ভারতের রাজধানী দিল্লিতে মুসলমানদের ওপর চালানো সহিংসতার প্রতিবাদে ঢাকায় বিক্ষোভের ডাক দিয়েছিল কয়েকটি ইসলামিক দল।
শুক্রবার জুমার নামাজের পর বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে এ কর্মসূচি পালিত হয়। এতে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সহ সভাপতি ও ঢাকা মহানগরীর আমির আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী নেতৃত্ব দেন।
৬টি দল এই বিক্ষোভে অংশগ্রহন করে। ৬টি দল হচ্ছে- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী ঐক্য আন্দোলন এবং বাংলাদেশ মুসলিম লীগ।
বিক্ষোভে বলা হয়, ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদি গোষ্ঠি সে দেশের সাম্প্রদায়িক সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলমানদের উপর জুলুম নির্যাতনের যে নীল নকশা তৈরি করেছে, তার বিরুদ্ধে শান্তিকামী জনতা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কঠোর প্রতিরোধ গড়ে না তুললে বিশ্বশান্তির জন্য বিপর্যয় বয়ে আনবে।
দিল্লি এখন সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও দাঙ্গার আগুনে জ্বলছে। হিন্দুত্ববাদীরা মুসলমানদের রক্ত ঝরাতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম ঘটনাও ঘটছে। মুসলমান প্রতিবেশীদের বাঁচাতে গিয়ে জীবন বিপন্ন করেছেন এক হিন্দু যুবক।
প্রেমকান্ত বাঘেল নামের ওই ভারতীয় দিল্লির শিব বিহার এলাকার বাসিন্দা। তিনি জ্বলন্ত ঘরে আটকে পড়া প্রতিবেশী ছয় মুসলমানকে বাঁচিয়েছেন। এই কাজ করতে গিয়ে শরীরের ৭০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে তার। কজেই এখন তাকে মৃত্যুর সঙ্গেই লড়তে হচ্ছে।
টানা চারদিনের দাঙ্গায় এখন পর্যন্ত ৩৮ জন নিহত হয়েছেন। আহত হন আরও কয়েকশ।
ইন্ডিয়া টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রেমকান্ত যখন প্রতিবেশী মুসলমানদের ঘর পুড়তে দেখেন তখন তিনি তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে যান। তিনি বলেন, শিব বিহারে হিন্দু-মুসলমানরা সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করে, কিন্তু এই দাঙ্গা এক ভিন্ন চিত্র নিয়ে এসেছে।
দুর্বৃত্তরা পেট্রোল বোমা ছুড়ে মুসলমানদের ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। ঘটনাটি জানার সঙ্গে সঙ্গে ওই সব ঘরে আটকে পড়াদের উদ্ধার করতে ছুটে যান প্রেমকান্ত।
নিজের জীবন বিপন্ন করে ছয় প্রতিবেশীকে বাঁচান তিনি। জ্বলন্ত ঘরের মধ্যে আটকাপড়া খুব ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর বৃদ্ধা মাকে বের করতে গিয়ে পুড়ে যান।
এই ঘটনার পর দগ্ধ প্রেমকান্ত বাঘেল হাসপাতালে যাওয়ার জন্য কোনো গাড়ি পাননি। প্রতিবেশীরা অ্যাম্বুলেন্স ডাকলেও তা আর পৌঁছায়নি। দগ্ধ শরীর নিয়ে সারা রাত ঘরের মধ্যে কাটাতে হয় তাকে।
সকালে তাকে নিয়ে দিল্লির জি টি বি হাসপাতালে ভর্তি করেন বন্ধু-স্বজনরা। সেখানে বার্ন ইউনিটে তার চিকিৎসা চলছে। নিজের এই অবস্থা হলেও প্রেমকান্ত বাঘেল বলেন, বন্ধুর মায়ের জীবন বাঁচাতে পেরে তিনি খুশি।
দিল্লিতে ভয়াবহ এই সন্ত্রাস থেকে বাঁচতে ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালানো মুসলিমদের আশ্রয় দিতে খুলে দেওয়া হয়েছে গুরুদুয়ারার দরজা।
এদিকে উত্তরপূর্ব দিল্লির স্থানীয় একটি মসজিদ থেকে নামাজ আদায় করে ফিরছিলেন মোহাম্মদ জোবায়ের। তখন একটি বিশাল ভিড়ের সামনে পড়েন যান। ঝামেলা এড়াতে তিনি আন্ডারপাসের দিকে মুখ করে এগিয়ে যান।
কিন্তু ভুলটা হয়েছে সেখানেই। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একদল তরুণ তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। বাঁশের লাঠি ও লোহার রড দিয়ে তাকে এলোপাতাড়ি পেটাতে থাকেন। বেদম পিটুনিতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তার মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়। সারা শরীর রক্তে ভিজে যায়। সাদা পাঞ্জাবি রক্তে লাল হয়ে যায়।
আঘাত এতটাই প্রচণ্ড ছিলেন যে, ধরে নিয়েছিলেন তিনি মারা যাচ্ছেন। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে এমন তথ্য জানা গেছে।
