দেশের প্রধান খাদ্যশস্য চাল কেজিতে দুই টাকা বাড়লেও তা ভোক্তার ওপর চাপ বাড়ায়। বিশেষ করে এই চাপ নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ওপর পড়ে বেশি। এই সময় দেশে বাড়ছে বেশি সেই চালের দাম। এক থেকে দেড় সপ্তাহে পাইকারি ও খুচরা বাজারে চালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ছয় টাকা পর্যন্ত। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, গত ছয় মাসে জাতীয় মূল্যস্ফীতির চেয়ে চালের মূল্যস্ফীতি দ্বিগুণেরও বেশি ছিল।
বাজার ঘুরে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আমন মৌসুমের ধান থেকে মূলত স্বর্ণা, গুটি স্বর্ণা ও আঠাশ, ঊনচল্লিশ ইত্যাদি চাল উৎপাদন হয়। এসব চাল তুলনামূলক মোটা হওয়ায় মধ্যবিত্ত পরিবারে বিশেষ করে শহরাঞ্চলে খুব একটা চাহিদা নেই। ফলে আমন মৌসুমে সরু বা মাঝারি মানের চালের বাজারে খুব একটা প্রভাব পড়ছে না। তার পরও আমন মৌসুম চালের বাজারে দামের রাশ টেনে ধরতে বেশ ভূমিকা রাখে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের বড় বড় কম্পানি চালের ব্যবসায় এসেছে। উৎপাদিত ধানের বড় একটি অংশ মজুদ করছে তারা। আগের অটোরাইস মিল তো আছেই। সব মিলিয়ে চালের সরবরাহে মিলার ও বড় ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ আরো বেড়েছে। যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব দ্রুত পড়ছে বাজারে। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে টানা চার-পাঁচ দিন বৃষ্টি হয়েছে। এতে আমনের কিছু ক্ষতি হয়েছে। অনেকে সময়মতো ধান তুলতে পারেননি। এই সুযোগে ব্যবসায়ীরা চালের দাম কেজিপ্রতি দুই থেকে ছয় টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে মিনিকেট, নাজিরশাইল, ভালোমানের আটাশসহ সরু চালের দাম। এসব চাল বোরো মৌসুমের বিভিন্ন ধান থেকে আসে।
তবে চালের দাম বাড়ার আরো কিছু কারণ বলছেন সরবরাহকারীরা। তাঁরা বলছেন, পরিবহন ব্যয় বাড়ায় প্রতি কেজিতে সরবরাহ খরচ বেড়েছে ২০ থেকে ৩০ পয়সা। এ ছাড়া সরকারের ধান ক্রয়ের কারণে বাজারে ধানের দাম বেড়েছে। দক্ষিণাঞ্চলে এখনো ৫০ শতাংশ আমন ধান উঠতে বাকি, এতে ধানের পর্যাপ্ত সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সপ্তাহখানেক আগে বাবুবাজারে পাইকারিতে ভালো মানের নাজিরশাইলের কেজি বিক্রি হয়েছে ৬২ টাকা। বর্তমানে ছয় টাকা বেড়ে ৬৮ টাকা হয়েছে। কিছুটা কম মানের নাজিরশাইল চাল পাওয়া যেত ৫৪ থেকে ৫৫ টাকায়। বর্তমানে তা ৬০ টাকা কেজি। ভালো মানের মিনিকেটের কেজি ছিল ৫৬ টাকা কেজি, বর্তমানে ৫৯ টাকা কেজি। কেজিতে বেড়েছে তিন টাকা। কিছুটা কম মানের মিনিকেট পাইকারিতে দুই টাকা বেড়ে ৫৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আঠাশ ও ঊনপঞ্চাশ নামের মাঝারি মানের চাল আগে পাইকারিতে বিক্রি হতো ৫০ টাকা, বর্তমানে ৫২ থেকে ৫৪ টাকায় উঠেছে। স্বর্ণা, গুটিসহ মোটা চালের কেজি আগে ছিল ৪০ টাকা। এখন বেড়ে ৪২ টাকা হয়েছে।
বাংলাদেশ রাইস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি কাউছার আলম খান বাবলু বলেন, ‘চালের ব্যবসায়ী এখন আর শুধু ছোট মিলগুলো নেই। বড় ব্র্যান্ড কম্পানিও চালের ব্যবসায় নেমেছে। ফলে ধান মজুদের পরিমাণ বেড়েছে। শহরের পাশাপাশি গ্রামেও এখন সরু চালের চাহিদা বেড়েছে। তবে কয়েক দিন টানা বৃষ্টির কারণেই হঠাৎ চালের দাম বেড়েছে। সপ্তাহ দুয়েক পরে দাম কমে আসতে পারে।’
