থানার তদন্তে আত্মহত্যা, পিবিআই বের করল হত্যারহস্য

সোমবার, ০৯ মে ২০২২ | ১:৩৬ অপরাহ্ণ

থানার তদন্তে আত্মহত্যা, পিবিআই বের করল হত্যারহস্য
apps

পুরান ঢাকার ওয়ারী থেকে ২০ বছর বয়সী রেশমা নামে এক গৃহবধূর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। থানার তদন্তের প্রায় ছয় মাস পর আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা। এখানে বলা হয়, ওই গৃহবধূ দাম্পত্য কলহের জেরে আত্মহত্যা করেছেন। আর আত্মহত্যার প্ররোচনায় তার স্বামীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আদালত এর অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) পাঠায়। এখানেও ছয় মাস পর সংস্থাটির তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে একটি সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করেন। এই তদন্তে বেরিয়ে আসে রেশমা আত্মহত্যা করেননি। তাকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।

এ হত্যায় জড়িত থাকায় তার স্বামী রবিনকে অভিযুক্ত করা হয়।এ দুই ধরনের তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, প্রথম তদন্তটি হয়তো ভুলভাবে করা হয়েছে, নয় তো তদন্ত কর্মকর্তার অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল। ২০২০ সালের ২৮ জুন ওয়ারীর গোয়ালঘাট লেনের ৫৮ নম্বর বাড়ির ষষ্ঠ তলা থেকে রেশমার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই দিনই রেশমার বাবা মনু হাওলাদার ওয়ারী থানায় মেয়েজামাই রবিন হোসেনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন।

মামলা এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আড়াই বছর আগে তাদের না জানিয়ে রেশমা আর রবিন ভালোবেসে বিয়ে করে। বিয়ের পর থেকে তারা ঢাকায় বসবাস করছিল। মৃত্যুর আগের দিন দুপুরে রেশমা আমাকে ফোন করে জানায়, পারিবারিক কলহের জেরে রবিন তাকে মারধর করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় মধ্যরাতে ওড়না দিয়ে রেশমাকে শ্বাস রোধে হত্যার পর লাশ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে রবিন। হত্যার সময় রেশমা বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করে। চিৎকার শুনে পাশের বাড়ির তাছলিমা (৫০) নামে এক নারী জানালা দিয়ে দেখার চেষ্টা করেন। ওই নারী ঘটনাটি বাড়ির মালিককে জানান।

পরে বাড়িওয়ালাসহ অন্যরা রবিনের বাসার দরজা ধাক্কাতে থাকেন এবং খোলার জন্য বলেন। একই বাড়ির পঞ্চম তলায় থাকা রবিনের ভাই রিপন এসেও ডাকাডাকি করলে রবিন দরজা খোলে। পরে রিপন সিলিং ফ্যানের সঙ্গে রেশমাকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পায়। রিপন ও রবিন ঝুলন্ত অবস্থা থেকে রেশমার লাশ নিচে নামায়।’ খবর পেয়ে ওয়ারী থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশের সুরতহাল প্রস্তুত করে এবং ময়নাতদন্তের জন্য লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে পাঠায়। প্রথমে মামলাটি তদন্ত করেন ওয়ারী থানার এসআই রঞ্জিত সরকার। পরে এর তদন্তভার দেওয়া হয় একই থানার এসআই আবদুল খালেক মিয়াকে। তিনি গত বছর ২৭ জানুয়ারি আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন।

চার্জশিটে তিনি উল্লেখ করেন, রেশমার লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেছেন ঢাকা মেডিকেলের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক ডা. প্রদীপ বিশ্বাস। ২০২০ সালের ২৪ ডিসেম্বর তিনি ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পান। এ প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসআই আবদুল খালেক মিয়া বলেছেন, রেশমা আর আসামি রবিন সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী হওয়ায় প্রায়ই তাদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি লেগে থাকত। রবিন প্রতিনিয়ত রেশমাকে মানসিক নির্যাতন করে কথায় কথায় গলায় ফাঁস নিয়ে মরে যাওয়ার কথা বলতেন। রবিনের প্ররোচনায় রেশমা সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।

এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় এসআই আবদুল খালেক মিয়ার সঙ্গে। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন অনুযায়ী আমি আত্মহত্যার কথা উল্লেখ করেছি। ডাক্তারের দেওয়া প্রতিবেদনের বাইরে তো আমরা যেতে পারি না। তবে পিবিআই কীভাবে হত্যা পেল সে বিষয়ে তাদের কাছ থেকে আপনি ব্যাখ্যা নিন।’ মামলার বাদী মনু হাওলাদার বলেন, ‘থানার এ চার্জশিট সঠিক হয়নি মর্মে আমরা আদালতে নারাজি দিই। এরপর আদালত অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআইতে পাঠানোর আদেশ দেয়।’ অনুসন্ধানে জানা যায়, পিবিআইর অর্গানাইজড ক্রাইম দক্ষিণের পরিদর্শক রওশন আলী গত বছর ২ ডিসেম্বর আদালতে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করেন।

২৬ ডিসেম্বর আদালত তা গ্রহণ করে। এ চার্জশিটে তিনি উল্লেখ করেন, আসামি রবিন ঝগড়াঝাঁটির একপর্যায়ে ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যার চেষ্টা করার সময় রেশমা ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করেন। রেশমা শারীরিকভাবে দুর্বল হওয়ায় অজ্ঞান হয়ে যান। এরপর রবিন ওড়না নিয়ে চালের ড্রামের ওপর উঠে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে রেশমাকে ঝুলিয়ে দিয়ে নিচে নেমে আসেন। সেখানে শ্বাসরোধে রেশমার মৃত্যু হয়।

পরিকল্পিতভাবে ঝুলিয়ে দেওয়ায় রেশমার ঘাড়ের জয়েন্টে স্থানচ্যুতি হয়নি। আর আত্মহত্যার নাটক সাজানোর জন্য রবিন চালের ড্রাম মেঝেতে ফেলে রেখে চাল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখেন। এ ছাড়া ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, সাধারণত আত্মহত্যায় কারও মৃত্যু হলে তার ঘাড়ের হাড়ের জয়েন্টে স্থানচ্যুতি হয়ে থাকে। কিন্তু রেশমার ক্ষেত্রে স্থানচ্যুতি হয়নি। ঘটনার দিন রাত দেড়টা থেকে ২টার মধ্যে আসামি রবিন স্ত্রী রেশমাকে ওড়না দিয়ে শ্বাস রোধের চেষ্টা করলে রেশমা ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে তিনবার চিৎকার করেন। চিৎকার শুনে পাশের বাসিন্দা ইমরান, তার মাসহ অন্যরা রবিনের ঘরের দরজায় প্রবল ধাক্কাধাক্কি করেন। রবিন আত্মহত্যার নাটক সাজাতে ব্যস্ত থাকায় ১০-১৫ মিনিট পর দরজা খোলেন। এ ছাড়া চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে, আত্মহত্যার আগে কেউই ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করবে না।

পিবিআইর তদন্ত কর্মকর্তা রওশন আলী এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘পূর্বে তদন্ত কর্মকর্তা তার মতো করে তদন্ত করেছেন। তবে আমরা সব দিক বিশ্লেষণ করে তদন্ত করেছি এবং তদন্তের সবকিছুর যুক্তি তুলে ধরেছি। আমি মনে করি আমাদের তদন্তই সঠিক। বাকি সব বিচার করবে আদালত।’ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এখানে অবশ্যই আগের তদন্তটি ভুল ছিল। আগের তদন্ত কর্মকর্তা হয়তো ভুলভাবে তদন্ত করেছেন। আর নানা ক্ষেত্রে নানাভাবে তদন্ত ভুল হতে পারে। এ কারণে অধিকতর তদন্তের সুযোগ থাকে। এ ক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তার উদ্দেশ্য খারাপও থাকতে পারে। পিবিআইর প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, সব ক্ষেত্রে থানা ভুল তদন্ত করে না। অনেক মামলা থানা তদন্ত করে এবং ভালো রিপোর্টও দেয়। এ ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে সেটা মেধা, বুদ্ধি ও নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়। আগের তদন্ত কর্মকর্তাকে যেভাবে লিড করা হয়েছে তিনি সেভাবে তদন্ত করেছেন।

Development by: webnewsdesign.com