নারী এবং পুরুষের মাঝে সবচেয়ে পবিত্র এবং শক্তিশালী বন্ধন হল বিয়ে। তবে,হাতের মেহেদির রঙ না শুকাতেই অনেক নারীই তার সংসার হারান,কেউ হারান তার জীবন কেউ বা তার স্বপ্ন।
বাংলাদেশ সহ উন্নয়নশীল দেশ গুলোতে বিবাহিত নারীদের প্রতি স্বামী এবং শ্বশুর বাড়ির লোকজনের সীমাহীন অত্যাচার উদ্বেকজনক ভাবে বেড়ে গিয়েছে।বিয়ে,নিয়ে নারীর সারা জীবনের যে স্বপ্ন তা হারিয়ে যায় নিকষ কাল আঁধারের গল্পে।
“বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুর্যোর” করা জাতীয় পর্যায়ের জরীপ অনুযায়ী,দেশের ৮৭ শতাংশ বিবাহিত মহিলারা,স্বামীর দ্বারা কোন না কোন সময় এবংকোন না কোন ধরণের নির্যাতনের শিকারহয়েছেন।এর মধ্যে রয়েছে শারীরিক,মানসিক,অর্থনৈতিক এবং যৌন নির্যাতন।স্বামীর নির্যাতনের পাশাপাশি রয়েছে স্বামীর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের দ্বারা নির্যাতনের তথ্য।বর্তমানে,আমাদের দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে বাড়েনি মানবীয় গুণাবলীর মান।আমরা শিক্ষিত হয়েছি তবে সেটা কোন মতে পরীক্ষার পাসের মাধ্যমে।তবে,একজন মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি এখনো। বিবাহিত নারীদের প্রতি মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র আমাদেরকে সে কথাই মনে করিয়ে দেয়।
যেহেতু,বিবাহিত নারীরা নানা ভাবে নির্যাতিত এবং প্রতারিত হচ্ছেন তাই বিগত দুই বছর ধরে বিবাহিত নারীদের সাথে নিয়মিত কথা বলার মাধ্যমে তাদের সমস্যা,কষ্ট,হতাশা,অপূর্ণতা বের করার চেষ্টা করেছি।
সেসাথে,তারা কিভাবে এই সমস্যা থেকে বের হতে পারে তার কিছু উপায় খোঁজার চেষ্টা করেছি।
ব্যক্তিগত ভাবে অন্তত ২৫ জন বিবাহিত নারীর সাথে কথোপকথনের মাধ্যমে নারী নির্যাতনের নানা ধরণ সম্পর্কে অবগত হয়েছি।তাদের অনুমতি সাপেক্ষে গুরুত্বপূর্ন ঘটনা গুলোর মধ্য থেকে কিছু ঘটনা ছদ্দ নাম ব্যবহার করে আলোকপাত করতে চাই।
বিবাহিত নারীদের সাথে কথোপকথনের চুম্বক অংশ
ঘটনা ১
শেলি অংকে প্রথম শ্রেণীতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করলেও চাকুরীকে পেশা হিসাবে নেননি।মাস্টার্স পড়ার শেষ পর্যায়ে বেশ ধূমধাম করে বিয়ে হয় বাবা-মার এক মাত্র মেয়ে শেলীর।স্বামী একটি মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানির উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা।
বিয়ের কয় বছর পর ঘর আলো করে ২ সন্তান আসে।স্বামীর ব্যস্ততায় সংসার এবং সন্তানকে আগলে রেখে ছিলেন তিনি।প্রথম দিকে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক বেশ ভাল থাকলে ও ধীরে ধীরে তা ক্রমশ খারাপের দিকে যায়।
