রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার হাট-কানপাড়া জোবেদা ডিগ্রি কলেজে কম্পিউটার শিক্ষা (প্রভাষক) পদে শিক্ষক নিয়োগে তথ্য গোপন ও জালিয়াতির আশ্রয় নেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
জানা যায়, নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম স্থানে থাকা ব্যাক্তিকে নিয়োগ না দিয়ে দ্বিতীয় স্থানে থাকা অপর এক ব্যাক্তিকে তথ্য গোপন ও জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ দেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। তবে ১৮ বছর পর এসে নিয়োগ সংক্রান্ত সেই নথি ফাঁস হওয়ায় ওই এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। নিয়োগ সংক্রান্ত সেই নথির ফাঁস হওয়া কিছু কাগজপত্র এ প্রতিবেদকের হাতেও এসেছে।
নিয়োগ সংক্রান্ত সেই নথির কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দুর্গাপুর উপজেলার হাট-কানপাড়া জোবেদা ডিগ্রি কলেজে ডিগ্রি ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যাযা সরকারি বিধি ও বেতন ক্রমে কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ আনিসুর রহমান ২০০২ সালের ২২ জানুয়ারি রাজশাহী থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিক পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে যোগ্য প্রার্থীদের কাছ থেকে দরখান্ত আহবান করেন।
ওই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির সংশোধনী এনে দর্শন বিভাগে ১ জন, ইসলামের ইতিহাস বিভাগে ১ জন, অর্থনীতি বিভাগে ২ জন, ইসলামী শিক্ষা বিভাগে ১ জন, কম্পিউটার শিক্ষা বিভাগে ১ জন, পরিসংখ্যান বিভাগে ২ জন, ফিন্যান্স বিভাগে ১ জন ও কম্পিউটার প্রদর্শক পদে ১ জনকে নিয়োগ দিতে একই পত্রিকায় ২৮ জানুয়ারি আরও একটি বিজ্ঞপ্তি দেন।
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী কম্পিউটার শিক্ষা (প্রভাষক) পদে ৮টি আবেদন বৈধ পেয়ে আবেদনকারীদের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে চিঠি দেন অধ্যক্ষ আনিসুর রহমান। ২০০৩ সালের ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ওই পরীক্ষায় ৬ জন প্রার্থী অংশ নিলেও পরীক্ষায় ৫০ নম্বরের মধ্যে ৩০ পেয়ে প্রথম হন জিয়াউর রহমান নামের একজন। ২৯ পেয়ে দ্বিতীয় হন আহসান হাবীব। এছাড়া জুলফিকার আলী ভুট্টো ২৭, রবিউল ইসলাম ২৬, আতাউর রহমান ২৩ ও আব্বাছ আলী পান ২২ নম্বর।
চুড়ান্ত নম্বরপত্রে স্বাক্ষর করেন তৎকালীন নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি ও কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি আব্দুল করিম মোল্লা, সরকারের প্রতিনিধি রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ প্রফেসর শিরীন সুফিয়া খানম, একই কলেজের আরও একজন প্রভাষক সহ কলেজ পরিচালনা পর্ষদের আরও ৮ জন সদস্য এবং অধ্যক্ষ আনিসুর রহমান।
ফাঁস হওয়া নথি দেখে জানা গেছে, কম্পিউটার শিক্ষা (প্রভাষক) একটি পদের বিপরীতে দুইজনকে নিয়োগ দেয়া হয়। একই দিন একই সাথে জিয়াউর রহমান ও আহসান হাবীব নামের দুই ব্যাক্তিকে নিয়োগপত্র দেয়া হয়। আবারও এই দু’জনকেই ২০০৩ সালের ২৮ এপ্রিল যোগদান করানো হয় কলেজে। কিন্তু বেতন-ভাতার কাগজ পাঠানোর সময় পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা আহসান হাবীবকে প্রথম দেখিয়ে কাগজপত্র পাঠানো হয় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। ফলে আহসান হাবীব বেতন-ভাতা পেয়ে আসলেও জিয়াউর রহমান এখনো রয়েছেন বেকার।
জিয়াউর রহমান বলেন, আমাকে নিয়োগ দেয়ার পরে আমি নিয়মিত কলেজে যাতায়াত করি এবং পাঠদানে অংশ নিই। হঠাৎ একদিন জানতে পারি একই পদে আহসান হাবীব নামের আরও একজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কলেজ অধ্যক্ষের সাথে কথা বললে তিনি আমাকে বলেন, আহসান হাবীব প্রথম স্থান অধিকার করেছেন।
যেহেতু উক্ত পদে একজনের বেতন-ভাতা করা সম্ভব সেহেতু আহসান হাবীবের বেতন-ভাতা করা হবে। আপনার আর কলেজে আসার দরকার নাই, দরকার হলে পরবর্তীতে আপনাকে জানানো হবে। এরপরে গত ১৮ বছরে মোট ১৭ বার আমাকে উক্ত পদে পুনর্বহালের জন্য কলেজ অধ্যক্ষ সহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করি। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাইনি।
জিয়াউর রহমান অভিযোগ করেন, রাজনৈতিক ভাবে অধ্যক্ষ আনিসুর রহমান ছিলেন বিএনপি ঘোরানার মানুষ। তার এক ভাই উপজেলা জামায়াতের আমীর ছিলেন। ওই সময় বিএনপির সাংসদ নাদিম মোস্তফার আশীর্বাদপুষ্ঠ ছিলেন অধ্যক্ষ আনিসুর। রাজনৈতিক প্রভাবে অনেক বৈধ বিষয়কে অবৈধ করেছেন। আবার অনেক অবৈধ বিষয়কে করেছেন বৈধ।
আমিও সেই প্রভাবের যাঁতাকলেই পিষ্ঠ হয়েছি। অনেক আশা নিয়ে চাকুরীতে যোগদান করেছিলাম। কিন্তু তথ্য গোপন করে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে আমি প্রথম হওয়া সত্বেও আমাকে দ্বিতীয় দেখান অধ্যক্ষ আনিসুর রহমান।
জিয়াউর রহমান আরও বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, রাজশাহী জেলা প্রশাসক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড রাজশাহীর চেয়ারম্যান, দুদকের রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে বিষয়টি নিয়ে লিখিত ভাবে অভিযোগ করেছি। তাতে ফল না পেলে আইনী প্রক্রিয়ায় যাবো।
এ প্রসঙ্গে মুঠোফোনে জানতে চাইলে কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ আনিসুর রহমান বলেন, আমি ভ্রমণের জন্য কক্সবাজারে আছি। যা করেছি বিএনপির তৎকালীন সাংসদ নাদিম মোস্তফার চাপে করেছি। তবে মোবাইল ফোনে এ বিষয়ে বেশি কথা বলবেন না জানিয়ে সাক্ষাতে কথা বলতে বলেন।
কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার সোহেল রানা বলেন, সম্প্রতি আমি এখানে যোগদান করেছি। লিখিত অভিযোগের কপি পেলে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে জানা গেছে, নিয়োগ কমিটি ও কলেজ পরিচালনা পর্ষদের তৎকালীন সভাপতি আব্দুল করিম মোল্লা অনেক আগেই মারা গেছেন। তাছাড়া ১৮ বছর আগের সেই নিয়োগ কমিটির অন্যান্য সদস্যদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও অনেকের হদিস পাওয়া যায়নি। আবার কারো কারো সাথে যোগাযোগ করাই সম্ভব হয়নি।
Development by: webnewsdesign.com