ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট অতি সংক্রামক উদ্বেগজনক ও অনিরাপদ

বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারি ২০২২ | ১২:০৭ অপরাহ্ণ

ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট অতি সংক্রামক উদ্বেগজনক ও অনিরাপদ
apps

খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে বিশ্বকে আবারো আতঙ্কিত করে তুলেছে ওমিক্রন। ভ্যারিয়েন্টটি তেমন প্রাণঘাতী না হলেও অতি সংক্রামক হওয়ার কারণে ‘উদ্বেগজনক ও অনিরাপদ’ বলে মন্তব্য করেছেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজির সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা: তৌহিদ হোসাইন। তিনি গতকাল একান্ত আলাপচারিতায় এ কথা বলেন। বিষয়টি বর্তমান প্রেক্ষাপটে জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিধায় নিচে পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরা হলো।

# কেন ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট এত মারাত্মক না হওয়ার পরেও উদ্বেগজনক?
ডা: তৌহিদ হোসাইন : প্রথমত, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে জেনেটিক পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন একটি ভ্যারিয়েন্টের আবির্ভাবের পর রোগজীবাণুর সংক্রমণশীলতা এবং রোগের ভিরুলেন্স ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়া, রোগ শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসায় সমস্যা সৃষ্টি হওয়া, ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কমে যাওয়া এবং রোগের উপসর্গের মারাত্মক মোড় নেয়া- এই ছয়টি নির্দেশকের যেকোনো একটির উপস্থিতিই ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন বলার জন্য যথেষ্ট। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের চরিত্রে এ পর্যন্ত উচ্চ সংক্রমণশীলতা এবং ভ্যাকসিনকে ফাঁকি দেয়ার ক্ষমতা- এই দু’টি বৈশিষ্ট্য প্রবলভাবে থাকার কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে অনায়াসে ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন বা উদ্বেগের ভ্যারিয়েন্ট বলে ঘোষণা করেছে। দ্বিতীয়ত, ভাইরাস বিভাজন বা র্যাপ্লিকেশনকালে যে ভাইরাসের প্রুফ রিডিং ক্ষমতা যত বেশি তার মিউটেশনে রূপান্তর হওয়ার ক্ষমতা তত কম। কারণ র্যাপ্লিকেশনকালে কোনো কারণে ভুল কপি বা মিউটেশন হয়ে গেলেও ডিএনএ ভাইরাসের প্রুফ রিডিং ক্ষমতার জোরে তা সাথে সাথে কারেকশন করে ফেলে। ফলে ডিএনএ ভাইরাসে প্রতি এক কোটি থেকে ১০০ কোটি র্যাপ্লিকেশনের পর মাত্র একবার মিউটেশন হওয়ার চান্স থাকে। দুর্ভাগ্যবশত, আরএনএ ভাইরাসের কোনো প্রুফ রিডিং ক্ষমতাই নেই, ফলে মাত্র প্রতি ১০ হাজার থেকে এক লাখ র্যাপ্লিকেশনের পরই অন্তত একবার মিউটেশনের চান্স থেকে যায়। কিন্তু ব্যতিক্রমী হিসেবে, কেবল করোনাভাইরাসে প্রুফ রিডিং ক্ষমতা আছে। ফলে অন্য ভাইরাসের তুলনায় করোনাভাইরাসে মিউটেশন তুলনামূলকভাবে কম হয়। কিন্তু নতুন করে তৈরি করোনা ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমণশীলতা বৃদ্ধির মতো ক্ষমতার আবির্ভাব হলে মিউটেশনের চান্স বেড়ে যায়। কারণ যত বেশি সংক্রমণ ক্ষমতা, তত মিউটেশন। যত মিউটেশন তত নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট ফর্মেশনের চান্স। এভাবে যত ভ্যারিয়েন্ট ফর্মেশনের চান্স বেড়ে যাবে তত ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্নের আবির্ভাব হওয়ার চান্সও বেড়ে যাবে। যেমন, চীনের উহানে প্রথম আবিষ্কৃত ওয়াইল্ড করোনাভাইরাসের আরও নম্বর (একজন সংক্রমিত ব্যক্তির রোগগ্রস্ত থাকাকালে যতজনকে আক্রান্ত করতে পারে) ছিল ২.৫, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের আরও নম্বর ছিল গড়ে ৭, আর সর্বশেষ ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের আরও নম্বর ১০।

এ দিকে সাইপ্রাস বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজিক্যাল সাইন্সের খ্যাতনামা অধ্যাপক লিওন্ডিওস কস্ট্রিকিস নতুন একটি ভ্যারিয়েন্টের খবর জানিয়েছেন, যার নাম ‘ডেল্টাক্রন’। তিনি এটাকে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের জেনোমের মধ্যে ওমিক্রনের জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের সংমিশ্রণে তৈরি একটি নতুন ভ্যারিয়েন্ট বলতে চাচ্ছেন। অবশ্য অনেক বিশেষজ্ঞ এটাকে এখনই আলাদা ভ্যারিয়েন্ট হিসেবে মানতে নারাজ।
তৃতীয়ত, এর আগের ভ্যারিয়েন্টগুলো শিশুদের এবং টিকা দেয়া ব্যক্তিদের যে হারে পুনরায় করোনায় আক্রান্ত করত, ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টটি তার চেয়ে অনেক বেশি হারে আক্রান্ত করছে। ফলে উদ্বেগ তো থাকবেই।

