চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েছে আন্তর্জাতিক পর্যটন শিল্পে। ভাইরাস থেকে নিজেকে রক্ষায় পর্যটকরা বন্ধ করে দিয়েছেন বিদেশ ভ্রমণ। বিদেশ ভ্রমণ কমে গেছে বাংলাদেশি পর্যটকদেরও। বিশেষ করে থাইল্যান্ড-সিঙ্গাপুরসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন তারা। আগের বছরের তুলনায় এ বছরের একই সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বাংলাদেশি পর্যটকদের ভ্রমণ কমে গেছে ৭০ শতাংশেরও মতো। আর পর্যটকদের ট্যুর বুকিং না থাকার প্রভাব পড়েছে এয়ার টিকিটিং ব্যবসায়ও
ট্যুর অপারেটররা বলছেন, বছরের শুরুতে করোনাভাইরাস ছড়ানোর পর এই আতঙ্কে গত এক মাস দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি রুটের ফ্লাইটগুলোর কোনোটিই ফুল প্যাকড হয়ে যাতায়াত করেনি। করোনাভাইরাস সংক্রমণের আতঙ্কে অনেকেই দেশের বাইরে ঘুরতে যাচ্ছেন না। অনেকেই আগে কেটে রাখা টিকিট বাতিল করছেন। যারা আগেভাগে প্রোমোশনাল অফারে নন-রিফান্ডেবল (অফেরতযোগ্য) টিকিট কেটে রেখেছিলেন, এখন শুধু তারাই বাধ্য হয়ে যাচ্ছেন। এই সংখ্যাটাও খুবই কম। ব্যবসায়িক বা বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে যাচ্ছেন না।
এ বিষয়ে ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) ডিরেক্টর (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিকেশন্স) মো. শাহেদ উল্লাহ্ জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও সদস্যদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বলতে পারি, আউটবাউন্ড ট্যুরিস্টের (বিদেশগামী পর্যটক) সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে কমেছে। তবে বিদেশ থেকে যারা বাংলাদেশ দেখতে আসেন, সেসব ইনবাউন্ড ট্যুরিস্টের সংখ্যা কমেনি, আগের মতোই আছে। বর্তমানে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়াগামীদের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। যাদের আগে ভিসা নেয়া ছিল তাদের কেউ কেউ এখনো বিশেষ কারণে চীন যাচ্ছেন।
ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিল (ডব্লিউটিটিসি) বলছে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশ থেকে দেশের বাইরে গমনকারীদের মধ্যে ৫২ শতাংশ (পর্যটন, ব্যবসায় ও চিকিৎসার জন্য) ভারতে গেছেন। সৌদিতে গেছেন ১১ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ৫ শতাংশ, বাহরাইনে ৪ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ৪ শতাংশ, অল্প সংখ্যক গেছেন ইউরোপ-আমেরিকা। আর প্রায় ২০ শতাংশই ভ্রমণ করেছেন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। বিদেশগামীদের ৮৭ ভাগই ঘুরতে যান (ট্যুরিস্ট ভিসায়), বাকি ১৩ শতাংশ যান অন্যান্য কারণে।
আগের বছরের তুলনায় এ বছরের প্রথম কয়েক সপ্তাহে এই হার ৩০-৪০ শতাংশের বেশি হবে না বলে জানাচ্ছে ট্যুর অপারেটরগুলো।
অ্যামেজিং ট্যুরসের ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, গত দেড় মাসে বাংলাদেশের বিদেশগামী ট্যুরিস্ট উদ্বেগজনক হারে কমেছে। আগে আমরা যতো ট্যুর বুকিং করতাম, বর্তমানে তার ৩০ ভাগও পাচ্ছি না। পাশাপাশি চীনে নতুন করে কোনো ভিসা ইস্যু হচ্ছে না বিধায় সেখানে যাচ্ছেন না কোনো ট্যুরিস্ট।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ থেকে সারাবছরই ট্যুরিস্টরা যেতেন থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভুটান, ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোতে। এদের মধ্যে থাইল্যান্ড ভ্রমণকারী ট্যুরিস্টের সংখ্যা শীর্ষে ছিল। তবে বর্তমানে এই থাইল্যান্ডেও তেমন ট্যুরিস্ট যাচ্ছেন না। যারা যাচ্ছেন, তারা ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় যাচ্ছেন।
বাংলাদেশের এয়ারলাইন্সগুলো বলছে, চীনে সারাবছরই বাংলাদেশ থেকে ব্যবসায়ী ও পর্যটকরা যাতায়াত করেন। তবে গত চার সপ্তাহ ধরে নেহাত প্রয়োজন ছাড়া কেউ চীন যাচ্ছেন না। ফ্লাইটগুলো প্রায় খালি যাতায়াত করছে।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের জেনারেল ম্যানেজার (জনসংযোগ) মো. কামরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, চীন রুটের ফ্লাইটে করোনাভাইরাসের প্রভাব বড় আকারে পড়েছে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে চীনা নববর্ষের কারণে সেখানকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকে। তাই দেশি ব্যবসায়ীরা সেখানে যান না। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে এখন পর্যটকরাও চীন যাচ্ছেন না।
