নয় বছর বয়সী একটি উচ্ছল, প্রাণবন্ত ও সাহসী মেয়ে, যে কিনা তার গ্রামের বিভিন্ন সুপরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করে। শিক্ষা, বাল্য বিয়ে, শিশুশ্রম রোধসহ সমাজের নানান কুসংস্কার দূরীকরণে তার ভূমিকা ছিল অসাধারণ। বলছিলাম, ছোটবেলার নির্মল বিনোদনের উৎস জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্র মীনার কথা। কেবল বিনোদনের উৎস হিসেবেই নয়, বরং হাজারো দর্শকের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় এই মীনা কার্টুনটি সমাজ-সংস্কার ও জ্ঞানের আলোয় মানুষকে সচেতন করে তুলেছে।
যে ধারণা থেকে সৃষ্টি কালজয়ী চরিত্র ‘মীনা’
৯০-এর দশকে উপমহাদেশের মেয়েদের অধিকার সুংসহত করার লক্ষ্যে মীনা কার্টুন প্রচারের উদ্যোগ নেয় ইউনিসেফ। এদিকে সেসময়ে চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারের আবিষ্কার ‘মনের কথা’ নামের পাপেট শো’টি প্রচার করা হত বিটিভিতে আর তাতে ‘পারুল’ নামে এক বিখ্যাত মেয়ে চরিত্র বাংলাদেশে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। সেখান থেকেই মূলত কিছু ধারনা নেয় ইউনিসেফ।
পরবর্তীকালে ১৯৯১ সালে বিখ্যাত কার্টুনিস্ট রাম মোহন ইউনিসেফের সহযোগিতায় মিনা কার্টুনের প্রথম অ্যানিমেশন পরিচালনা করেন। এরপর একে একে ১৬টি এপিসোড তৈরি করেন তিনি। এই ১৬টি এপিসোডের কার্যকাল ছিল ২০০১ সাল পর্যন্ত। এই পর্বগুলো রাম মোহনকে সাজাতে সাহায্য করে ইউনিসেফ, হান্না-বারবারা কার্টুনস এবং টুনবাংলা।
মীনার পোশাকে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের গ্রহণযোগ্যতা আনার জন্য রাম মোহন প্রথমেই নানান পোশাকে মীনার বিভিন্ন স্কেচ আঁকতে শুরু করেন। অবশেষে সবগুলোর মধ্যে মীনার লং-স্কার্টের পোশাকটিই চূড়ান্ত করার সিন্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
এছাড়া কার্টুনটিকে একটু মজার ও রসাত্মক করে তুলবার জন্য মীনার পছন্দের পোষা প্রাণী হিসেবে একটি বানরকে রাখার পরিকল্পনা থাকলেও পরবর্তীকালৈ তার বদলে দেখা যায় দুষ্ট মিষ্টি কথা বলা মিঠুকে। অন্যান্য চরিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে- মীনার মা, বাবা, দাদী, ও ছোট বোন রানী, রীতা, মুনমুন, দোকানদার, মোড়ল, দিপু, রিতা, শিক্ষিকা, ফুফু আম্মাসহ অনেকে।
মীনা কার্টুন শুধু বাংলাতেই নয়, হিন্দি, উর্দু, নেপালি, ইংরেজিসহ কমপক্ষে ২৯টি ভাষায় তৈরি হয়েছে। আরবিতেও মীনা কার্টুন ডাবিং করা হয়েছিল। আর প্রথমে মীনার ১৩টি পর্ব বানানো হয় এবং তা প্রচার করা হয় সার্কভুক্ত সাতটি দেশের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে। এছাড়াও অসম্ভব সুন্দর গানটি রচনা করেছেন প্রখ্যাত গীতিকার আরশাদ মাহমুদ এবং ফারুক কায়সার। আর গানে মিষ্টি কণ্ঠটি দিয়েছেন সুষমা শ্রেষ্ঠা।
বাংলাদেশে প্রথম ১৯৯৫ সালে বিটিভিতে মীনা কার্টুন দেখানো শুরু হয়। টেলিভিশনে দেখানোর পাশাপাশি রেডিওতে প্রচারিত হত মীনার অনুষ্ঠান। ৬৮টি ভ্রাম্যমাণ ফিল্ম ইউনিটের মাধ্যমে মীনা পৌঁছে গেছে দেশের আনাচ-কানাচে।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যবিষয়ক উন্নয়নের পাশাপাশি বাল্য বিয়ে, পরিবারে অসম খাদ্য বণ্টন, শিশুশ্রম রোধসহ নানা বিষয়ে সচেতন করা ও কার্যকর বার্তা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে ‘মিনা’ চরিত্রটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রতি বছর ২৪ সেপ্টেম্বর মীনা দিবস পালিত হয়। বিদ্যালয়ে যেতে সক্ষম শতভাগ শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিতকরণ এবং ঝরেপড়া রোধের অঙ্গীকার নিয়ে ইউনিসেফ দিবসটি ঘোষণা করেন।
মীনা কার্টুনটি ছিল সময়ের চেয়েও বেশ এগিয়ে। নব্বইয়ের দশকের মীনার বয়স যদিও এখন ২৮ পেরিয়েছে, তবুও যেন সেই মীনা চরিত্রটি, আজও ছোট্ট হয়েই রয়েছে সকলের মনে।
Development by: webnewsdesign.com