“মোরা একটি ফুল কে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করেছি” বাংলাদেশের সুদীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার একটি গানের বিখ্যাত লাইন এটি। আজ রোববার (১১ অক্টোবর) জাতীয় “কন্যা দিবস”। গানের লাইনে একটি ফুল বলতে একটি কন্যা বা একটি ছেলে শিশু উভয়কেই বুঝানো হয়েছে। কারন পাকসেনারা যুদ্ধের সময় কাউকেই তাদের অত্যাচার থেকে রেহাই দেয়নি। কন্যা শিশু আর মহিলাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা ছিল লাগামহীন। তাই শিল্পীরা শোষন, নির্যাতনের প্রতিবাদ করার জন্য তাদেরকে ফুল বলেছেন। ফুলের মতোই নিষ্পাপ, কলুষিত মুক্ত হয় শিশুরা।
অতি প্রাচীনকালের দিকে যদি একটু নজর দেওয়া যায়,যখন মানুষ যাযাবর জীবন যাপন করতো তখন ও কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়াকে পাপ বলেই বিবেচনা করা হতো। কন্যা সন্তান কে পরিবারের অভিশাপ বলে ভাবা হতো। কিন্তুু এমন টা কেন হতো? কন্যা সন্তান কি আসলেই ঝামেলার বস্তুু? এর উত্তর আজও পাওয়া দুষ্কর।
আরবের দেশে ও যদি একটু নজর দেওয়া যায় তখন সেখানেও স্পষ্টত পরিলক্ষিত হয় যে কন্যা সন্তান এর কতটুকু মর্যাদা ছিল তখনকার সময়ে। জীবন্ত মাটিতে কবর দেওয়া হতো কন্যা শিশুকে। কতোটা মানবিকতা শূন্য, হৃদয় বিদারক, করুণ পাষাণসম ঘৃন্য কাজ ছিল এইটা। কন্যা শিশুর জন্ম হয়েছে শুনলেই পিতা মাতা মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয়ে যেত। হায় খোদা, আফসোস হয়, যেখানে তোমার সৃষ্ট একটা কন্যা সন্তানকে তুমি একটা ছেলে সন্তান এর থেকেও বেশি মর্যাদা প্রদান করেছো সেখানে তোমারি সৃষ্টির” সেরা জীব “খ্যাত মানুষেরা কন্যা সন্তানকে কিভাবে প্রতিনিয়তই দলিত, নিষ্পেষিত করছে। ছিঃ! ধীক্কার জানাই এইসব মানুষ নামধারী অমানুষ গুলোকে।
একটা পরিবারে যতোটা সম্মান আর অধিকার পাওয়ার কথা একটা কন্যা শিশুর আজও আমাদের সমাজে অনেক পরিবারেই ততোটা দেওয়া হয়না। অনেক বাবা মা ই ভাবেন মেয়ে বড় হলেই বিয়ে দিতে হবে তাতে কতো টাকা খরচ হবে, আবার এখন মেয়েকে লেখাপড়া ও করাবো তাতেও টাকা খরচ হবে কী দরকার দুই দুইবার একটা মেয়ের জন্য অতোগুলো টাকা খরচ করার। এর থেকে একবারে মেয়ের বিয়ের সময়েই না হয় একটু বেশি করে টাকা খরচ করে ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিবনি। ব্যাস, ঝামেলা শেষ, আবার মেয়ের বিয়ের পর মেয়েও আর আসবেনা তার ভাইয়ের সম্পদে ভাগ বসাতে। তার মানে বিয়েই হলো সহজ প্রক্রিয়া মেয়েকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার। একেই বোধ হয় বলে “সাপ ও মরলো লাঠিও ভাঙলো না। “
