ডাকসুতে হামলা : ৪২ দিনেও প্রতিবেদন হয়নি

মঙ্গলবার, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | ৪:২১ অপরাহ্ণ

ডাকসুতে হামলা : ৪২ দিনেও প্রতিবেদন হয়নি
apps

গত ২২ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ভবনে হামলা চালিয়ে ভিপি (সহ-সভাপতি) নুরুল হক নুরসহ ৩৫ জনকে পিটিয়ে জখম করার ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটিকে ছয় দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। সেই ছয় দিন পেরিয়ে ৪২ দিন গড়ালেও প্রতিবেদন আর হয়নি।

ঘটনার তদন্তে এমন গড়িমসি ডাকসুর ভিপিসহ ৩৫ জনকে আহত করার বিষয়টিকে করে ফেলেছে গুরুত্বহীন। আর সেই ‘সুবাদে’ প্রকাশ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াচ্ছেন হামলা-মারধরে জড়িতরা। যদিও হামলার ঘটনাটির পর তুমুল সমালোচনার মুখে তিনজনকে আটক করা হয়। ঘটনাটি তদন্তে এমন ‘অবহেলা’য় ক্ষুব্ধ দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা।

জানা যায়, ২২ ডিসেম্বর দুপুরে ডাকসু ভবনে থাকা ছাত্র সংসদের ভিপি নুরুল হক নুর ও তার অনুসারীদের ওপর হামলা চালান মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের একাংশের নেতারা। এক পর্যায়ে এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস এবং সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনের অনুসারীরাও অংশ নেন বলে অভিযোগ ওঠে। এমনকি দুর্নীতির অভিযোগে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ হারানো ডাকসুর জিএস (সাধারণ-সম্পাদক) গোলাম রাব্বানী এতে ইন্ধন দেন বলেও অভিযোগ শোনা যায়।

নুরের অনুসারীরা বলেন, হামলার সময় ডাকসু ভবনে ভিপি নুরকে ভয় দেখিয়ে নানা হুমকি দেন সনজিত। হুমকি দিয়ে বের হওয়ার পরই সনজিত ও সাদ্দামের অনুসারীরা ভিপি নুর ও তার সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালান। এক পর্যায়ে ভিপি নুরের দুই সহযোগীকে ছাদ থেকে ফেলে দেন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতাকর্মীরা। ভিপির কক্ষের বাতি নিভিয়ে রড, লাঠি, বাঁশ ও বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র দিয়ে পেটানো হয় নুরসহ সেখানে থাকা ডাকসু ও কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্লাটফর্ম সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতাকর্মীদের।

 

 

 

 

 

হামলা-মারধরের প্রায় এক ঘণ্টা পর ঘটনাস্থলে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. গোলাম রব্বানী। এসময় ডাকসু ভবনের আশ-পাশের এলাকা থেকে ১৪ জনকে আহতাবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তারপর ভিপির কক্ষ থেকে নুরুল হক নুরসহ ২২-২৪ জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

এ ঘটনায় সারাদেশে তীব্র সমালোচনার ঝড় ওঠে। ২৪ ডিসেম্বর শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক রইচ উদ্দিন বাদী হয়ে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের একাংশের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল ও সাধারণ সম্পাদক আল মামুনসহ ৮ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাত ২৫-৩০ জনের নামে মামলা করেন। মামলার পরদিন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ একাংশের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক ইয়াসির আরাফাত তূর্য ও দফতর সম্পাদক মেহেদী হাসান শান্তকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। মামলার তদন্তভার পাওয়া ডিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়, বাকি আসামিদের দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করা হবে।

কিন্তু ক’দিন পেরোতেই পুলিশের করা মামলার প্রধান আসামি ও তিন নম্বর আসামিকে প্রকাশ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সদলবলে ঘুরতে দেখা যায়।

এ বিষয়ে ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর জাগো নিউজকে বলেন, ‘এদেশের সমস্যা নিয়ে কথা বললে তা সরকারের কানেই পৌঁছায় না। কিন্তু ভারতের আগ্রাসন নিয়ে কথা বললেই সরকার কেঁপে ওঠে। ডাকসু যখন ভারতের এনআরসি ও সিএএ আইন নিয়ে কথা বলে তখনই সরকারের পেইড সংগঠন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চকে দিয়ে রাজু ভাস্কর্যে আমাদের ওপর হামলা চালানো হয়। ওই ঘটনার চার দিন পর বিনা উসকানিতেই ডাকসু ভবনে আমাদের ওপর নৃশংস হামলা করে শিক্ষার্থীদের জখম করা হয়। এ ঘটনার পর যখন সারাদেশে তীব্র প্রতিবাদ ও সমালোচনা হচ্ছিল, দেশবাসীর আইওয়াশ করতে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের তিন সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করে প্রশাসন। কিন্তু হামলায় প্রত্যক্ষ অংশ নেয়া মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের একাংশের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল ও তার সহচররা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও তাদের গ্রেফতারের কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না।’

