পাপিয়ার বাসায় ৫৮ লাখ টাকা, অস্ত্র

সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | ১:৩৩ অপরাহ্ণ

পাপিয়ার বাসায় ৫৮ লাখ টাকা, অস্ত্র
apps

যুব মহিলা লীগের নেত্রী হওয়ায় বেশ দাপটের সঙ্গে চলতেন শামিমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ। অর্থবিত্ত গড়তে গড়ে তোলেন ক্যাডার বাহিনীও। যুব মহিলা লীগের পদ বাগিয়ে নেওয়ার পর নারীদের নিয়ে অনৈতিক ব্যবসাসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন তিনি। গত শনিবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাঁকে গ্রেপ্তারের পর গতকাল রবিবার সকালে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় তাঁর বাসায় অভিযান চালিয়ে নগদ ৫৮ লাখ টাকা, অস্ত্র, গুলিসহ আরো কিছু জিনিস উদ্ধার করেছে র‌্যাব।

এ ঘটনায় পাপিয়া ও তাঁর সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া স্বামী মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী ওরফে মতি সুমন এবং সাব্বির খন্দকার ও শেখ তৈয়বার নামে দুটি মামলা করা হয়েছে। তেজগাঁও থানায় করা হয়েছে অস্ত্র ও মাদকের মামলা। আর বিমানবন্দর থানায় জাল মুদ্রা রাখার অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। তাঁদের বিমানবন্দর থানায় সোপর্দ করেছে র‌্যাব। আজ সোমবার তাঁদের আদালতে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন বিমানবন্দর থানার ওসি ফরমান আলী।

পাপিয়ার নরসিংদীর বাড়িতে ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও অভিযান চালিয়েছে র‌্যাব। এ সময় র‌্যাবের সঙ্গে পাপিয়ার সব অপকর্মের মূলহোতা তাঁর স্বামী মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমন ছিলেন। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নরসিংদী পৌর এলাকার ভাগদী মহল্লায় এ অভিযান চালানো হয়।

এদিকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে যুব মহিলা লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে পাপিয়াকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। গতকাল সংগঠনটির সভাপতি নাজমা আকতার ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক অপু উকিল স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

পাপিয়ার বাসা থেকে ৫৮ লাখ টাকা উদ্ধার : গতকাল বিকেলে কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-১-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল জানান, শামীমা নূর পাপিয়ার নামে রাজধানী ঢাকা ও নরসিংদীতে বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়িসহ নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। রাজধানীর বিভিন্ন পাঁচতারা হোটেলে নারীদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করে অর্থ আয়ের মাধ্যম ছিল তাঁর। এ ছাড়া রেলওয়ে ও পুলিশের এসআই পদে চাকরির কথা বলে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেন তিনি।

গতকাল সকালে রাজধানীর ফার্মগেট ইন্দিরা রোডে পাপিয়ার বাসায় অভিযান চালিয়ে একটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন, ২০ রাউন্ড গুলি, পাঁচ বোতল বিদেশি মদ, ৫৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা, পাঁচটি পাসপোর্ট, তিনটি চেক, বেশ কিছু বিদেশি মুদ্রা ও বিভিন্ন ব্যাংকের ১০টি এটিএম কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, প্রাথমিক তদন্তে ফার্মগেটে পাপিয়ার দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, নরসিংদী শহরে দুটি ফ্ল্যাট, দুই কোটি টাকা মূল্যের দুটি প্লট, চারটি বিলাসবহুল গাড়ি ও গাড়ি ব্যবসায় প্রায় দেড় কোটি টাকা বিনিয়োগের তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের ব্যাংকে নামে-বেনামে অনেক অ্যাকাউন্টে বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত থাকার কথা জানা যায়। পাপিয়া ও তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে রেলওয়ে ও পুলিশের এসআইতে চাকরির আশ্বাস দিয়ে ১১ লাখ টাকা, একটি কারখানায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেওয়ার কথা বলে ৩৫ লাখ টাকা, একটি সিএনজি পাম্পের লাইসেন্স করে দেওয়ার কথা বলে ২৯ লাখ টাকা নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর বাইরে নরসিংদী এলাকায় চাঁদাবাজি, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছে।

তিনি আরো জানান, পাপিয়ার আয়ের আরেকটি অন্যতম উৎস নারীদের দিয়ে জোরপূর্বক অনৈতিক কাজ করানো। ঢাকার বিভিন্ন বিলাসবহুল হোটেলে অবস্থান করে কম বয়সী মেয়েদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করা হতো। যাদের অধিকাংশই নরসিংদী এলাকা থেকে চাকরির প্রলোভনে ঢাকায় আনা হতো। অনৈতিক কাজে বাধ্য না হলে তাঁদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হতো।

পাপিয়ার সঙ্গে বিভিন্ন বিশিষ্টজনের ছবির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমান যুগে যদি কেউ কারো সঙ্গে ছবি তুলতে চায় তাহলে বিষয়টি সাধারণত এড়ানো যায় না। তাই কারো সঙ্গে ছবি থাকা মানেই পাপিয়ার সঙ্গে সখ্যের বিষয়টি প্রমাণ করে না।

