ধনধান্যে পুষ্পভরা আমাদেরই বসুন্ধরা, তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা- কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কবিতার পঙক্তি দুইটিই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির অপরুপ সৌন্দর্য তুলে ধরে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি আমাদের বাংলাদেশে। এদেশের মাধুরীতে মুগ্ধ হয়েছে কত কবি, সাহিত্যিক আর গুণীজনেরা। সবুজের দেশ বাংলাদেশ। আর বর্তমানে আধুনিক বিশ্বের এই সময়ে বাংলাদেশের নামের সাথে যে নতুন অভিধা যুক্ত হতে যাচ্ছে তা হলো “ডিজিটাল বাংলাদেশ”।
বাংলাদেশের জাতীয় দিবস হিসেবে পালিত বিশেষ একটি দিবস হলো “ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস”। যার পূর্বনাম ছিলো “আইসিটি বা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি দিবস”। ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর তারিখে বাংলাদেশ সরকার এই দিবসটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের ঘোষণা প্রদান করে। ডিজিটাল বাংলাদেশে একটি প্রত্যয়, একটি স্বপ্ন, যা বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। বিরাট এক পরিবর্তন আর ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এখন এগিয়ে চলেছে। একুশ শতকে বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে ৬ জানুয়ারি ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ২য় বারের মত শপথ নেন। ২০২১ সালে বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তী পালনের বছরে বাংলাদেশেকে একটি মধ্যম আয়ের দেশ এবং তথ্য ও প্রযুক্তি নির্ভর ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণই ছিলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রধান আলোচ্য বিষয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে যে প্রকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের ঘোষনা দেন তার মূল শিরোনাম ছিলো “ডিজিটাল বাংলাদেশে”।
জীবনযাত্রার পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, পড়াশোনা সবকিছু এগিয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তির সঙ্গে। সময়ের পরিবর্তনে সবকিছুই প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠছে। আগে আমাদের কোনো পণ্য কিনতে হলে মার্কেটে যেতে হতো। ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের কল্যাণে এখন আমরা ঘরে বসেই নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করতে পারি খুব সহজেই। ডিজিটাল কমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ অগ্রগতি ও পরিবর্তন আসছে সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি তরুণদের নানা উদ্যোগ আর প্রচেষ্টায়। তাদের হাত ধরেই দেশে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কিষানিরা মোবাইলে বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে পাচ্ছেন কৃষিসংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য। প্রতারণা বা সহিংসতার শিকার হলে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যায় জরুরি সেবা। স্বাস্থ্যসংক্রান্ত তথ্যও এখন ঘরে বসেই মোবাইলের মাধ্যমে পাওয়া যায়। ডিজিটাল বাংলাদেশে বড় পরিবর্তন এসেছে ‘উবার-পাঠাও’-এর মতো রাইড শেয়ারিং সেবা চালু হওয়ায়। এতে যুবসমাজের কর্মসংস্থান যেমন সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি যাতায়াতে সুবিধাও বেড়েছে। টেলিযোগাযোগ খাতে বাংলাদেশের অন্যতম অর্জনের মধ্যে একটি হচ্ছে চতুর্থ প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্ক (ফোর-জি) যুগে পা রাখা, যা তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অনন্য মাত্রা যোগ করেছে।
জনগণের দোরগোড়ায় তথ্যসেবা পৌঁছে দিতে সরকার বিভিন্ন ধরনের তথ্য ও সেবার ক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশনের উদ্যোগ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ৬০০ মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করা হয়েছে। প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে এসব মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করছে। তাছাড়া সরকারের ‘জাতীয় তথ্য বাতায়ন’ ওয়েবসাইট ভিজিট করে যাবতীয় তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। স্থানীয় তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অগ্রগতি ডিজিটাল বাংলাদেশের মূল ভিত্তি। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হচ্ছে স্থানীয় তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অবদানের কারণেই। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সক্ষমতা তুলে ধরাই এ আয়োজনের লক্ষ্য। দেশে ফেসবুক ব্যবহারকারী ছয় কোটির বেশি। গড়ে উঠেছে ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসা। এর বাইরে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের একটি বড় অংশ ফ্রিল্যান্সার। দেশে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সার রয়েছেন। এর বাইরে রয়েছেন সফটওয়্যার খাতের উদ্যোক্তারা। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বড় অগ্রগতি হয়েছে নারীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে যুক্ত করায়। সব মিলিয়ে ডিজিটাল কমিউনিকেশন বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে উদ্যোক্তা তৈরিতে, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে যা ব্যাপক গুরুত্ব বহন করে। ডিজিটাল বিপণন প্রতিটি স্মার্টফোনকে শপিং ব্যাগে পরিণত করেছে। ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম ও অনান্য প্ল্যাটফর্ম মানুষের জীবনকে অনেক সহজ ও আধুনিক করেছে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং দেশের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিকে বিবেচনায় রেখে যোগ্য ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। সারা বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে পতিত আবাদি জমিকে কাজে লাগিয়ে যে শিল্পোন্নয়নের কার্যক্রম এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে ওঠার পাশাপাশি অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ তৈরি হবে। আর এজন্য প্রয়োজন প্রযুক্তিবিদ্যার অবাধ প্রসার ও প্রয়োগ। “ভিশন টুয়েন্টি টুয়েন্টি ওয়ান” এর আওতায় ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছরে তথা সুবর্ণ জয়ন্তীতে আমাদের আজকের বাংলাদেশে ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত হবে। একটি উন্নত দেশ, সমৃদ্ধ ডিজিটাল সমাজ, একটি ডিজিটাল যুগের জনগোষ্ঠী, নতুন জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতি, রূপান্তরিত উৎপাদন ব্যবস্থা। ডিজিটাল বাংলাদেশ মূলত জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের প্রথম সোপান হিসেবে ভূমিকা পালন করবে। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য যে সমৃদ্ধ ও উন্নত জীবন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম ডিজিটাল বাংলাদেশ মূলত আমাদের সেই স্বপ্ন পূরন করেবে। নিজস্ব অর্থায়নে পরিকল্পিত উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানোর প্রচেষ্টা চলছে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সমৃদ্ধ অঞ্চলে পরিণত হতে বেশি সময় লাগবে না।
বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। বিজয়ের প্রায় অর্ধশত বছরের দ্বারপ্রান্তে এসে “যদিও মানছি দূরত্ব, তবুও আছি সংযুক্ত “এই প্রতিপাদ্য নিয়ে ১২ ডিসেম্বর দেশব্যাপী জেলা-উপজেলা এবং বিদেশের বাংলাদেশী দূতাবাসগুলোতে একযোগ পালিত হয়েছে “ডিজিটাল বাংলাদেশে দিবস” ২০২০। সরকার ও জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে উঠবে আমাদের স্বপ্নের ও বহুল প্রত্যাশিত ডিজিটাল বাংলাদেশ। এ বিষয়ে সরকারের পাশাপাশি সুধী সমাজ তথা সকলকে নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে আরও সচেতন হতে হবে। দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করবে আমাদের আগামীর” ডিজিটাল বাংলাদেশ” এটিই মূলত এই দিবসটি উদযাপনের মূল লক্ষ্য। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই স্বপ্ন পূরণে অনেকখানি এগিয়ে গেছেন। মানুষের জরুরি সেবাগুলোর প্রাপ্তি সহজ হয়েছে এবং এরই মধ্যে তা জনগণের দাঁড় গোঁড়ায় পৌঁছে গেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর স্বপ্ন নয়, এটি এখন বাস্তবতা।
মারিয়া অনি
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
Development by: webnewsdesign.com