এইতো গেলো,একটা মেয়ের পরিবার আর বিয়ের জীবন চক্র। আর তার সমাজ কি বলে এইবার সেটায় আসি। আরে ভাবি মেয়েই তো, কি হবে এতো পড়িয়ে, সেই তো গিয়ে সংসারের হাতা খুনতি ঠেলবে। বাচ্চা কাচ্চা মানুষ করবে। কি আজব আর হাস্যকর কথা! হাসি থামাতেই কষ্ট হয় আমার এই ধরনের কথা শুনলে। কতোটা নির্বোধ হলে পরে মানুষের ভাবনা এতোটা নিকৃষ্ট হতে পারে। তারা এইটাই বুঝে না যে শিক্ষিত আর অশিক্ষিত এর পার্থক্যটা কোথায়। জানি তো, আমিও যে, একটা কন্যা শিশু বড় হলে অবশ্যই তার গন্তব্য স্বামীর ঘরে হবে। সে সংসার করবে, হাতা খুনতি ঠেলবে। কিন্তুু একটা শিক্ষিত মেয়ে তার সংসার টাকে, তার পরিবারকে, তার সন্তানকে যেভাবে সঠিক আদর্শের দীক্ষায় দীক্ষিত করতে পারবেন, অন্য একটা অশিক্ষিত মেয়ে কি তা পারবে নাকি। আশা করি এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া লাগবে না।
আরে সব মেয়েরাই তো হাতা খুনতি চালাবে কিন্তুু কয়জন উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে পরিবার, সংসার আর দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে ভুমিকা রাখবে সেটা কি আপনারা সমালোচনা করার আগে একটুও ভেবে দেখেছেন। আমার তো মনে হয় দেখেন নি। যদি দেখতেন তাহলে এই ধরনের বোকার মতো কথা বলে সমালোচনার ঝড় তৈরি করতে পারতেন না। শিক্ষিত বিবেকবান লোকেরা এর মর্মটা বুঝবেন।
নেপোলিয়ান কি আর মনের সুখেই বলছিল নাকি যে, “আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি শিক্ষিত জাতি দিব।” শিক্ষিত মা এর ওপর শিক্ষিত জাতি নির্ভর করে। কিন্তুু আমরা কি করছি মা তৈরির কথা তো বাদ ই দিলাম, শিক্ষিত সচেতন কন্যা সন্তান ই তৈরি করতে পারছিনা। শিক্ষিত ও আদর্শ মা কি করে তৈরি হবে আমাদের দেশে। আমদের মায়েরা, কন্যা সন্তানেরা আজও অসচেতন তাদের অধিকার থেকে। তারা আজও পুরোপুরি মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলশ্রুততে তারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কন্যারা এখনো বিয়ের পর যৌতুকের জন্য শ্বশুরালয়ে নিগৃহীত হচ্ছে।
যেকোন বিষয়ে মতামত প্রদানেও কন্যাদের দূরেই রাখা হয়। কারন কন্যারা নাকি গুরুত্বপূর্ন মতামত দিতে পারবে না। কারন, মেয়েরা তো বেশি লেখাপড়া করেনা। আচ্ছা আপনারাই বলেন, মেয়েরা লেখাপড়া কেন করে না, কারন তথাকথিত পুরুষ শাসিত সমাজের লেকেরাই তো বলে যে, মেয়েদের এতো পড়তে নেই, শিখতে নেই। আমাদের ব্যর্থতার দায় আমরা আজ সমাজের ওপর দিয়ে দিচ্ছি।
