জীবন দিয়ে,দিয়ে গেল প্রেমের প্রতিদান!

বৃহস্পতিবার, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ৫:৪০ অপরাহ্ণ

জীবন দিয়ে,দিয়ে গেল প্রেমের প্রতিদান!
প্রতিকী ছবি
apps

টি-২০ বিশ্বকাপ ক্রিকেট সারা দেশ মাতিয়ে রেখেছে। উত্তেজনার ঢেউ লেগেছে রংপুর পীরগাছার ছোট্ট একটি গ্রাম সোনারায়েও। স্থানীয় মুদি দোকানদার রফিকুল ইসলামের একমাত্র ছেলে আল আমিন নয়ন গাইবান্ধা সরকারি কলেজের ইতিহাসের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত সুদর্শন এই ছেলেটি কলেজের ছুটি পেয়েই বাড়িতে এসেছে। বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। নয়ন মাকে বলে স্থানীয় তাম্বলপুর বাজারের ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে খেলা দেখতে যায়। প্রতিদিন ক্রিকেট খেলা দেখে রাত ১০টার মধ্যে বাড়িতে ফিরে আসে। এভাবেই কাটছিল নয়নের দিন।

সেদিন ছিল বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা। প্রতিদিনের মতো সেদিনও নয়ন তার মাকে বলে সেই ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে টেলিভিশনে খেলা দেখতে যায়। ২০১৪ সালের ৬ এপ্রিলের ঘটনা এটি। গ্রামে রাত নামে ঝুপ করে। কিন্তু নয়ন বাসায় ফিরেনি! অন্য দিনের মতো রাত ১০টায় ছেলেটি ফিরে না আসায় মায়ের মধ্যে উদ্বেগ। দোকান বন্ধ করে বাবা বাসায় ফিরেন। উঠানে এসেই অন্য দিনের মতো ছেলের নাম ধরে ডাকতে থাকেন। ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন নয়নের মা। বলেন, নয়ন তো বাসায় ফিরেনি। এ কথা শুনে বাবার কপালে চিন্তার রেখা। নিজেকেই যেন সান্ত্বনা দেন রফিকুল। বলেন, ফাইনাল খেলা হলো তো। এজন্য হয়তো দেরি হচ্ছে নয়নের। কিন্তু রাত ১২টা যখন বাজে বাবা-মা আর স্থির থাকতে পারছেন না। পায়চারি করছেন উঠানে। কাকে বলবে, কী বলবে বুঝতে পারছেন না। রফিকুল বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটু এগিয়ে যান। সুনসান অবস্থা চারদিকে। লোকজনের কোনো কোলাহলও নেই। অজানা আশঙ্কা নিয়ে বাসায় ফিরেন তিনি। মা ঘরের দরজায় বসে আছেন ছেলের জন্য। বাবা পায়চারি করছেন উঠানে। এভাবেই নির্ঘুম রাত কাটে রফিকুল দম্পতির। তারা অপেক্ষায় তাদের সন্তানের জন্য। এই বুঝি এসে বলবে, মা আমি বন্ধুর বাসায় আটকে গেছিলাম। মা বলবে, যাও বাবা হাত মুখ ধুয়ে আসো। খাবার দিচ্ছি। এক রাতেই তোর চেহারার কী অবস্থা হয়েছে রে! না এমন কিছু হয়নি। নতুন সূর্যের দেখা মেলে। দেখা মেলেনি নয়নের। পীরগাছার অন্নদানগর রেললাইনের সুকানপুকুর রেলব্রিজের কাছে হাত-পা-মাথা বিচ্ছিন্ন কাটাছেঁড়া একটি মৃতদেহ উদ্ধারের খবর ছড়িয়ে পড়ে। রেললাইনের ওপর অজ্ঞাত যুবকের লাশের উপস্থিতি সবাইকে হতবাক করে। গ্রামের মানুষ রেললাইনের ওপর এমন দুর্ঘটনা দেখতে মোটেই অভ্যস্ত নয়। অনভ্যস্ত ঘটনা দেখার জন্য উৎসুক লোকের জমায়েত বাড়তে থাকে। কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারে না মৃতদেহটি কার বা কোথা থেকে এসেছিল। রেলব্রিজ থেকে ৮-১০ কিমি. দূরে তাম্বলপুর বাজার। কাউনিয়া সান্তাহার রেললাইন