এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণ ঘটনার বিচার এক বছরও শুরু হয়নি

শনিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ২:৪১ অপরাহ্ণ

এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণ ঘটনার বিচার এক বছরও শুরু হয়নি
apps

সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মুরারীচাঁদ (এমসি) কলেজের ছাত্রাবাসের ভেতরে এক কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটেছিল সে রাতে। কলেজের মূল ফটকের সামনে থেকে এক তরুণীকে ধরে নিয়ে ছাত্রাবাসের ভেতরে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়েছিল। তরুণীর সঙ্গে ছিলেন তার স্বামীও। স্বামীকে বেঁধে তার সামনেই ধর্ষণ করা হয় স্ত্রীকে।

২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে ঘটেছিল এমন ঘটনা। সেই ন্যাক্কারজনক ঘটনার এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। নানা জটিলতা আর আইনি মারপ্যাচে এক বছরেও শুরু হয়নি দেশ-বিদেশে আলোড়ন তোলা এই ঘটনার বিচার।

এক বছরেও বিচার শুরু না হওয়ায় হতাশা জানিয়েছে মামলার বাদী। তবে আইনজীবীরা বলছেন, করোনার কারণে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় এই মামলার কার্যক্রমে গতি পায়নি। সম্প্রতি মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যালে স্থানান্তর করে গেজেট প্রকাশ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এবার দ্রুত এই মামলার বিচার শুরু হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

এমসি কলেজে ধর্ষণের ঘটনার পর সারা দেশে প্রতিবাদ- আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবাদের মুখে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করে আইন পরিবর্তন করা হয়।

এই ঘটনার বিচারের দাবিতে সিলেটে ‘দুষ্কাল প্রতিরোধে আমরা’ নামে একটি নাগরিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠে। এই দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে তারা। তবে এক বছরেও বিচার শুরু না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে ‘দুষ্কাল প্রতিরোধে আমরা’র সংগঠক আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘ছাত্রাবাসের ভেতর এমন কলঙ্কজনক ঘটনার প্রতিবাদে সারা দেশের মানুষ প্রতিবাদী হয়েছিল। আমরা আশা করেছিলাম সরকার এই ঘটনায় দ্রুত বিচার সম্পন্ন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। কিন্তু এক বছরেও এই মামলার বিচার শেষ না হওয়া হতাশাজনক।’

মামলার সবশেষ অবস্থা:

ধর্ষণের ঘটনার পরদিন ভক্তভোগীর স্বামী বাদী হয়ে নগরের শাহপরান থানায় ধর্ষণ মামলা করেন। এ ছাড়া ওই রাতে ছাত্রাবাস থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় চাঁদাবাজি ও অস্ত্র আইনে আরেকটি মামলা করে পুলিশ।

গত বছরের ২২ নভেম্বর অস্ত্র ও চাঁদাবাজি মামলার অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। এরপর ধর্ষণ মামলায় গত বছরের ৩ ডিসেম্বর ৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া হয়।

চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মোহিতুল হক চৌধুরী মামলার অভিযোগ গঠন করে বিচার কাজ শুরু করেন। অভিযোগ গঠনের পর ২৭ জানুয়ারি মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করেছিল আদালত। তবে ধর্ষণ ও চাঁদাবাজির দুটি মামলা একসঙ্গে একই আদালতে চালানোর জন্য উচ্চ আদালতে আবেদন করে বাদীপক্ষ।

এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের ভার্চুয়াল বেঞ্চ মামলা দুটির বিচার কার্যক্রম একসঙ্গে একই আদালতে সম্পন্নের আদেশ দেন।

এর মধ্যে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্নের লক্ষ্যে মামলাটির দ্রুত বিচার ট্রাইবন্যালে স্থানান্তরের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করে গেজেট প্রকাশ করে।

এরপরই করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় আদালতের কার্যক্রম। ফলে এখন পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গেজেটের কপি আদালতে এসে পৌঁছায়নি।

আদালতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের গেজেটের কপি পৌঁছলে নতুন করে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে এই মামলার বিচার শুরু হবে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী শহিদুজ্জামান চৌধুরী জানান, নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালে ধর্ষণ মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল। তবে আমরা ধর্ষণ ও চাঁদাবাজির দুটি মামলা একইসঙ্গে একই আদালতে চালানোর জন্য উচ্চ আদালতে আবেদন করি। আদালত আমাদের পক্ষে নির্দেশনা দিয়েছে। এরপর মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়।