তিনি ঘটনার গভীরে যেতে আবিষ্কার করলেন পুরোনো প্রেমিকার সাথে তার স্বামীর যোগাযোগের বিষয়টি।শেলি যখন তার স্বামীর কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলেন তখন নির্যাতিত হলেন,এক বার নয় একাধিক বার।এই ঘটনায় এতটাই মুষড়ে পড়েছিলেন যে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।তবে,সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে তার পক্ষে আত্মহত্যা করা সম্ভব হয়নি।এর কিছু দিন পর তিনি জানতে পারলেন যে তার স্বামী গোপনে ঐ নারীকে বিয়ে ও করে ফেলেছেন এবং এতে তার স্বামীর পরিবারের ইন্দন রয়েছে।আর,কিছুই করার ছিলনা তার।তিনি পরীক্ষার অংক মেলাতে পারলেও জীবনের অংক কোন ভাবেই মেলাতে পারেননি।সিধান্ত নিলেন স্বামীর অফিসে সব কিছু জানাবেন।তবে,সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে পিছিয়ে এলেন।বললেন,আমার এমন নর পিশাচ স্বামীর দরকার না হলেও সন্তানদের পিতার প্রয়োজন।
তাই,আলাদা হয়ে গেলেনতার সাজানো সংসার থেকে তার পূর্বের জীবন সব কিছু থেকে।বিয়ে তার জীবনে এতটাই বিষাদ ভরে দিয়েছে যে নিজের মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে এটা ভাবলে ও হুহু করে কেঁদে ওঠেন।অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন যদি মেয়ের কথাটা ও ভাবতো।
ঘটনা ২
সাবিহা শিক্ষিত একক পরিবারের সন্তান।বাবা মা দুজনেই চাকুরী করেন এক মাত্র ভাইও সুপ্রতিষ্ঠিত।
অনার্স চতুর্থ বর্ষে পড়ার সময় এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে হুট করে,বিয়ের প্রস্তাব আসে।যদিও পরিবার বা তার পক্ষ থেকে তেমন তাড়া ছিলোনা।ছেলে ভাল চাকুরী করেন,পরিবারের সবাই শিক্ষিত খুব ভাল পরিবেশ।এমন তথ্য প্রদানের পাশাপাশি ছেলের পরিবার এমন তোড় জোড় শুরু করলো যে ছেলের পরিবার সম্পর্কে এর বেশি খোঁজ নেয়া সম্ভব হয়নি কিংবা ছেলের বাড়ি যাবার সুযোগ হয়নি।এই অবস্থায় তাদের বিয়ে হয়ে যায়।শ্বশুর বাড়িতে প্রথম যাবার পর পরই তিনি আবিষ্কার করলেন ভয়ানক অসংগতি।সাবিহা জানতে পারলেন তার স্বামীর পরিবারের সদস্যরা তেমন শিক্ষিত নয়।তার উপর তার ননদের স্বামী কিছুই করে না এবং ননদের স্বামীর পরিবারও পরিচয় দেবার মত নয়।
এছাড়া জানতে পারলেন যে,ননদের পুরো পরিবার তার শ্বশুর বাড়ীতে থাকে এবং সাবিহার শ্বশুরের পরিবার এবং ননদের পরিবার পুরোপুরি তার স্বামীর উপর নির্ভরশীল।হঠাৎ মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো আমার সমস্ত স্বপ্ন মুহূর্তে শেষ হয়ে গেল বললেন সাবিহা।তিনি বললেন আমার খুব বেশি এক্সপেকটেশনস ছিলোনা।আমি শুধু চাইতাম একটা হাইলি এডুকেটেড এবং যে যায় করুক তারা যেন ওয়েল এস্টাব্লিশড ফ্যামিলি হয়।ঐ যে ডিগনিটির যে ব্যাপারটা থাকে সেটা না শ্বশুর বাড়ির কারো মধ্যে খুঁজে পেলাম না।
এই পরিবার,কোন দিক থেকেই আমার পরিবারের সাথে যায়না।কেউ শ্বশুর কি করে ননদ কি করে জিজ্ঞেস করলে আরো ভেঙ্গে পড়তাম।বিয়ের পর,বড় করে বিয়ের অনুষ্ঠান করার কথা থাকলেও ছেলের পরিবার কোন কিছুই করেনি।বললেন ছেলের বিয়েটা দিতে হবে তাই হয়ত তারা দিয়েছিলেন।আমি তাদের জন্য কোন একটা প্রয়োজনের অংশ ছিলাম আন্তরিকতার নয়।
