খেজুরের কাঁচা রস না খাওয়ার পরামর্শ

বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারি ২০২৩ | ১:৩৬ অপরাহ্ণ

খেজুরের কাঁচা রস না খাওয়ার পরামর্শ
খেজুরের কাঁচা রস না খাওয়ার পরামর্শ
apps

প্রাণঘাতী নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। বছরের প্রথম ১০ দিনের মধ্যে এই ভাইরাসের আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন তিনি। এ অবস্থায় খেজুরের কাঁচা রস না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। বুধবার আইইডিসিআর আয়োজিত ‘শীতের সংক্রামক রোগ এবং নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ’ শীর্ষক সম্মেলনে এই কথা জানানো হয়।

বর্তমানে কাঁচা খেজুরের রস খাওয়া একটি ভাইরাল ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। অনেকেই উৎসাহ নিয়ে এটি পান করছেন এবং সেই দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করে অন্যদের জানান দিচ্ছিন। কিন্তু একবারও ভাবছেন না, কি হতে পারে এভাবে কাঁচা রস খেলে?

কাঁচা খেজুরের রস খেলে কি হতে পারে? নিপাহ ভাইরাস কি? এ সম্পর্কে তাই ধারণা থাকা জরুরী। আসুন জেনে নেওয়া যাক- ‘নিপাহ ভাইরাস’, যা অতি সহজেই বাদুড় জাতীয় তৃণভোজী প্রাণী থেকে মানুষের দেহে প্রবেশ করে। শুধুমাত্র বাদুড় নয়, নিপাহ শূকরের বর্জ্য থেকেও ছাড়াতে পারে। ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ার “সুঙ্গাই নিপাহ” গ্রামে প্রথম এই ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেয়।

সেখানে বাড়ির পোষ্য কুকুর, বিড়াল, ঘোড়া, ছাগলের দেহে এই ভাইরাসের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ওই অঞ্চলে প্রতিটি বাড়িতেই শূকর প্রতিপালন হয়। গবেষণার পর দেখা যায়, শূকর থেকেই নিপাহ ভাইরাস ছাড়িয়েছে পোষ্যদের দেহে। ২০১৮ সালে পার্শ্ববর্তী ভারতের কেরালায় এই ভাইরাসের প্রকোপে ১১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। ভাইরাসটি আবিষ্কার করেন ড: কো বিং চুয়া।

বাংলাদেশেও মানবদেহে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া গেছে বহুবার। ২০০১ সালে দেশের উত্তর জনপদের সীমান্ত এলাকায় প্রথমবারের মতো নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। ২০০৪ সালে বাদুরের মাধ্যমে সংক্রমিত খেজুরের রস খেয়ে অনেকে এ রোগটিতে আক্রান্ত হন। তাই বর্তমানে বাংলাদেশকে এ রোগের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

নিপাহ ভাইরাসের বাহক এবং কিভাবে ছাড়ায়
নিপাহ ভাইরাস ছড়ায় মূলত পশুপাখি বিশেষ করে বাদুড়ের মাধ্যমে। বাংলাদেশে সাধারণত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এই সময়টাতেই খেঁজুরের রস সংগ্রহ করা হয়।

আর বাদুড় গাছে বাঁধা হাড়ি থেরে রস খাওয়ার চেষ্টা করে বলে ওই রসের সঙ্গে তাদের লালা মিশে যায়। সেই বাদুড় নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকলে এবং সেই রস খেলে, মানুষের মধ্যেও এই রোগ ছড়িয়ে পারে। এছাড়া বাদুরে খাওয়া ফলমূলের অংশ খেলেও রোগ ছড়াতে পারে।

রোগের লক্ষণ
নিপাহ ভাইরাস শরীরে প্রবেশের ৫ থেকে ১৪ দিন পর রোগের লক্ষণ প্রকাশিত হয়। এছাড়া লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াও ৪৫ দিন পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় শরীরের মধ্যে থাকতে পারে। শুরুতে প্রচণ্ড জ্বর, মাথা ও পেশীতে ব্যথা, খিচুনি, শ্বাসকষ্ট, কাশি, পেট ব্যথা, বমি ভাব, দুর্বলতা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। এ রোগে মস্তিষ্কে এনসেফালাইটিস জাতীয় ভয়াবহ প্রদাহ দেখা দেয় এবং এক পর্যায়ে রোগী প্রলাপ বকতে শুরু করে, ঘুমঘুম ভাব, মানসিক ভারসাম্যহীনতা এবং অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। সময়মতো চিকিত্সা না হলে রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

নিপাহর পরীক্ষা
এলাইজা টেস্ট, পিসিআর, সেল কালচার প্রভৃতি পরীক্ষার মাধ্যমে এ ভাইরাস শনাক্ত করা সম্ভব।

