নড়াইলে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যু

চিকিৎসক ও মালিকপক্ষ পলাতক গ্রাম্য সালিশে সাড়ে তিন লাখ টাকায় সমঝোতা

রবিবার, ০৮ মে ২০২২ | ১১:১৯ পূর্বাহ্ণ

নড়াইলে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যু
apps

নড়াইলে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যু, চিকিৎসক ও মালিকপক্ষ পলাতক গ্রাম্য সালিশে সাড়ে তিন লাখ টাকায় সমঝোতা নড়াইলের কালিয়ায় ভুল চিকিৎসায় মারা গেছেন শিউলী বেগম (২৫) নামের এক প্রসূতি।

শুক্রবার (৬ মে) কালিয়া উপজেলার নড়াগাতি থানার বড়দিয়া বাজারেহাজী খান রওশন আলী হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামেরঅনুমোদনহীন বেসরকারি হাসপাতালে এ ঘটনা ঘটে। এদিকে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আইনি ঝামেলা এড়াতে সাড়ে তিন লাখ টাকায় নিহতের পরিবারের সঙ্গে সমঝোতা করারপর ময়নাতদন্ত ছাড়াই শুক্রবার রাতেই লাশ দাফন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

ঘটনার পর থেকে অভিযুক্ত চিকিৎসক শরিফুল ইসলাম ও মালিকপক্ষ পলাতক রয়েছেন।নিহত শিউলী বেগমের বাবার বাড়ি খাশিয়াল ইউনিয়নের পেচী ডুমুরিয়া গ্রামে এছাড়া তার শ্বশুর বাড়ি পার্শ্ববর্তী গোপালগঞ্জ সদর থানার বড়ফা গ্রামে ।এদিকে, শনিবার (৭ মে) দুপুরে নড়াইল সিভিল সার্জন ডাঃ নাছিমা আকতার কালিয়াউপজেলা স্বাস্খ ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ কাজল মল্লিককে প্রধান করে দুই চিকিৎসকসহ মোট তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।গঠিত কমিটি আগামী চার কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দােিখলের নির্দেশ প্রদান করেছেন।

জানা গেছে,শুক্রবার বিকাল চারটায় বড়দিয়া বাজার সংলগ্ন মুন্সী মানিক মিয়াডিগ্রি কলেজ মাঠে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি,গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এমনকি পুলিশকর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে এক গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে সন্ধ্যায় সাড়ে তিনলাখ টাকায় বিষয়টি নিষ্পত্তি করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

ভূক্তভোগী পরিবার ওউপস্থিতিতে সালিশদাররা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। সমঝোতা হওয়ার আগে শুক্রবার দুপুরে নিহতের স্বজন ও স্থানীয় উত্তেজিত জনতা হাসপাতাল অবরুদ্ধ করে রাখে।পরে পুলিশ এসে পরিস্খিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।নিহতের পরিবারের সদস্যরা জানান সিজারিয়ানের জন্য পূর্ব নির্ধারিত দিনে১৫ হাজার টাকার চুক্তিতে শুক্রবার সকাল নয়টার দিকে ওই হাসপাতালে ভর্তি হন শিউলী বেগম।

গোপালগঞ্জ থেকে আসা কতিথ সার্জন শরিফুল ইসলাম শিউলী বেগমের সিজারিয়ান অস্ত্রপচার করার জন্য অপারেশন থিয়েটারে (ওটি) নিয়ে যায়অস্ত্রপচারের পূর্বে চিকিৎসক প্রসূতিকে অচেতন করার জন্য একটি ইনজেকশন পুশকরার সঙ্গে সঙ্গে সে ছটফট চেঁচামেচি করতে থাকেন।

এসময় তার স্বজনেরা রোগীর নিকট যাইতে চাইলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যেতে দেয়নি। এরপর সে মৃত্যুর কোলেঢলে পড়ে। মৃত্যুর বিষয়টি ধামাচাপা দিতে তড়িঘড়ি করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষরোগীর প্রেসার কমে গেছে এমন অজুহাতে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে রোগী খুলনা মেডিকেলে স্থানান্তরের নাটক সাজায়। এ সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের চালাকি আঁচকরতে পেরে নিহতের স্বামী জিন্নাত শেখ ও পিতা আকবর মোল্যাসহ তাঁর স্বজনেরাঅ্যাম্বুলেন্সে তুলতে বাধা দিলে চেঁচামেচি আর হট্টগোলের সৃষ্টি হয়।

এমনকি উভয় পক্ষের মধ্যে হাতাহাতিরও ঘটনা ঘটে। এসময় স্থানীয় উৎসুক জনতা জড়ো হলে পরিশেষে রোগীর মৃত্যুর বিষয়টি প্রকাশ পায়। এরপর হাসপাতালের প্রধান গেটে তালা লাগিয়ে দেয় কতৃপক্ষ। সেই ফাঁকে পেছন দরজা দিয়ে চিকিৎসক ও হাসপাতালেরলোকজন দ্রুত সটকে পড়ে।ক্লিনিকটিতে অচেতনবিদ (অ্যানেস্থালজিস্ট) ছিলেননা। অস্ত্রপচারের জন্য
ওই কতিথ চিকিৎসক নিজেই সেই দায়িত্বপালন করেন বলে জানা গেছে।এই ঘটনার পর নিহত প্রসূতির পরিবারের লোকজন সুবিচারের দাবিতে লাশ নিয়েহাসপাতালে অবস্থান গ্রহণ করে।জানতে চাইলে নিহতের স্বামী জিন্নাত শেখ বলেন,‘অপরাধীর বিরুদ্ধে মামলায় লড়তে গেলে আমারও দৌঁড়াতে হবে,অর্থ খরচ করতে হবে।