আমরা যদি প্রতিটি কন্যাকে জন্মের পর এইটা বুঝাতে পারি যে মা তুমি ঘরেরলক্ষ্মী। একটা নয় দুইটা ঘরের লোক তোমার কাছে ভালো কিছু আশা করে। তুমি একটা কন্যা বলে পিছিয়ে থাকবেনা। তুমিও বাইরের দুনিয়ায় অবাধ বিচরনের মাধ্যমে সকলের মাঝে তোমার পদাচরনা থাকবে। একটা কন্যার পরিচয় কেবল সে একটা কন্যা এইটাই কেন হবে, তার সবচেয়ে বড় পরিচয় হবে সে একটা মানুষ। যেমনটা একটা ছেলে শিশুর হয়।
সময় পরিবর্তনের কালে আজ আমাদের জাতি অনেক অনেক উন্নত হয়েছে। কিন্তুু আমরা নিজেরা আসলেই মানুষ হিসাবে কি উন্নত হতে পেরেছি, নাকি পারিনি? যদি উন্নতই হতাম তাহলে কি এই “করোনা” মহামারীর সময়েও নারীর প্রতি সহিংস আচরণের ঘটনা ঘটতো? যেখানে বিশ্ব আজ স্থবির মহামারীর আতঙ্কে, ঘর থেকেই বের হচ্ছে না কেউ। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছে একে অন্যের থেকে দূরে অবস্থান করছে। সেখানে আমার দেশে নারীরা নির্যাতিত হচ্ছে প্রতিটা দিন, প্রতিটা মূহূর্তে। তাহলে কি করবো বলবো যে, মানুষ হিসাবে আমরা উন্নত আর সভ্য জাতি।
আসলে আমদেরকেই আমাদের সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজতে হবে। আবেগ দিয়ে নয়, বিবেগ দিয়ে বিচার করতে শিখতে হবে। মনুষ্যত্বের পুরোপুরি বিকাশ ঘটাতে হবে। মানবিক চাহিদার জাগরন ঘটাতে হবে, শুধু মাত্র জৈবিক চাহিদার বিকাশ ঘটালেই চলবে না।
প্রকৃত অর্থেই মান+হুস-মানুষ হতে হবে। মানে আচরনগত পরিবর্তন ও প্রয়োজন সত্যিকারের মানুষ হতে হলে। আমাদের এইটা সবসময়ই মাথায় রাখা উচিত যে, কন্যা বা নারী সেও আপনার আমার মতোই স্রষ্টার মহিমান্বিত সৃষ্টজীব। কন্যা বা নারী কোন পুরুষেরই অযাচিত ভোগ্য পন্য নয় যে তাকে একবার বিয়ের সময় নগদ উপরি দিয়ে কিনে নিয়ে গিয়ে ভোগবিলাসের কয়েকদিন পর আবার ভালো না লাগলে ব্যবহৃত টিস্যুর মতোই ছুড়ে ফেলে দিবনে। আরেকবার যখন আপনার মন চাইবে তখন তাকে জোরপূর্বক তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাচ্ছে তাই ব্যবহার করবেন।
সাবধান, ভুলেও এমনটি ভাববেন না। আপনি এইটা ভুলে যাবেন না যে, আপনি নিজেও কোন না কোন নারীর ই গর্ভজাত সন্তান। আপনার মনে রাখা উচিত, “মায়ের পায়ের নিচে সন্তান এর বেশেহত “। সুতরাং, আপনি পুরুষ বলে, নারীকে বা কন্যাকে সর্বদাই আপনার মতো করে কাজে লাগাবেন আর কাজ ফুরিয়ে গেলে আমার সেই কন্যার গায়েই হাত তুলবেন এইটা ভাবার কোনই অবকাশ নেই।
নারীকে পুরুষের মাথা থেকে বা পুরুষকে নারীর মাথা থেকে তৈরি করা হয়নি যে একে অপরকে নিজের ইচ্ছা মতো চালনা করতে পারবেন। উভয়কেই তৈরি করা হয় মাটির দানা দিয়ে। তাই, অহংকার নয়, নির্যাতন নয়, শাসন-শোষন নয়, সম্মান দিয়ে নারীর প্রতি কথা বলুন, নারীর অধিকার নারীকে ফিরিয়ে দিতে শিখুন।
সানজিদা মাহমুদ মিষ্টি
শিক্ষার্থী, আ ই আর
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
Development by: webnewsdesign.com