পাপিয়ার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ : রাজধানীর গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলে প্রেসিডেন্ট স্যুট নিজের নামে সব সময় বুকড করে নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন পাপিয়া। যিনি হোটেলটির বারে প্রতিদিন পরিশোধ করতেন প্রায় আড়াই লাখ টাকার বিল। বৈধ হিসাব অনুযায়ী পাপিয়ার বার্ষিক আয় মাত্র ১৯ লাখ টাকা। অথচ ওয়েস্টিনে শুধু গত তিন মাসেই তিনি বিল পরিশোধ করেছেন প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ টাকা।

নরসিংদী এলাকার যুব মহিলা লীগের নেত্রী হয়ে তিনি চাঁদাবাজি করার জন্য গড়ে তোলেন ক্যাডার বাহিনী। বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে গিয়ে নেতাদের ফুল দিয়ে সেই ছবিরও অপব্যবহার করতেন তিনি। পাঁচতারা হোটেলে নারী ও মাদক ব্যবসাই তাঁর আয়ের মূল উৎস। দেশের ধনী কিছু মানুষ ও বিদেশিরাই এর গ্রাহক। ইন্টারনেটে এসকর্ট সার্ভিস খুলে খদ্দেরদের কাছে মেয়েদের পাঠাতেন। পাপিয়ার কাছ থেকে গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা অনেক ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তির অন্তরঙ্গ দৃশ্যের ভিডিও ক্লিপ উদ্ধার করেছেন র‌্যাব কর্মকর্তারা। এভাবে নিয়মিত ওই ধনীদের ব্ল্যাকমেইল করতেন তিনি। পাপিয়া একাধিক অভিজাত হোটেলের রুম ভাড়া নিতেন নামে-বেনামে।

গত ১২ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীর একটি পাঁচতারা হোটেলে ৫৯ দিন প্রেসিডেনশিয়াল স্যুট ভাড়া ছিল পাপিয়ার নামে। ওই ৫৯ দিনে ভাড়াবাবদ তিনি ৮১ লাখ ৪২ হাজার টাকা নগদ (ক্যাশ) পরিশোধ করেছেন। পাপিয়ার স্বামী সুমন চৌধুরী বেশির ভাগ সময় থাইল্যান্ডে অবস্থান করলেও গত থার্টি ফার্স্ট নাইটে রাজধানীর একটি পাঁচতারা হোটেলে অবস্থান করেন। ওই রাতে তাঁর কক্ষেও চার-পাঁচজন সুন্দরী নারী ছিল বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে। পাপিয়ার সব কর্মকাণ্ডের অন্যতম অংশীদার তাঁর স্বামী সুমন। একসময় নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক ছিলেন সুমন। পরে ছিলেন নরসিংদীর প্রয়াত পৌর মেয়র লোকমানের বডিগার্ড।

গত শনিবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গ্রেপ্তারের সময় র‌্যাব কর্মকর্তাদের দেখে নেওয়ার হুমকিও দেন পাপিয়া। গ্রেপ্তার করে তাঁকে র‌্যাব কার্যালয়ে নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে নানা তথ্য-প্রমাণ হাজির করা হলে অবশেষে মাথা নিচু হয় তাঁর।

যেভাবে গ্রেপ্তার হন পাপিয়া : কলকাতা যাওয়ার জন্য শনিবার সকালে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন পাপিয়া ও তাঁর স্বামীসহ চারজন। বোর্ডিং পাস নিয়ে তাঁরা ইমিগ্রেশনে ঢোকার আগ মুহূর্তে সেখানে হাজির হন র‌্যাব কর্মকর্তরা। নেতৃত্বদানকারী র‌্যাব কর্মকর্তা পাপিয়াকে বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে কথা বলা দরকার। পাপিয়া র‌্যাবের উদ্দেশে বলেন, তাঁরা ভুল করছেন। তখন নেতৃত্বদানকারী র‌্যাব কর্মকর্তা জানান, তাঁরা জেনেশুনে বুঝেই তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন। এ সময় প্রচণ্ড খেপে যান পাপিয়া। র‌্যাব সূত্র জানায়, এ সময় পাপিয়া বলেন, ‘আপনারা কার সঙ্গে কথা বলছেন জানেন। নিজেদের চাকরির মায়া নেই।’ এ সময় র‌্যাব কর্মকর্তা তাঁকে বলেন, ‘আপনাকে আমাদের সঙ্গে র‌্যাব অফিসে যেতে হবে।’ তখন পাপিয়া বলেন, ‘র‌্যাব অফিসে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ফ্লাইট ধরতে হবে।’ এ সময় পাপিয়া ইমিগ্রেশনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা চালান। কিন্তু র‌্যাব তাঁকে আটকে দেয়।

সূত্র জানায়, পাপিয়া প্রথম দিকে বেশ ক্ষমতা দেখানোর চেষ্টা করেন। তিনি মোবাইল ফোনে মন্ত্রী পর্যায়ের কাউকে ফোন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁকে র‌্যাব সদস্যরা ফোন করতে না দিয়ে আটক করে র‌্যাব-১-এর দপ্তরে নিয়ে যান। সেখানে নিয়ে যাওয়ার পর র‌্যাব তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ভিডিও চিত্র ও বিভিন্ন প্রমাণ হাজির করার পর পাপিয়া নরম হতে শুরু করেন।

Development by: webnewsdesign.com