# তাহলে অনিরাপদ বলছেন কেন?
ডা: তৌহিদ হোসাইন : প্রথমত, এ কথা সত্যি যে, এখনো পর্যন্ত মানুষ করোনার অন্য যে চারটি ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে, তার মধ্যে ওমিক্রনে ভিরুলেন্সি বা রোগগ্রস্ত করার ভয়াবহতার পরিমাণ এবং মৃত্যুর হার সবচেয়ে কম। তাদের হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসায় জটিলতা সৃষ্টির প্রবণতাও কম। কিন্তু ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্নের অন্যান্য নির্দেশক যেগুলোর ফলাফল পেতে খানিকটা অপেক্ষার প্রহর গুনতে হচ্ছে, সেগুলো না আসা পর্যন্ত আমরা নিরাপদÑ এ কথা বলার সময় এখনো আসেনি।

# অনেকেই বলেন, ওমিক্রনের সাথে সাধারণ ঠাণ্ডা লাগা বা ফ্লুয়ের মিল রয়েছে। তাহলে ওমিক্রনকে নিরাপদ ভাবতে অসুবিধা কী?
ডা: তৌহিদ হোসাইন : এই দু’টি রোগের উপসর্গের শুরু প্রায় একই রকম হওয়ার কারণে অনেকে বুঝতেই পারছেন না, তারা ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়েছেন, নাকি সাধারণ ঠাণ্ডা লেগেছে। তাই তারা কোভিড পরীক্ষাও করাতে যাচ্ছে না। তার কারণে নিজেদের আইসোলেশনে রাখারও কোনো উদ্যোগ নেই এবং তাতে আরো বেশি করে ছড়িয়ে পড়ছে করোনার জীবাণু। এ কথাও ঠিক যে, সাধারণত ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং ওমিক্রন-জনিত ঠাণ্ডা লাগা বা ফ্লুÑ উভয়টাই মৃদু উপসর্গযুক্ত এবং হসপিটালাইজেশনের খুব বেশি একটা দরকার হয় না; কিন্তু ইনফ্লুয়েঞ্জা মানুষকে এতটা কাহিল করে না যতটা ওমিক্রন করে। যদিও ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে স্বাদ-গন্ধ, অক্সিজেন সেচুরেশন ইত্যাদি মোটামুটি ঠিক থাকে; কিন্তু এতে ক্লান্তি ও অবসাদ ইনফ্লুয়েঞ্জার তুলনায় অনেক বেশি থাকে। অন্য আরো কয়েকটি উপসর্গ বেশি মাত্রায় দেখা যাচ্ছে ওমিক্রনের ক্ষেত্রে। এখন পর্যন্ত ওমিক্রনের যে যে উপসর্গ লক্ষ করা গেছে, সেগুলো হল : গলাব্যথা, সর্দি, হাঁচি, গায়ে-হাতে-পায়ে ব্যথা ও প্রচণ্ড ক্লান্তি। ওমিক্রনে সংক্রমিত হলে গোড়ার দিকে অনেকেরই গা বমি-বমি এবং মাথা ঘোরার সমস্যা হচ্ছে।

# ওমিক্রন অতি সংক্রামক কী কারণে?
ডা: তৌহিদ হোসাইন : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ মারিয়া ভ্যান কেরক্ষোভের মতে প্রধানত তিনটি কারণে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট এত অতি সংক্রামক। প্রথমত, নতুন রূপের ভ্যারিয়েন্ট এবং এর মিউটেশন সাইট। ফলে নতুন ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টির আরবিডি অংশের মিউটেশন তথা ‘চাবি’ দিয়ে সহজেই মানুষের শরীরের কোষের সারফেসের এসিই-২ এনজাইম নামক ‘তালা’ খুলে প্রবেশ করতে পারে। দ্বিতীয়ত, শরীরে ঢোকার পর আবার চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ‘ইমিউন এস্কেপ’ অর্থাৎ নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডিকে ফাঁকি দেয়া, তা পেয়ে গেছে ওমিক্রন। এর অর্থ, এখন করোনার এই রূপটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সহজেই পাশ কাটিয়ে যেতে পারছে। ফলে কোভিডে সংক্রমিত হলেও শরীরে যে অ্যান্টিবডি থাকে, তাকে ফাঁকি দিতে পারে এই ওমিক্রন। এমনকি টিকা নেয়া থাকলেও, তার অ্যান্টিবডিকে ফাঁকি দিতে পারছে এটি। তৃতীয়ত, এটি আপার রেস্পিরেটরি ট্রাক্টকে সংক্রমিত করছে। করোনার অন্য রূপগুলো ফুসফুসকে বেশি মাত্রায় আক্রান্ত করত, ফলে রোগের মারণ ক্ষমতাসম্পন্ন বা মারাত্মক হতো বেশি কিন্তু তুলনামূলকভাবে ছড়াত কম। গবেষণায় দেখা গেছে ওমিক্রন ফুসফুসের উপরের অংশে অর্থাৎ ব্রংকিয়াল ট্রিতে ডেল্টার তুলনায় ৭০ গুণ বেশি দ্রুত র্যাপ্লিকেট করে আর এইভিওলাইতে অরিজিনাল চীনের উহানের চেয়ে ১০ গুণ কম র্যাপ্লিকেট করে। এই কারণেই ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট অতি সংক্রামক; কিন্তু কম ভয়ঙ্কর।

 

Development by: webnewsdesign.com