রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সামসুল ইসলামকে ৩ ঘণ্টা ধরে বেধড়ক মারধর করে ছাত্রলীগ নেতা ভাস্কর সাহা। এ সময় ‘তোরও আবরারের মতো অবস্থা হবে’ বলে হুমকি দেন ওই ছাত্রলীগ নেতা। এ ঘটনা প্রচার হলে সামসুল ইসলামের কাছে ওই ছাত্রলীগ নেতা ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন বলে জানা গেছে।ছাত্রলীগ নেতাদের চাপে নিজের নিরাপত্তার বিষয়টি চিন্তা করেই নির্যাতিত শামসুল সমঝোতা করে নিয়েছেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বিষয়টি সমাধান হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন। তবে তিনি নাম প্রকাশ করতে চাননি।
তবে তদন্ত কমিটির প্রধান সহকারী প্রক্টর আরিফুর রহমান জানিয়েছেন, বিষয়টি সমঝোতা হয়েছে কিনা- তা তার জানা নেই।এদিকে নির্যাতনকারী মতিহার হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর সাহার বিরুদ্ধে সিট বাণিজ্যর চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি রাবি ছাত্রলীগের সাধারণ ফয়সাল আহমেদ রুনুর অনুসারী বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।এর আগে ছাত্রলীগ নেতা ভাস্কর সাহা অর্থনীতি বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ও মতিহার হলের ২৩২ নম্বর কক্ষের আবাসিক ছাত্র সামসুল ইসলামের কাছে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা দিতে দেরি করায় শুক্রবার ফোন দিয়ে হলের ২০২ নম্বর কক্ষে শামসুল ইসলামকে ডেকে নেন ছাত্রলীগ নেতা ভাস্কর। এরপর বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত লোহার রড এবং স্ট্যাম্প দিয়ে সামসুলকে বেধড়ক পেটান ভাস্কর এবং তার অপর দুই সহযোগী। তার কাছ থেকে জোরপূর্বক কেড়ে নেন ২০ হাজার টাকা।
এ সময় ভাস্কর বলেন, তোরও (সামসুলের) বুয়েটের আবরারের মতো অবস্থা হবে। বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা মিডিয়াকে জানালে অবস্থা হবে আরও ভয়াবহ।একপর্যায়ে বিষয়টি সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানতে পারলে সামসুলকে ছেড়ে দেন ভাস্কর। এরপর সামসুল বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসা নেন। তারপর তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ছাত্রলীগ নেতা ভাস্করের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সহকারী প্রক্টর আরিফুর রহমানকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।এছাড়া বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়। এরপর নড়েচড়ে বসেন রাবি ছাত্রলীগের নেতারা। শনিবার সকাল থেকেই বিষয়টি সমঝোতার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন তারা। এছাড়া রোববার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাবি ছাত্রলীগের শীর্ষ কয়েকজন নেতা নির্যাতনকারী ছাত্রলীগ নেতা ভাস্করকে নিয়ে বিভিন্ন দফতরে যান। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক রাবি ছাত্রলীগের কয়েকটি সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে বিষয়টি মীমাংসা হয়ে গেছে। ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা নির্যাতিত সামসুলকে ডেকে ভাস্করের সঙ্গে বিষয়টি মীমাংসা করে দিয়েছেন। মিডিয়ায় নির্যাতনের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে প্রকাশ পাওয়ায় অতি দ্রুততার সঙ্গে মীমাংসা করা হয়েছে।এদিকে ছাত্রলীগ নেতা ভাস্করের সিট বাণিজ্যর ব্যাপারে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। ঝালকাঠি সদরের বাসিন্দা ভাস্কর সাহা গত মার্চে রাবি ছাত্রলীগের হল সম্মেলনে মতিহার হলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। এর আগে ছাত্রলীগের মিছিল-মিটিংয়ে থাকলেও ভাস্কর কোনো সাংগঠনিক দায়িত্বে ছিলেন না।হল সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়ার পরই তিনি হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। শুরু করেন সিট বাণিজ্য। গত পাঁচ মাসে এই ছাত্রলীগ নেতা অন্তত অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে জোরপূর্বক হলে সিট বরাদ্দের ব্যবস্থা করেছেন। এর বিনিময়ে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা। শীর্ষ ছাত্রলীগ নেতারা এ বিষয়ে অবগত থাকলেও ভাস্করের বিরুদ্ধে নেননি কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা।
এদিকে শনিবার দুপুরের পর থেকেই নির্যাতিত শিক্ষার্থী শামসুল ইসলামের মোবাইল ফোনে ইনকামিং অপশন বন্ধ রয়েছে। গণমাধ্যমকর্মীরা তার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। রোববার দুপুরেও সামসুলের সঙ্গে ফোনে কথা বলা সম্ভব হয়নি। এ কারণে তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক সামসুলের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্রের দাবি, শারীরিক নির্যাতনের পর থেকেই সামসুল মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। নিজের নিরাপত্তা নিয়ে চরম আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। এছাড়া তার ওপর রয়েছে ছাত্রলীগ নেতাদের চাপ। গণমাধ্যমকর্মীরা যেন সামসুলের সাথে কোনোভাবেই কথা বলতে না পারেন বা তার অবস্থান সম্পর্কে জানতে না পারেন- এ কারণেই তার ফোনটি অকেজো করে রাখতে বাধ্য করেছেন।অপরদিকে সামসুলকে নির্যাতন করা হয়নি বলে দাবি করেছেন নির্যাতনকারী ছাত্রলীগ নেতা রাবি শিক্ষা গবেষণা ইন্সটিটিউটের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ভাস্কর সাহা। তিনি বলেন, সামসুল এবং আমি একই শিক্ষাবর্ষে পড়াশোনা করি।
তিনি আমার বন্ধু। তাকে নির্যাতনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি ছিল। শনিবার রাতে আমি দুঃখপ্রকাশ করেছি। আমাদের মধ্যে সমঝোতা হয়ে গেছে। এছাড়া আমার বিরুদ্ধে সিট বাণিজ্যর যে অভিযোগ করা হচ্ছে, তা সঠিক না। একটি মহল পরিকল্পিতভাবে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। তারা আমার সম্মানহানি করার চেষ্টা করছে।এ বিষয়ে রাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সামসুল যেভাবে নির্যাতনের কথা বলছে, সেটি ঠিক না। ভাস্কর তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে। এটা মিটমাট হয়ে গেছে।এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের একজন শীর্ষ কর্মকর্তাও বিষয়টি মীমাংসা হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন।তদন্ত কমিটির প্রধান সহকারী প্রক্টর আরিফুর রহমান তদন্ত শুরু হয়েছে জানিয়ে বলেন, অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত শুরু হয়েছে। অভিযোগকারী এবং অভিযুক্তকে ডাকা হয়েছে। তাদের সঙ্গে কথা বলা হবে। এছাড়া যারা সাক্ষী আছেন, তাদের সঙ্গেও কথা বলব। এরপর তদন্ত রিপোর্ট দেওয়া হবে। তদন্তে কোনো পক্ষপাতিত্ব হবে না। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।
Development by: webnewsdesign.com