রাষ্ট্রের সৃষ্টিই হয়েছে মানুষের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য। আধুনিককালে মানুষ রাষ্ট্রের নামক তীক্ষ্ণ তরবারী দ্বারা সুরক্ষিত। কিন্তু কোথায় আজ নারী নিরাপত্তা? না ঘরে, না বাইরে! নারী কেন নিরাপদ নয়? স্বাধীনতা সে কি শুধু কাগজে কলমেই লিপিবদ্ধ? কেন এদেশে এখন ধর্ষণের সংস্কৃতি বিরাজমান?
শিশু, কিশোরী, তরুনী, বৃদ্ধা প্রভৃতি বয়স নির্বিশেষে ধর্ষিত হচ্ছে। রাস্তার থাকা পাগলিটি না জানি দিনে কতবার ধর্ষিত হয়? গৃহবধূটি কী তার শ্বশুড়, ভাসুরের হাত থেকে রক্ষা পায়? স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়েটি কি আজ রাস্তাঘাট ও তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিরাপদ? ধর্ষণ কী সেটা বোঝার ক্ষমতাও যার হয়নি সে কেন ধর্ষিত? সুশীল সমাজ নিরব কেন? উত্তর পাব না আমরা?
বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ৪ জন নারী ধর্ষিত হয়।বিগত বছর গুলোর তুলনায় বর্তমানে ধর্ষনের হার দ্বিগুন। তাছারা এক বছরে যৌন নির্যাতন বেড়েছে প্রায় ৭০ ভাগ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রতি ১০ জন পুরুষের ১ জন পুরুষ জীবনের কোন না কোন সময় ধর্ষণ করেছে এবং তাদের ১০ শতাংশও আইনী ঝামেলা পোহায় নি। আমাদের বিচার ব্যাবস্থা এখানে প্রশ্নবিদ্ধ।
মিসর, সৌদি আরব, চিন, ইরান, গ্রিস, নর্থ কোরিয়াসহ বেশ কিছু রাষ্ট্রের ধর্ষনের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। বাংলাদের দণ্ডবিধির ৩৭৬ ধারা অনুযায়ী ধর্ষনের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কিংবা ১০ বছরের উর্উর্ধ্বে কারাদণ্ড বা তদ্রূপ অর্থদণ্ড। নারী ও শিশু নির্যাতন আইন -২০০০ এর ৯ ধারা অনুযায়ী ধর্ষনের শাস্তি যাবৎ জীবন কারাদণ্ড। কিন্তু এই আইনের প্রয়োগ কতটুকু তা বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
এক ব্যক্তিকে হত্যা করলে তার একটা অধিকার ক্ষুন্ন হয়। তা হলো জীবন ধারনের অধিকার। একটা নারীকে ধর্ষণ করলে তার ২ টা অধিকার ক্ষুন্ন হয়। এক. জীবন ধারনের অধিকার, দুই. মর্যাদা সম্ভ্রমের অধিকার। তাই বলা যায় ধর্ষণ মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ। অথচ এদেশে ধর্ষকের শাস্তি হয় না, শাস্তি হয় ধর্ষিতার। সমাজের দ্বারা হয় নিগৃহীত, নিপীরিত। অথচ ধর্ষক বুক ফুলিয়ে চলফেরা করে। ধর্ষনের জন্য যারা নারীর পোশাককে দায়ী করেন তারা জানেন তো এদেশে প্রাপ্তবয়স্কা নারীর চেয়ে শিশু ধর্ষনের হার ৩ শতাংশ বেশি।
এদেশে ৮০ ভাগ ধর্ষনের খবর ধামাচাপা পরে থাকে টাকা, ক্ষমতা আর দুর্নীতির রোষানলে। আমাদের দেশে বিরজমান বিচারহীনতার সংস্কৃতি। নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনালে যে বিচার হয় সেখানে মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ মামলার বিচারের চূড়ান্ত রায় হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মামলা প্রক্রিয়ায় তদন্ত, মেডিকেল রিপোর্ট, আইনজীবীর অনাগ্রহ বা পক্ষপাতের কারণে চূড়ান্ত রায় আসার আগে মামলা খারিজ হয়ে যায়। অপরাধের বিচার ও শাস্তি প্রদানের প্রক্রিয়ার মাঝে যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক বিরাজমান তা আমাদের বন্ধ করতে হবে। ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যাবস্থা করতে হবে রাষ্ট্রকেই।
একজন নারী বারবার ধর্ষিত হয়। যখন বিচার চাইতে আদালতে যায়। যখন জেরার মুখে তার চরিত্র সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হয়, সে ধর্ষিতা কিনা তা প্রমান করতে হয়। রবি ঠাকুরের মত বলতে হয়, ‘কাদম্বিনি মরিয়াই প্রমাণ করিল সে মরেনাই।’ একজন ধর্ষিতা এ সমাজে না পারে ভালোভাবে বাঁচতে, না পায় ন্যায়বিচার। একজন নারী ধর্ষনের পরে শারীরিক ও মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পরে। একজন পুরুষ ধর্ষন করতে জানে কিন্তু ধর্ষিতা নারীকে নিয়ে সংসার করতে পারেনা। ধর্ষিতা নারী যেন জীবন্মৃত।
বাংলাদেশে ধর্ষণ বাড়ছে। বেড়েছে নারীর প্রতি সহিংসতাও। কঠোর আইন প্রনয়ণ, প্রচারনা ও উচ্চ আদালতের নির্দেশ থাকার পরেও কমছে না নারীএ প্রতি সহিংসতা। এর প্রধান কারন আমাদের সমাজের বিচারহীনতা। আইন আছে কিন্তু এর কার্যকারিতা নাই। ধর্ষণের দ্রুত বিচার এবং ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কার্যকর করা খুব জরুরি।ধর্ষিতার চিকিৎসা ও পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সেইসাথে সামাজিক মুল্যবোধ, নৈতিকতা ও দর্শনের উন্নয়ন করতে হবে এবং নারীর প্রতি সম্মান বৃদ্ধি করতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টালে জীবন পাল্টে যাবে। নারীকে ভোগ্যপণ্য নয়, মানুষ হিসেবে ভাবুন।
লেখক-
শিক্ষার্থী, আইন ও ভূমি ব্যাবস্থাপনা বিভাগ
ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
Development by: webnewsdesign.com