 

 

 

 

 

ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরের ওপর হামলা মামলার প্রধান আসামি আমিনুল ইসলাম বুলবুল প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন- এমন অভিযোগের বিষয়ে যোগাযোগ করলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি-দক্ষিণ) ডিসি (উপ-কমিশনার) রাজীব আল মাসুদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘মামলার তদন্তের স্বার্থে ডিবি আসামিদের গ্রেফতারে কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে তিনজনকে গ্রেফতারের পর আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। তারা এখন জেলহাজতে। বাকি আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। বুলবুল প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, এরকম কোনো তথ্য আমরা পাইনি। যদি কারও কাছে এমন তথ্য প্রমাণ থাকে তা আমাদের দিয়ে সহযোগিতা করতে পারেন।’

তদন্তে বেঁধে দেয়া ৬ দিন শেষ হয়নি ৪২ দিনেও
ডাকসুতে হামলার ঘটনাকে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ উল্লেখ করে পরদিন ২৩ ডিসেম্বর তদন্ত কমিটি গঠন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবু মো. দেলোয়ার হাসানকে আহ্বায়ক করে গঠিত এ কমিটিতে আরও রাখা হয় শামসুন নাহার হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. সুপ্রিয়া সাহা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য অধ্যাপক ড. অসীম সরকার, স্যার পি জে হার্টগ ইটারন্যাশনাল হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মো. মহিউদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ড. মো. মিজানুর রহমান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাঈনুল করিমকে (সদস্য-সচিব)।

কমিটি গঠন করার নোটিশে ৬ (ছয়) কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু পরে তদন্ত কমিটির মেয়াদ তিনবার বাড়ানো হয়। সর্বশেষ জানুয়ারি মাসের ২৯ তারিখ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত তদন্তই শেষ করতে পারেনি সেই কমিটি।

৪২ দিন পেরিয়ে তদন্ত কমিটির কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে আহ্বায়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘তদন্ত কমিটির কাজ এখন পর্যন্ত শেষ হয়নি। আশা করি অল্প কিছুদিনের মধ্যে আমরা তা জমা দিতে পারব।’

 

 

 

 

 

 

 

 

গায়েব সিসিটিভি ফুটেজ উদ্ধার করতে ব্যর্থ প্রশাসন
হামলার ঘটনার সময় ডাকসু ভবনের আওতাধীন নয়টি সিসিটিভির মনিটরসহ হার্ডডিস্ক গায়েব করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। তখন ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম জানান, সিসিটিভি ফুটেজ উদ্ধারে পুলিশ কাজ করছে। কিন্তু ৪২ দিনেও সিসিটিভি ফুটেজ বের করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় ও পুলিশ প্রশাসন। বরং সিসিটিভি ফুটেজ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও পুলিশ প্রশাসন পরস্পরকে দোষারোপ করছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবির (দক্ষিণ) ডিসি রাজীব আল মাসুদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডাকসু ভবনে হামলার ঘটনার পর মামলার তদন্তের দায়িত্ব ডিবি পুলিশকে দেয়া হয়েছে। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ডাকসু ভবনে হামলার ঘটনায় সংশ্লিষ্ট এলাকার ভিডিও ফুটেজ চেয়েছি। কিন্তু এখনো আমরা তা হাতে পাইনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আমরা নিজেরা গিয়ে কোনো কিছু করতে পারি না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া। সেজন্য ভিডিও ফুটেজ ঢাবি কর্তৃপক্ষের কাছে চেয়েছি।’

পুলিশের এ বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমরা কোথা থেকে সিসিটিভি ফুটেজ উদ্ধার করব? সিসিটিভি ফুটেজ উদ্ধারের জন্য আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে থানায় তিনবার চিঠি দিয়েছি। কিন্তু পুলিশ আমাদের কোনো সাহায্য করেনি। পুলিশ আসামিদের গ্রেফতার করছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের জন্য ফাঁড়ি দেয়া হয়েছে। শত শত গোয়েন্দা কাজ করার জায়গা দেয়ার পরও যদি তারা সিসিটিভি ফুটেজ উদ্ধার করতে না পারে, তাহলে…।’

Development by: webnewsdesign.com