এ বাজারটি স্পর্শ করে গেছে। লাশ উদ্ধারের খবর পান রফিকুলও। বেলা ১১টায় এ খবর শুনে তড়িঘড়ি করে ছোটেন সুকানপুকুর রেলব্রিজের দিকে। লোকজনের ভিড় ঠেলে রফিকুল পৌঁছে যান রেললাইনের ওপর পড়ে থাকা লাশের দিকে। স্থানীয়রা কেউ না চিনলেও রফিকুল তার সন্তানকে ঠিকই চিনেছেন। লাশ দেখেই গগনবিদারী চিৎকার তার। খন্ডিত অংশ ধরেই আহাজারি করতে থাকেন। লোকজন তখন তাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। নিয়ম অনুযায়ী এসব দুর্ঘটনায় মৃতদেহের আইনি নিষ্পত্তি বর্তায় রেল পুলিশের ওপর। ততক্ষণে বোনারপাড়া রেল থানা থেকে পুলিশও এসে গেছে। মো. রফিকুল ইসলামের গগনভেদি আহাজারির মধ্যেই চলতে থাকে পুলিশের সুরতহাল (ইনকোয়েস্ট) প্রতিবেদন তৈরির কাজ। বাংলাদেশে কেউ যদি দুর্ঘটনায় মারা যান তাহলে আপনজনরা মৃতের আর ময়নাতদন্ত (পোস্ট মর্টেম) করাতে চান না। তারা মনে করেন ডাক্তারদের এ কাটাছেঁড়া মুর্দার আত্মার শুধু কষ্টই বাড়ায়। সবার পরামর্শে ময়নাতদন্ত না করে পুত্রশোকে উদভ্রান্ত এক পিতা কাঁধে নিয়ে চললেন তার একমাত্র উত্তরাধিকারীকে। মধ্যবয়সী এ দম্পতির শোক দেখার আর কেউ নেই। পুত্রশোকে রফিকুল আর তার স্ত্রী নাওয়া-খাওয়া প্রায় বন্ধই করে দিয়েছেন। প্রথম দিকে দু-একজন আত্মীয়স্বজন এসে সান্ত্বনা দিলেও সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের উপস্থিতিও কমে গেছে। সপ্তাহ না যেতেই এক দিন হাওয়ায় গুঞ্জন শোনা যায় ফকিরপাড়ার একটি মেয়ের সঙ্গে তার ছেলের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। প্রায় ২ কিমি. দূরের এ ফকিররা ধনে-জনে-মানে বলীয়ান। শোকাতুর পিতা রফিকুলের মন মানে না- কেন তার বাধ্য ছেলেটি বাড়িতে না এসে উল্টো দিকের রেললাইনে এত দূরে চলে গেল! এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই এক দিন সোজা চলে গেলেন ৬০ কিমি. দূরের বোনারপাড়া রেল থানায়। কিন্তু চাইলেই তো থানায় মামলা করা যায় না- যেখানে সবাই জানে ঘটনাটি দুর্ঘটনা। একই কারণে গ্রামের কাউকে সঙ্গেও পেলেন না এ দুর্ভাগা পিতা। তিনি আদালতের শরণাপন্ন হলেন। আদালতের নির্দেশে খুনের মামলা হলো, কিন্তু মৃতদেহের তো ময়নাতদন্ত হয়নি। সুতরাং ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে লাশ উত্তোলন করে রংপুর মেডিকেল কলেজে পাঠাতে হলো। তারাও মতামত দিলেন- হ্যাঁ ছেলেটি রেল দুর্ঘটনায় মারা গেছে। আর তো সংশয় নাই-তাই পুলিশ আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়-ফাইনাল রিপোর্ট। নয়নকে কেউ খুন করেনি। ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে আড়াই বছর। বাবার মন। রফিকুল ইসলাম মানলেন না, নারাজি দিলেন আদালতে। ঘটনার পাক্কা আড়াই বছর পর পিবিআই রংপুর ইউনিট ইনচার্জ মো. শহিদুল্লাহ কাওছারের নেতৃত্বে টিম বসেছে মামলার ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণে। মৃতদেহের একটা ছবি ব্যতীত কোনো কিছুই নেই। সবাই জানে এটি দুর্ঘটনা। তাই মানুষের আগ্রহও নেই। নয়নের দুর্ঘটনার ছবিটি বড় করে বিশ্লেষণ করতেই দেখা গেল বুকের