কিন্তু আমি একজন সামান্য ইজি বাইক চালক। সেই চিন্তা করে গ্রাম্য সালিশে অনেক দর কষাকষির মাধ্যমে অবশেষে আমার নিহত স্ত্রী ও অনাগত শিশুর লাশের বিনিময়ে তিন লাখ টাকাক্ষতি পূরণ বাবদ এবং ৫০ হাজার টাকা নিহতের মিলাদ বাবদ গ্রহণ করেছি। এটা আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজনও মেনে নিয়েছেন।একই প্রসঙ্গে নিহতের বাবা আকবর মোল্যা বলেন,শুক্রবার সকালে আমার মেয়েকহাসপাতালে ভর্তি করলে সিজার করার জন্য অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করেচিকিৎসক ইনজেকশন পুশ করে।

কিছুক্ষণ পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের না জানিয়েই রোগীর মৃত্যুর পর সেটিকে আড়াল করার জন্য অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানোরচেষ্টা করলে আমরা বাধাঁ দেই। এরপর আমার মেয়ের মৃত্যুরবিষয়টি জানতে পারি।আমরা গরীব মানুষ মামলা চালানোর সামর্থ নেই। বিধায় আমার নাতনির ভবিষ্যতেরকথা চিন্তা করে সাড়ে তিন লাখ টাকায় হাসাপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমঝোতাহয়েছে।

সালিশদার মশিউর রহমান জানান,শুক্রবার বিকাল চারটার দিকে মুন্সী মানিক মিয়া ডিগ্রি কলেজ চত্ত্বরে স্থানীয় পর্যায়ে খাশিয়াল ইউপি সদস্য জিন্নাত, ঈমান শেখ ও জয়নগর ইউপি সদস্য রুবেল চৌধুরী,ভূক্তভোগী পরিবার ওহাসপাতাল কর্তৃপক্ষের লোকজনসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এমনকি পুলিশের এসআই মিলন এবং এএসআই জাহাঙ্গীর উপস্থিতিতে এক গ্রাম্য সালিশ বৈঠক বসে।

প্রকৃতপক্ষে নিহতের স্বামী এবং বাবা উভয়েই নিতান্ত গরীব মানুষ।ভূক্তভোগীপক্ষ গরীব বিধায় নিহতের নাবালক শিশু জামিলার (৪) ভবিষ্যতের জন্য নগদ সাড়ে তিন লাখ পরিশোধের মাধ্যমে সালিশনামায় উভয়পক্ষ নাম দস্তখত করে মীমাংসা করা হয়।নড়াগাতি থানার অফিসার ইনচার্জ শুকান্ত কুমার সাহা জানান,পুলিশের উপস্থিতিতে গ্রাম্য সালিশ বৈঠক মীমাংসার বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত নই।তবে,খবর পেয়ে ঘটনা স্থলে পুলিশ পাঠায়। তারা গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। মৃত্যুর ঘটনায় এখনও রোগীর পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ আসেনি।

অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।জানতে চাইলে হাজী খান রওশন আলী হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারেরম্যানেজার অনুপ দাস বলেন,বিষয়টি মীমাংসা হয়েছে। তবে এর বাইরে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।এ ব্যপারে মতামত জানতে হাজী খান রওশন আলী হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিকসেন্টারের মালিক খান শাহীন সাজ্জাদ ওরফে পলাশের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলে পরিচয় পাওয়ার পর লাইন কেটে বন্ধ করে রাখেন।

এ প্রসঙ্গে নড়াইল সিভিল সার্জন ডাঃ নাছিমা আকতার বলেন,‘ ভুল চিকিৎসায়মৃত্যুর বিষয়টি খতিয়ে দেখতে কালিয়া উপজেলা স্বাস্থ ও পরিবার পরিকল্পনাকর্মকর্তা ডাঃ কাজল মল্লিককে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্তকমিটি গঠন করে আগামী চার কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দােিখলের নির্দেশপ্রদান করা হয়েছে।

হাজী খান রওশন আলী হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিকসেন্টার নামের বেসরকারি হাসপাতালটি অনুমোদনের জন্য আবেদন করলেও তাঅনুমোদন দেয়া হয়নি বলেজানান তিনি।স্থানীয়রা জানান, অব্যবস্পথনা আর অনিয়মে জর্জরিত অনুমোদনহীন ওই হাসপাতালসার্বক্ষণিক নেই কোনো চিকিৎসক। নেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স।অপারেশনখিয়েটার একেবারেই নাজুক। তারপরও সেখানে চলছে অস্ত্রপচার।

Development by: webnewsdesign.com