রাজধানীর অন্য প্রান্তে নিজের এক আত্মীয়ের বাড়িতে বসে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনার বিবরণ দেন জোবায়ের। সোমবার মাঝদুপুরে এই হামলা হয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের আলোকচিত্রীর ক্যামেরায় সেই দৃশ্য ধরা পড়ে।
দিল্লির যে এলাকায় এই সহিংসতা হয়েছে, তার কাছেই হিন্দু ও মুসলমান বিক্ষোভকারীরা পরস্পরের প্রতি ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও লাঠিসোটা নিয়ে হামলা চালান।
কিন্তু জোবায়েরের ওপর যেখানে হামলা হয়েছে, সেখানে কিছুই ঘটেনি। পুরো এলাকা ছিল শান্ত ও নীরব। কোনো উসকানি ছাড়াই হিন্দুত্ববাদী স্লোগান দিয়ে নিরস্ত্র একটা মানুষের ওপর তারা ঝাঁপিয়ে পড়েন। আর এটা ঘটেছে কেবল তিনি মুসলমান হওয়ার কারণেই।
এতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার লাগাম ধরা যে কতটা কঠিন হয়ে পড়েছে, সেই আভাসই মিলছে।
রয়টার্সকে জোবায়ের বলেন, তারা আমাকে একা পেয়ে বসেছিল। আমার মাথায় টুপি, দাড়ি ও পরনে সালওয়ার-কামিজ ছিল। আমি মুসলমান, চেহারা দেখেই তারা বুঝতে পেরেছে।
‘তারা স্লোগান দিচ্ছিল, আর আমাকে পেটাচ্ছিল। এটা কী ধরনের মানবতা!’
হিন্দুত্ববাদীরা মোহাম্মদ জোবায়েরের ওপর চড়াও হলে এভাবেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। তারা মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়। ছবি: রয়টার্সের
বিজেপির মুখপাত্র তাজিন্দর পাল সিং বাগ্গা বলেন, জুবায়েরের ওপর হামলা কেন, তারা দল কোনো সহিংসতায় সমর্থন করছে না। মূলত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সফরের সময় ভারতের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করতেই বিরোধী দল এই সহিংসতা উসকে দিয়েছে।
তিনি বলেন, এটা শতভাগ পূর্বপরিকল্পিত। এই সহিংসতার সঙ্গে তার দলের কোনো সম্পর্ক নেই।
কিন্তু এই বিক্ষোভ পূর্বপরিকল্পিত কিনা; স্বতন্ত্রভাবে সেটা প্রমাণ করতে পারেনি রয়টার্স।
বিজেপি মুখপাত্র বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন করতে যাচ্ছে সরকার। আমি মনে করি, ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
তবে এই হামলা নিয়ে দিল্লি পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হিন্দুত্ববাদী কর্মসূচিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন। এতে তার উগ্র সমর্থকরা উৎসাহিত হয়েছেন। পরমাণু শক্তিধর দেশটির আশি শতাংশই হিন্দু ধর্মাবলম্বী।
মোদির হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডায় অস্তিত্বের সংকটে পড়েছেন ভারতের ১৮ কোটি মুসলমান। দেশটি এখন হিন্দু-মুসলমানে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এখন তারা পরস্পরের মুখোমুখি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মেরুকরণে ভারতের ইতিহাসের অতীতের অন্ধকারময় অধ্যায়ের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ যুগেন্দ্র যাদব বলেন, দিল্লির একটি ছোট্ট এলাকায় এই সহিংসতা হয়েছে। কিন্তু এটা ১৯৮৪ সালের শিখ দাঙ্গাকে সামনে নিয়ে এসেছে।
তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রিরা গান্ধীকে হত্যার পর শিখদের ওপর এভাবে হামলার ঘটনার কথাই তিনি স্মরণ করিয়ে দেন। দিল্লিসহ বিভিন্ন শহরে কয়েক হাজার শিখকে হত্যা করা হয়েছে। তদন্তকারীরা যেটাকে সুসংগঠিত সহিংসতা হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
হামলার পর জোবায়ের অচেতন হয়ে পড়লে দাঙ্গাকারীদের পাথর নিক্ষেপ করে তাড়িয়ে দিয়ে তাকে উদ্ধার করেন স্থানীয় মুসলমানরা। ৩৭ বছর বয়সী এই ভারতীয় বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসার পর তিনি ছাড়া পান। আমি বেঁচে ফিরতে পারবো, এমনটা কল্পনাই করিনি। কেবল আমার আল্লাহকে স্মরণ করছিলাম।
এদিকে নরেন্দ্র মোদীর ‘শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের’ আহ্বান সত্ত্বেও থামেনি দিল্লির দাঙ্গা, উত্তরপ
Development by: webnewsdesign.com