কারণ,পুরো পরিবারের চাপ সামলাতে গিয়ে নিজের অনেক ইচ্ছাও তার স্বামী জলাঞ্জলি দিয়েছেন অপর দিকে শাশুড়ি আমার ভাগ্য এমন কি করবে বলে মেনে নিতে বলেছেন।একটা সময় ঘন্টার পর ঘন্টা বিয়ের ভিডিও দেখতাম কিন্তু নিজের ভাগ্য যে এমন হবে কে জানতো?এর আগেও এত ভাল ভাল পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে কিন্তু না করে দিয়েছি।আমরা খুবই সচেতন পরিবার কিন্তু আমাদেরকে সঠিক তথ্য বা প্রকৃত তথ্য না দেবার কারণে এমন অবস্থা।ভুল আসলে আমাদেরি ছিল বিশ্বাস করার ভুল।
আমার মনে সব সময় একটাই প্রশ্ন জাগে,আমি কোন ভাবেই তাদের পরিবারের কোন ক্ষতি করিনি।তাহলে,তাদের পরিবার গুরুত্বপূর্ন সব তথ্য গোপন করে কেন এমন করলো?এটা মেনে নিতে পারিনা।অথচ আমরা আমদের পরিবারের প্রতিটি সদস্যদের ভাল মন্দ সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে বলেছি।অনেকে বলেন,তারা অনেক ভাল মানুষ কিন্তু আমার কথা হল কোন ভাল মানুষ কি তথ্য গোপন করে?কি বলবো বিয়ে টা কে জীবনের সব চেয়ে বড় ভুল মনে হয়।
ঘটনা ৩
সুমন এবং সারিনা দম্পতি দুজনেই চাকুরীজীবী।সারিনা বিয়ের আগে থেকেই চাকরি করতেন।বিয়ের পর স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলে সিধান্ত নিলেন দুজনেই সংসার খরচে অবদান রাখবেন।কথা হয়েছিল সারিনা মাসে ১০ হাজার টাকা দেবেন বাকিটা নিজের মত খরচ করবেন।কিন্তু,কিছু সময় যেতে না যেতেই সারিনার পুরো টাকাটা দিতে হল সুমনকে।সুমন,প্রতি মাসে নিয়মিত ভাবে তার বাড়িতে একটা বিগ এমাউন্ট পাঠান।বিয়ের পরও এর ব্যতিক্রম হয়নি।এরপরও তার শ্বশুর বাড়ীর এটা-সেটা তোঁ কেনা কাটা আছেই।
সারিনা সব চেয়ে অবাক হন বিয়ের পর তার স্বামীর খরচ বাড়লেও তার শ্বশুর বাড়ীর কেউই জিজ্ঞেস করেননি তোমাদের চলতে কষ্ট হয়না তোঁ?উপরুন্ত,সারিনার সবচেয়ে কষ্ট লাগে যখন সুমন তার বাবা মা এমনকি দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের জন্য ও দামী ব্র্যান্ডের কাপড় কেনেন।অথচ এই কেনাকাটার মধ্যে সারিনার বাবা মা এমন কি তার পঞ্চম শ্রেণীতে পড়া এক মাত্র ছোট ভাইটির জন্যও কিছু থাকেনা।
সারিনা,বলেন বিয়ের ৬ বছরের মধ্যে মাত্র একটি ঈদে বাবা,মা আর ছোট ভাইকে ড্রেস কিনে দিতে পেরেছি।শ্বশুর বাড়ির লোকেরা কিছুই চাননা।আবার অনেক কিছুই চান। তারা এমন ভাবে বলেন,আমার জন্য কিনোনা, অমুকের জন্য কেনো আবার অমুক বলে আমার জন্য তমুকের জন্য কেনো মানে সবার জন্যইকেনো।এরপর,কার ছেলে কাকে কি দিয়েছেন এই গল্প ও শোনান।
তিনি বলেন,শ্বশুর বাড়ির লিস্ট এত লম্বা যে নিজের পরিবার এমনকি নিজের কথাও ভুলে যেতে হয়।কারন,সামনের মাসে তো চলতে হবে।সারিনা বলেন,সুমন যদি শুধু মাত্র নিজের টাকায় সংসার চালাতেন তবে এত কিছু কি করার চিন্তা করতেন?বললেন,আমার বাবা মা কি আমাকে বড় করতে কোন কষ্ট করেন নি?তিনি বললেন মানুষ এত ওয়ান আইড হয় কিভাবে ভেবে পায়না।মাঝে মাঝে ভাবি বিয়ে করে নাকি মানুষ চিনতে ভুল করেছি।ব্যাপার গুলো কাউকে না পারি বলতে না পারি সইতে।
ঘটনা ৪