গতকাল সেগুনবাগিচা বাজারে ভালো মানের মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৬৬ থেকে ৬৮ টাকা কেজিতে। কিছুটা কম মানের মিনিকেট ৬৪ থেকে ৬৬ টাকা কেজি। আগে প্রতি কেজিতে চার টাকা কম ছিল। এই বাজারে নাজিরশাইল দুই থেকে চার টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬৮ থেকে ৬৯ টাকায়। মানভেদে কাটারিভোগ দুই টাকা বেড়ে ৭০ থেকে ৭২ টাকা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রশিদ অ্যাগ্রো, দাদা, এরফান, মোজাম্মেল, গাজী অটোরাইস এবং শিল্পগোষ্ঠীর মধ্যে আকিজ, সিটি, এসিআই, ভিওলা, রূপচাঁদা, প্রাণ, এসিআই, স্কয়ারসহ কয়েকটি কম্পানি চালের ব্যবসা করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রাণ ও সিটি গ্রুপের চালের মিল আছে। তবে আকিজ গ্রুপ বিভিন্ন মিল থেকে চাল উৎপাদন ও বাজারজাত করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে জাতীয় মূল্যস্ফীতির চেয়ে চালের মূল্যস্ফীতি ছিল দ্বিগুণেরও বেশি। কখনো কখনো তা তিন গুণের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে গড় মূল্যস্ফীতির হার সর্বোচ্চ উঠেছিল জুনে। ওই সময় গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫.৬৪ শতাংশ। একই সময় চালের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১৫.১৮ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) চলতি মাসের ‘খাদ্যশস্য : বিশ্ববাজার ও বাণিজ্য’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০-২১ বাণিজ্য বছরে বাংলাদেশ ২৬ লাখ ৫০ হাজার টন চাল আমদানি করেছে, যা চাল আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ৪৫ লাখ টন আমদানি করে প্রথম চীন। তবে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, গত জুলাই থেকে ১৮ ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত মাত্র ১৫ লাখ টন চাল দেশে আমদানি হয়েছে। ২৬ লাখ টন চাল আমদানির আইপিও দেওয়া হয়েছে। তাই আমদানির তথ্যটি ঠিক নয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপে উঠে এসেছে, দেশে খানাপিছু গড় মাসিক আয় ১৫ হাজার ৯৪৫ টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৪৮ শতাংশই যায় খাদ্য কেনায়। দরিদ্র ও প্রান্তিক পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে মাসিক মোট আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় হয় খাদ্যের পেছনে। এই খাদ্যের বেশির ভাগই চাল। দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চালের মাথাপিছু দৈনিক ভোগ ৪৭০ গ্রাম, যেখানে অন্যদের ক্ষেত্রে তা ৩৬৬ গ্রাম। প্রধান খাদ্যশস্যটির মূল্যস্ফীতির বোঝাও তাদের ঘাড়ে চাপে বেশি।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, এখন অটোমিল ও করপোরেট প্রতিষ্ঠান চালের দাম নির্ধারণ করে দেয়। ধান মজুদের নীতিমালায় পরিবর্তন আনা দরকার। এ ছাড়া সব গুদামেই ধানের মজুদসংক্রান্ত তথ্য সরকারের কাছে থাকা উচিত। সরকারি গুদামে ধান-চালের মজুদ বাড়াতে হবে।
Development by: webnewsdesign.com