে এ জ্বর হতে পারে। সংক্রমণকারী মশার কামড়ের পরে ৪-৬ দিনের মধ্যে এটি হয়। এ জ্বরের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই, আবার এ সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য কোনো ভ্যাকসিনও নেই। প্রতিরোধের একমাত্র উপায় মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করা। তাই ফুলের টব, নারিকেলের খোসাসহ অন্য যে কোনো পাত্রে পানি যাতে জমে না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে পারলেই ডেঙ্গু মশা বংশবৃদ্ধি করতে পারবে না। অন্যদিকে মশার কামড় থেকে রক্ষার জন্য মশারি ব্যবহার করতে হবে।
* ম্যালেরিয়া
এনোফিলিস জাতীয় স্ত্রী মশা দ্বারা এ রোগ ছড়ায়। সাধারণত পাহাড়ি অঞ্চলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়। বর্ষার শুরু এবং শেষে ম্যালেরিয়ার বিস্তার বেশি হয়ে থাকে। সর্দি-কাশি, গলা ব্যথা, কান পাকা, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া ইত্যাদি এ রোগের লক্ষণ। দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং তাৎক্ষণিক চিকিৎসা ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের অন্যতম পন্থা হিসাবে স্বীকৃত।
* হেপাটাইটিস
হেপাটাইটিস একটি যকৃতের রোগ। এর আবার বেশ কিছু প্রকারভেদ আছে। এগুলোর মধ্যে হেপাটাইটিস ‘এ’ এবং হেপাটাইটিস ‘ই’ পানিবাহিত ভাইরাস বলে বর্ষাকালেই বেশি হয়।
* ছত্রাক সংক্রমণ
ঘাম বা পানিতে বেশিক্ষণ ভেজা থাকলে পায়ের আঙুলের ফাঁকে, কুঁচকিতে, মাথায় ও চুলে ছত্রাক সংক্রমিত হয়। ছত্রাক সংক্রমণে ছত্রাকনাশক ক্রিম এবং চুলে বিশেষ শ্যাম্পু ব্যবহার করা যেতে পারে।
* কৃমি সংক্রমণ
বর্ষাকালেই কৃমির বেশি প্রাদুর্ভাব হয়। এ সময় পানি আর কাদামাটিতে এ জীবাণু মিশে থাকে। তাই অন্য যে কোনো ঋতুর তুলনায় বর্ষায় খুব সহজেই কৃমির সংক্রমণ ঘটে।
* শিশুদের এসব রোগ থেকে মুক্তি পেতে করণীয়
বর্ষাকালে সাধারণত শিশুরাই বেশি অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হয়। কারণ বড়দের তুলনায় তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। তাই প্রয়োজন বাড়তি সতর্কতা। সাধারণত শিশুরা পানিবাহিত রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। তবে যেটা শিশুদের বেশি দেখা দেয় তা হলো সর্দি, কাশি, ঠান্ডাজনিত কারণে শ্বাসকষ্ট এবং তার সঙ্গে জ্বর।
▶ এ সময় শিশুকে অবশ্যই ফোটানো ও বিশুদ্ধ পানি পান করাতে হবে। সামান্য সর্দি-কাশি ও জ্বরকে অবহেলা করা ঠিক হবে না, কারণ এর থেকে নিউমোনিয়া হয়ে শিশুর জীবন বিপন্ন হতে পারে।
▶ সর্দি-কাশি হলে শিশুকে লেবুর রস, তুলসী পাতার রস ও আদা খাওয়ানো যেতে পারে।
▶ শিশুকে মেঝেতে শোয়ানো যাবে না। বাড়ির আশপাশের মশার আবাসস্থল ধ্বংস করতে হবে।
▶ বর্ষাকালে গ্রামবাংলায় বন্যার প্রাদুর্ভাব হয়। তাই কোনো অবস্থাতেই শিশুকে পানিতে নামতে দেয়া যাবে না।
▶ যথাসময়ে টিকা (রোটা ভাইরাসের টিকা) দিতে হবে। সঠিক নিয়মে শিশুকে হাত ধোয়ানো এবং নখ কেটে দিতে হবে।
▶ শিশুর পুষ্টিকর খাবারের দিকে নজর দিতে হবে। এতে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে।
▶ স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া জীবাণুদের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে তোলে, যা বড়দেরও সহজেই অসুস্থ করে ফেলে। তাই বড়দেরও উপরোক্ত বিষয়গুলো মেনে চলা প্রয়োজন।
▶ বর্ষার দিনে রেইন কোট বা ছাতা ব্যবহার করতে হবে। বৃষ্টিতে ভিজলে বাসায় ফিরে ভালোভাবে গোসল করতে হবে।
▶ শরীর ও চুল শুকিয়ে পরিচ্ছন্ন কাপড় পরা জরুরি। সব সময় খাওয়ার আগে ভালোভাবে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে।
▶ সব কাজে বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করা শ্রেয়। রান্না করার আগে শাক-সবজি ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে। পচা বাসি খাবার খাওয়া যাবে না।
▶ রোগ নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে সচেতন হতে হবে।
▶ রোগে আক্রান্ত হয়ে গেলে অবশ্যই যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং মেনে চলা অতি জরুরি। সূত্র : যুগান্তর
Development by: webnewsdesign.com