চিকিত্সা
এখন পর্যন্ত এ রোগের নির্দিষ্ট কোন চিকিত্সা নেই। রোগের লক্ষণ দেখা মাত্রই রোগীকে জরুরী ভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে, প্রয়োজনে আইসিইউও লাগতে পারে। সাধারণত লক্ষণ অনুযায়ী চিকিত্সা দিতে হয়, প্রয়োজনে এন্টিভাইরাল ব্যবহার করা যায়। আক্রান্ত রোগীর দ্রুত চিকিত্সার ব্যবস্থা করলে জীবন রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

এ রোগে আক্রান্তদের পরিচর্যা করতে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। রোগীর চিকিত্সায় নিয়োজিত ডাক্তার, নার্সদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। যেমন মুখে মাস্ক, সারা শরীর আবৃত করে গাউন ব্যবহার, রোগী দেখার পর হাত ভালোভাবে ধুয়ে জীবাণুমক্ত করা ইত্যাদি। রোগীর ব্যবহূত কাপড় ও অন্যান্য সামগ্রী ভালোভাবে পরিষ্কার না করে আবার ব্যবহার করা যাবে না। রোগীর কফ ও থুতু যেখানে সেখানে না ফেলে একটি পাত্রে রেখে পরে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।

এ রোগ প্রতিরোধের জন্য-
– খেজুরের কাচা রস পান করা উচিত নয়। গাছ থেকে খেঁজুরের রস সংগ্রহের বাড়ি ঢেকে রাখতে হবে।

– পাখি বা বাদুড়ে খাওয়া আংশিক ফল যেমন-আম, লিচু, জাম, জামরুল, গোলপজাম, কাঁঠাল, ডেউয়া, পেঁপে, পেয়ারা, বড়ই ইত্যাদি না খাওয়াই ভালো।

– ফলমূল পরিষ্কার পানি দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে খেতে হবে।

– আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে এবং রোগীর পরিচর্যা করার পর সাবান ও পানি দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুতে হবে।

সাবধানতা
এই রোগের কোন টিকা আবিষ্কার হয়নি। তাই সাবধানতা অবলম্বন করা খুবই জরুরী।

টিপস
– যেহেতু নিপাহ ভাইরাস শরীরে প্রবেশের ৫ থেকে ১৪ দিন পর রোগের লক্ষণ প্রকাশিত হয়, তাই নিকট সময়ে যারা খেজুরের রস খেয়েছেন, তাদের সবাইকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।

– আক্রান্ত মানুষ থেকে মানুষেও ছড়াতে পারে এ রোগ। তাই যারা রোগীদের সেবা দিয়েছেন এবং মৃতদের সত্কার করেছেন, তাদের দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।
– রোগীর সঙ্গে একই পাত্রে খাওয়া বা একই বিছানায় ঘুমানো যাবে না।
– রোগীর ব্যবহূত কাপড় ও অন্যান্য সামগ্রী ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে।
– রোগীর কফ ও থুতু একটি পাত্রে রেখে পরে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
– রোগীর শুশ্রুষা করার সময় মুখে কাপড়ের মাস্ক, হাতে গ্লোভস পড়ে নিতে হবে।
– যে এলাকা নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, সে এলাকায় নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ বন্ধ হওয়ার পর আরো অন্তত ২১ দিন পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যেতে হবে।
– যে কোন রোগী জ্বরে আক্রান্ত হয়ে শ্বাসকষ্ট বা অজ্ঞান হলে দেরি না করে নিকটস্থ রেজিস্টার্ড ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণষ করুন, প্রয়োজনে হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে। তাছাড়া নিপা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়া কোনও দেশ থেকে কেউ বাংলাদেশে আসলে তাকে অবশ্যই পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

উল্লেখ্য, আইইডিসিআর জানায়, মৃত ব্যক্তি রাজশাহীর বাসিন্দা। ওই নারীর কাঁচা খেজুরের রস খাওয়ার ইতিহাস ছিল। এর আগে ২০২২ সালে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার তিনটি ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছিল। যার মধ্যে দুই জন মারা যান।

আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, “এদেশে বাদুড়ের লালা বা প্রস্রাবের মাধ্যমে নিপাহ ভাইরাস ছড়ায়। মানুষ যখন ওই কাঁচা খেজুরের রস পান করে তখন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। সেই ব্যক্তি থেকে তার পরিবারের সদস্য বা স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে এর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে।”

ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, “কাঁচা খেজুরের রস এবং আধা খাওয়া ফল খাওয়া উচিত নয়।”

আইইডিসিআর জানায়, নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ৭১ শতাংশ মানুষ মারা যায়। তাই কাঁচা খেজুরের রস খাওয়া এড়িয়ে চলুন। তবে আইইডিসিআর-এর গবেষকদের মতে, খেজুরের রস গরম করার পর পান করা নিরাপদ। গুড়ও নিরাপদ। প্রতিষ্ঠানটি খেজুরের রস সংগ্রহকারীদের রস সংগ্রহের পর সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার পরামর্শও দিয়েছে।

Development by: webnewsdesign.com