বাম পাশে একটা চিকন গভীর ক্ষত। পিএম ও ইনকোয়েস্ট রিপোর্টে এ ক্ষত সম্পর্কে কোনো কিছু উল্লেখ নেই। রেল অ্যাক্সিডেন্টে তো এরকম ক্ষত থাকার কথা নয়। তদন্ত কর্মকর্তার তদন্ত শুরু হলো। তিনি খোঁজার চেষ্টা করেন সেই সময়ে কারা কারা ক্রিকেট খেলা দেখেছিল, কে কে নয়নের পাশে বসেছিল এবং সর্বশেষ তাকে কোথায় দেখা গিয়েছিল। দীর্ঘ সময়ের স্মৃতি হাতরিয়ে তারা যতটুকু তথ্য দেয় তার ভিত্তিতে নয়নের বন্ধু আশিকুর রহমান তুষারের দিকে সন্দেহের তীর যায়। তাকে তুলে নেয় পুলিশ। তুষারের কথামতো নিয়ে আসা হয় জুয়েল মিয়াকে; সে ওই মেয়েটির বৈমাত্রেয় ভাই। রহস্য ফাঁস হয় খুনের। আর এতেই পেরিয়ে যায় আরও আড়াই বছর। ঘটনার পাঁচ বছর পর বেরিয়ে আসে খুনের আসল রহস্য। জুয়েল মিয়া আদালতে স্বীকার করে- বিশ্বকাপের সেদিন ছিল চাঁদনী রাত। খেলা শেষে তুষার, আল আমিন নয়নকে বলে সেই মেয়েটি তৎক্ষণাৎ তাকে দেখা করতে বলেছে। বন্ধুর কথায় সরল বিশ্বাসে নয়ন, তুষারের সঙ্গেই মেয়েটির বাড়িতে যায়। উঠানে গিয়েই দেখে সেখানে তার অপেক্ষায় আছে মেয়েটির ভাই মুকুল মিয়াসহ, চাচাতো ও বৈমাত্রেয় ভাই জুয়েল, মনির এবং রাঙ্গা। মুকুল নয়নসহ সবাইকে মাঠে হাওয়া খাওয়ার জন্য প্রস্তাব দেয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা হাওয়া খাওয়ার জন্য নয়নকে নিয়ে রওনা হয়। সারা পথ মুকুল নয়নের হাত ধরে গল্প করে। তারা খোশগল্প করে আর সামনে চলে। ফকিরপাড়ার পরই ধানখেত। ধানখেতের মধ্যে একটি কালভার্ট। কালভার্ট-ই ছিল নয়নের শেষ গন্তব্য। হঠাৎ মুকুল তার লুঙ্গির মধ্য থেকে একটি ছুরি বের করে নয়নের বুকের বাম পাশে হৃৎপি- বরাবর বসিয়ে দেয়। নয়ন মাটিতে পড়ে যায়। একজন মুখ চেপে ধরে অন্যরা পা ও হাত। চলতে থাকে এলোপাতাড়ি ছুরির আঘাত। কালভার্টের পাশেই লুকানো ছিল একটি বস্তা, কোদাল ও ভ্যানগাড়ি এবং দড়ি। খুনিরা মৃত্যু নিশ্চিত করার পর নয়নকে বস্তায় ঢুকিয়ে ভ্যানগাড়িতে ওঠায়। কোদাল দিয়ে মাটির রক্ত পরিষ্কার করে কালভার্টের নিচে ফেলে দেয়- যেন ভাগের মা গঙ্গা সব পাপ মুছে নেবে। কিছু কচি ধানগাছ দিয়ে জায়গাটি ঢেকে দিয়ে খুনিরা নিজেরাই ভ্যান চালিয়ে চলে যায় ১০ কিমি. দূরের সুকানপুকুর রেলব্রিজের কাছে। অপেক্ষায় থাকে কখন ট্রেন আসবে। রাত তখন প্রায় পৌনে ১টা। নির্ধারিত সময়ে সান্তাহার হতে লালমনিরহাটগামী ট্রেনের শব্দ শুনেই বস্তা খুলে খুনিরা নয়নের নিথর শরীরটাকে শুইয়ে দেয় রেললাইনের ওপর। এ খুনিরাই পরদিন সকালে রেলব্রিজে দুর্ঘটনার পক্ষে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিল। এ মৃত্যুর কয়েক দিন পর মেয়েটিকে সিলেটে নিয়ে এক প্রবাসীর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ইউরোপে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ইতিহাসের ছাত্র আল আমিন নয়ন কোনো ইতিহাস সৃষ্টির জন্য নয়, শুধু হৃদয় দিয়ে ভালোবেসেছিল মেয়েটিকে। হতভাগ্য সেই বিদীর্ণ হৃৎপি–ই খুনিদের ঠিকানায় পৌঁছাতে অন্ধকারে আলোর নিশানা ঠিক করে দেয়।

Development by: webnewsdesign.com