তিনি বলেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের কোনো মামলায় একই সঙ্গে দণ্ডবিধি আইনের ধারা থাকলে মামলার বিচার একই আদালতে চলতে পারে। কিন্তু একই ঘটনায় পুলিশ দুটি অভিযোগপত্র দেয়ায় বাদীপক্ষের সন্দেহ হয়। এতে ন্যায়বিচার ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি সাক্ষীদের জন্যও বিষয়টি বিড়ম্বনার। চাঞ্চল্যকর এ মামলার সাক্ষীরা দুই আদালতে দুদিন আসবেন কিনা এ নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া অভিযুক্তরা সবাই প্রভাবশালী। এ জন্য বাদীপক্ষ উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন নতুন আদালতে নতুন করে মামলাগুলোর অভিযোগ গঠন করতে হবে। অভিযোগ গঠনের পর বিচার শুরু হবে।’

সিলেট নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পিপি রাশিদা সাঈদা খানম বলেন, ‘করোনার কারণে অন্য মামলাগুলোর মতো এই মামলার কার্যক্রমও আটকে আছে। এতে ভুক্তভোগীও হতাশ হয়ে পড়েছেন।’

তিনি বলেন, ‘মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর হয়েছে বলে শুনেছি। তবে এ সংক্রান্ত কাগজপত্র এখনও হাতে পাইনি। আগামী ১৩ অক্টোবর নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালে এই মামলার তারিখ ধার্য রয়েছে। এর আগে হস্তান্তরের কাগজ আসলে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলাটি চলে যাবে।’

ধর্ষণে অভিযুক্ত যারা:

গত বছরে ৩ ডিসেম্বর চালঞ্চল্যকর এই ধর্ষণ মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা ও মহানগর পুলিশের শাহপরান থানার তৎকালীন পরিদর্শক (তদন্ত) ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য।

অভিযোগপত্রে সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান ওরফে রনি, তারেকুল ইসলাম ওরফে তারেক, অর্জুন লস্কর, আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল ও মিসবাউল ইসলাম ওরফে রাজনকে দল বেঁধে ধর্ষণের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। আসামি রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান ওরফে মাসুমকে ধর্ষণে সহায়তা করার জন্য অভিযুক্ত করা হয়। আট আসামিই বর্তমানে কারাগারে আছেন। তারা সবাই ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে পরিচিতি।

অভিযুক্ত ৮ জনকেই কলেজ কর্তৃপক্ষ স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে। এরপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও এই ৪ জনের ছাত্রত্ব ও সার্টিফিকেট বাতিল করে।

অধ্যক্ষ ও সুপারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার নির্দেশ:

করোনা সংক্রমণের কারণে অন্য সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো তখন এমসি কলেজও বন্ধ। বন্ধ কলেজের ছাত্রাবাস। তবু সরকারি সংগঠনের কর্মী হওয়ার সুযোগ নিয়ে অবৈধভাবে ছাত্রাবাসে অবস্থান করতেন কয়েকজন। তারাই ওই তরুণীকে ধর্ষণ করেন বলে অভিযোগ ওঠে। ধর্ষণের ঘটনা জানাজানির পর বন্ধ ছাত্রাবাসে কিভাবে ছাত্ররা থাকতেন এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এছাড়া ছাত্রাবাসের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্নের মুখে পড়েন কলেজ অধ্যক্ষ ও হল সুপার।

এ নিয়ে সমালোচনার মুখে ধর্ষণের ঘটনায় কলেজের অধ্যক্ষ সালেহ আহমেদ ও হোস্টেল সুপার জীবন কৃষ্ণ আচার্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। চলতি বছরের ২ জুন দায়িত্বে অবহেলার কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলে উচ্চ আদালত।

বিচারপতি মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি কামরুল হোসেন মোল্লার সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ এ নির্দেশ দেন। এতে বলা হয়, ‘ছাত্রাবাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পেছনে মূলত হোস্টেল সুপার ও প্রহরীদের দায়িত্বে অবহেলা ছিল। প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে ওই কলেজের অধ্যক্ষও কোনোভাবে ঘটনার দায় এড়াতে পারেন না।’

Development by: webnewsdesign.com