প্রায়শই খবরের কাগজে কিংবা গণমাধ্যমে প্রতারণার কথা শুনতে পাওয়া যায়। প্রতারণা আজ সমাজের আতঙ্ক। সমাজে বসবাসের ফলে মানুষের সাথে মানুষের বিভিন্ন সম্পর্কে তৈরি হয় যার ভিত্তি হল বিশ্বাস করা। প্রতারণার ফলে মানুষ মানুষে বিশ্বাস হারিয়ে যায়। যার ফল পরোক্ষভাবে সমাজের উপরে এসে পরে। সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ মানুষের মধ্যে সম্পর্কে নষ্ট করে বলে প্রতারণাকে সামাজিক ভাইরাস বলা উচিত।
উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, প্রতারণা হচ্ছে অসদুপায় অবলম্বন করে কোন কিছু সমাধানের সক্ষমতার কারণে পুরস্কার গ্রহণ করা। আবার বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৪১৫ ধারায় প্রতারণার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া আছে। আসলে প্রতারণার নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া খুব কঠিন। কারণ প্রতিনিয়ত প্রতারকরা নতুন নতুন উপায় মানুষকে প্রতারিত করতেছে। প্রতারণার ইতিহাস যদি দেখা যায় তবে সেটার হদিস পাওয়া যাবে না কারণ এটি অত্যন্ত প্রাচীনকালের অপরাধগুলোর মধ্যে একটি। প্রতারকরা সুকৌশলে প্রতারণা করে থাকে। মানুষ জীবনে কোনো না কোনো সময়ে ছোটখাটো হলেও প্রতারিত হয়ে থাকে। তার মধ্যে একটি হল প্রেম ভালোবাসা জনিত বিষয়ে। কিছু কিছু প্রতারণায় মানুষ আইনি প্রতিকার আশা করে না বা চায় না কারণ বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু যদি সমাজের বড় বড় অপরাধের দিকে তাকানো হয় তবে দেখা যায় যে ছোট থেকে বড় অনেক ধরনের প্রতারণা হয়ে থাকে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতারক চক্রকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হতে দেখা যায়। কিন্তু তবুও নির্মল হয় না।
উদাহরণস্বরূপ তুলে ধরা যায় কিছুদিন পূর্বে কিছু বিদেশী শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার হতে দেখা যায়। যারা বাংলাদেশী একনারীকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন মানুষদেরকে প্রতারণা করে আসছে। তারা ফেসবুক ব্যবহার করে বিভিন্ন বৈদেশিক উপহারসামগ্রীর কথা বলে মানুষের কাছে থেকে অর্থ আদায় করত। যার কোনো ভিত্তিই ছিল না।
আবার করোনা মহামারীতে সরকার বিভিন্ন সরকার বেসরকারি হাসপাতালকে করোনা রোগী সনাক্তের পরীক্ষার নেওয়ার জন্য অনুমোদন দেয়। তার মধ্যে কিছু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ করোনা পরীক্ষা ছাড়াই ফলাফল দিয়েছে। এটাই প্রতারণা ছিল। আবার এমনও প্রতারক আছে যারা ভিন্ন উপায়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতারণা করে থাকে। বর্তমানে দেখা যায় যে প্রতারকরা রাজনৈতিক সখ্যতা ব্যবহার করে প্রতারণা করে থাকে। যেমন সুযোগ নিয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তির্বগের সাথে ছবি তোলা, সখ্যতা করা, দালাল তৈরি করা, সিন্ডিকেট করা ইত্যাদি। এগুলো দিয়ে সাধারণ জনগণকে জিম্মি করে প্রতারণা করে থাকে। প্রতারণার মাধ্যমে বিদেশ পাচার করা।
প্রতারণা করা বরাবরই আইনত অপরাধ। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৪২০ ধারা অনুযায়ী যার সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছরের কারাদণ্ড এবং সাথে অর্থদণ্ড ও দিতে পারে। আবার যারা এর সাথে জরিত থাকে কিংবা সহায়তা করে তারাও দণ্ডবিধির ৩৪, ৩৫, ১০৭ ও ১০৮ ধারা অনুযায়ী সমান অপরাধী ও সমান দণ্ড পাবে। বর্তমানে প্রতারণার ক্ষেত্র এতটা ব্যাপক যে উক্ত আইনগুলো অপরাধের শাস্তি হিসেবে যথেষ্ট নয়। আবার আলাদা প্রতারণার ধরন ভেদে আলাদা আইন ও মামলা-মোকদ্দমা হয়। যেমন চেক জালিয়াতি, দলিল জালিয়াতি অর্থ আত্মসাত ইত্যাদি। আবার ক্ষতিপূরণের দাবিতে দেওয়ানি মামলা করা যায়। এসব মামলাতে প্রতারণা প্রমাণ করাই কষ্টকর কাজ। আবার যেমন সমাজ কিছু সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র আছে যারা মেয়েদেরকে ব্যবহার করে ছেলেদের সাথে বিবাহ সম্পাদন করায়। পরবর্তীকালে নারী নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে মোহরানা আদায় করে তালাক দিয়ে দেয়। কিছু সিন্ডিকেট আইন শৃংখলা বাহিনীর হাতে ধরা খেলে ও অনেকে ধরাছোঁয়ার বাহিরে রয়ে যায়। এখানে আইনের অপর্যাপ্ততা ও যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া যায় না। বের হয়ে এসে আবার ও প্রতারকচক্রে যোগদান করে।
প্রতারণা হতে বাঁচতে হলে সচেতনতার বিকল্প নেই। কোনো ব্যবসা কিংবা লেনদেনে গেলে আইন সম্মত উপায়ে চুক্তি করে নিতে হবে। কারণ প্রতারকদের প্রধান লক্ষ্য থাকে অর্থসম্পদ আত্মসাত করা। কোনো বিষয়ে লিখিত প্রমাণ ও সাক্ষী থাকলে খুব সহজে প্রমাণ করা যায়। রাস্তা ঘটনা ঘাটে চলাকালীন অবস্থায় অন্যকে কোনো প্রকার সুযোগ দেওয়া কিংবা বিশ্বাস করা যাবে না। বিভিন্ন জায়গা অবস্থান কালে স্থানীয় পুলিশ স্টেশনের খোঁজ রাখতে হবে। প্রতারিত হলে যতদ্রুত সম্ভব থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে হবে। প্রতারকরা অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও সুকৌশলে কাজে করে। তার জন্য আইনি ব্যবস্থা নেবার পূর্বে যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে আইনি প্রতিকার নিতে হবে। প্রতারক চক্রকে নিয়ে আরও আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন এবং সকল ধরনের প্রতারণাকে সুনির্দিষ্ট চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সরকার উদ্যোগ ও জনগণকে সরকারের পাশে থাকতে হবে। সবশেষে এটা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ যে সবসময় নিজেকে নিরাপদ অবস্থানে রাখতে হবে কারণ অপরাধের প্রতিকারের থেকে প্রতিরোধ উত্তম।
লেখক
জিসান তাসফিক
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ,
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।
Development by: webnewsdesign.com