এদিকে পর্যটকদের ট্যুর বুকিং না থাকার প্রভাব পড়েছে এয়ার টিকিটিং ব্যবসায়ও। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) সভাপতি ও আকাশ ভ্রমণ ট্রাভেল এজেন্সির ম্যানেজিং ডিরেক্টর মনসুর আহমেদ কামাল জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের সংগঠনের সদস্যরা সাধারণত বিমানের টিকিটিং ব্যবসায়ের সাথে জড়িত। করোনাভাইরাসের প্রভাবে চীন, হংকংসহ আশপাশের দেশগুলোতে যাত্রীরা যাচ্ছেন না। এটি আমাদের টিকিটিং ব্যবসায় মন্দাভাব নামিয়েছে।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি একটি আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে ব্যাংকক থেকে ঢাকায় এসেছেন এক যাত্রী। ওই যাত্রী জাগো নিউজকে বলেন, আমার ফ্লাইটে মাত্র ১৭ জন যাত্রী ছিলেন।
গত ২৯ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে গিয়ে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক, ফুকেট এবং ক্রাবি দ্বীপ ঘুরেছেন এক যুবক। সাত দিনের অভিজ্ঞতার বিষয়ে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমি এর আগেও থাইল্যান্ডের একই শহর ও দ্বীপগুলোতে ঘুরেছি। তবে এবারের অভিজ্ঞতাটা ছিল একটু ভিন্ন। প্রথমত ঢাকার বিমানবন্দরে থাই লায়ন এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটটিতে সবার মুখে মাস্ক পরার দৃশ্য দেখে অবাক লাগছিল। করোনাভাইরাস নিয়ে আমাদের বিমানবন্দরে নানা পরামর্শ ছিল। তারপরও থাই লায়ন কর্তৃপক্ষ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ভাইরাস প্রতিরোধে আমাদের কিছু পরামর্শ দিয়েছে। ফ্লাইট ব্যাংককের ডন মিয়াং এয়ারপোর্টে নামার পর আমাদের একবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছে। সেই এয়ারপোর্ট থেকে ফ্লাইট ধরে ফুকেট শহরে যাওয়ার সময় আবারও স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছে। ফুকেটের এয়ারপোর্টে নামার পর আবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছে। এছাড়া ফুকেট থেকে আমরা যখন বাসে ক্রাবি আইল্যান্ডে যাই তখন পর্যটক এবং থাই নাগরিকদের পৃথক বাসে তোলা হয়। বাসের সব যাত্রীর ওপর স্যানিটাইজার স্প্রে করা হয়।
তিনি আরও বলেন, আগেরবার থাইল্যান্ড ভ্রমণের চেয়ে এবারের অভিজ্ঞতা অনেকটাই ভিন্ন ছিল। চাইনিজ নিউ ইয়ার উপলক্ষে পুরো ব্যাংকক ও ফুকেট নগরী সাজানো ছিল। তবে সেখানে তেমন কোনো ট্যুরিস্ট দেখা যায়নি। এমনকি সি-বিচ এবং আইল্যান্ডে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের ট্যুরিস্টের সংখ্যা ছিল কম। যারা ছিলেন সবার মুখে মাস্ক ছিল।
চীনের করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েছে আন্তর্জাতিক পর্যটন শিল্পেও। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে সিএনএন বলেছে, ২০১৯ সালে প্রায় ৫ কোটি চীনা পর্যটক হংকং গিয়েছেন। ২ কোটি ৭৫ লাখ ম্যাকাও এবং থাইল্যান্ডে গিয়েছেন ১ কোটি ১ লাখ পর্যটক। তবে করোনাভাইরাসের কারণে ওই অঞ্চল বা দেশগুলোর এয়ারলাইন্স ফ্লাইট বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়ায় এবং চীনা নাগরিকদের সহজে ভিসা না দেয়ার কারণে সেখানকার পর্যটন শিল্পে ধস নামার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
করোনাভাইরাস ছড়ানোর পর এতে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত ৭২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে চীনে। এদের মধ্যে একজন মার্কিন নাগরিক। চীনের বাইরে ফিলিপাইনে একজন ও হংকংয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৪ হাজার ৫৪৬ জন। চীনসহ বিশ্বের ২৮টি দেশ ও অঞ্চলে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বাকি ২৭টি দেশ ও অঞ্চল হলো- অস্ট্রেলিয়ায়, বেলজিয়াম, কম্বোডিয়া, কানাডা, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, হংকং, ভারত, ইতালি, জাপান, ম্যাকাও, মালয়েশিয়া, নেপাল, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেন, শ্রীলঙ্কা, সুইডেন, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং ভিয়েতনাম।
করোনাভাইরাস আতঙ্কে অনেক দেশই তাদের নাগরিকদের চীন ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এছাড়া বিভিন্ন দেশ তাদের নাগরিকদের চীন থেকে ফিরিয়ে নিচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের এয়ারলাইন্স ইতোমধ্যেই তাদের চীন রুটের ফ্লাইট বাতিল করেছে।
Development by: webnewsdesign.com