ফাইজার পড়াশোনা করতে একদম ভাল লাগতো না।তাই বাবা ভাবলেন জোর করে হলেও মেয়েকে অনার্স কমপ্লিট করাবেন এরপর ভাল ছেলে দেখে বিয়ে দেবেন।আজ কাল যে অবস্থা তাতে পড়ানোর কোন বিকল্প নেই।অনার্স শেষের দিকে,এক পরিচিত ঘটকের মাধ্যমে এক পরিবারের সাথে ফাইজার জন্য বিয়ের আলাপ হল।
ফাইজার পরিবার,মোটামুটি খোঁজ খবর নিয়ে বেশ ভাল মনে হওয়াই বিয়ে দেবার সিধান্ত নিলেন। ফাইজার বিয়ে হল।বিয়ের কিছু দিন পর থেকে তিনি তার স্বামীর কিছু অদ্ভুত আচরণ দেখলেন।কেমন অস্থির অস্থির একটা ভাব।বিয়ের তিন মাস পর একদিন চা দিতে সামান্য দেরী হওয়ায় তার স্বামী প্রথম বারের মত গাঁয়ে হাত তুললো।এরপর,১ বছর স্বামীর হাতে মার খেলাম কিন্তু পরিবার কে কিছুই জানালাম না।
ভাবলাম,স্বামীর রাগ বেশি।এরপর ১ বছর পর সহ্য করতে না পেরে,বাবা মাকে জানালে,তারা খোঁজ খবর নিয়ে দেখলেন যে সে মাদকাসক্ত।বিয়ের আগে বেশ কয়েকবার রিহ্যাবে ছিল।আমার বাবা আধুনিক মানুষ,এটা ভাবলেন না সমাজ কি বলবে আত্মীয় কি বলবে।আমাকে বাবা বাড়িতে নিয়ে আসলেন।মাস্টার্স ভর্তি করিয়ে দিলেন।আমি পড়ছি এবং ছোট খাট একটা চাকরি ও করছি। তবে,আমার মনে প্রায়ই একটা প্রশ্ন আসে মানুষ কি কারো গাঁয়ে হাত দিতে পারে?আমার একটা ননদ ও ছিল,শ্বশুর বাড়ি থেকে আসার সময় প্রশ্ন রেখে এসেছিলাম।আপনার মেয়েকে আপনার ছেলের মত কোন পাত্রের হাতে তুলে দেবেন কি না?যদি না দেন তাহলে আমার জীবন টা নষ্ট করলেন কেন?কোন উত্তর পায়নি।আমার সংসার নেই।জীবনের খুব বড় একটা দাগ নিয়ে চলে আসেছি। আমার পরিচয় আমি ডিভোর্সি।মানুষকে বিশ্বাস করার সব শক্তি টুকু হারিয়ে ফেলেছি।
ঘটনা ৫
আমার বিয়ের সময় শ্বশুর বাড়ির কোন ডিমান্ড ছিলনা।তারা শুধু বলেছিলেন,বরযাত্রীদের আপ্যায়নে যেন কোন ত্রুটি না হয়।তারা প্রায় ২০০ জন বরযাত্রী নিয়ে এসেছিলেন।বলছিলেন,কেয়া।বিয়ে খুব ভালভাবে সম্পন্ন হয়ে যায়।শাশুড়ি আমার বাবাকে কথা দিয়েছিলেন আমাকে মেয়ের মত রাখবেন। কিন্তু কথা রাখেননি।বিয়ের ১৩ দিনের মাথায়,হুট করে আমার স্বামী আমার বাবার কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা আনতে বললেন।আমি এতটায় অবাক হয়ে ছিলাম যে,বলে উঠলাম তোমরা তো যৌতূক চাউনি,তাহলে এটা কিসের টাকা চাইতে বলছ?আমি জানতাম,আমার বাবার পক্ষ এখন এত টাকা দেয়া সম্ভব নয়।এরপর,থেকে নির্যাতন শুরু হল।তাদের ডিমান্ড সময়ের সাথে বেড়ে গেছে,সেসাথে বেড়ে গেছে তাদের নির্যাতনের মাত্রা ও।তবুও,সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে সব কিছু সয়ে যাচ্ছি। কিন্তু,জানিনা ঠিক কত দিন সহ্য করতে পারবো?
ঘটনা ৬
আমি,একক পরিবারে বেড়ে ওঠা মেয়ে বলছিলেন,অনু।যে,পরিবারের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল তারা যৌথ পরিবার ছিলেন।চার ভাই ২ বোন,শ্বশুর শাশুড়ি সহ বড় পরিবার।কথা,ছিল বিয়ের পর সব ছেলে কে আলাদা করে দেবেন।যেহেতু,দুই ননদ এবং এক দেবর অবিবাহিত ছিল তাই সংসারের খরচ বাকি তিন ভাই মিলে দেবেন।কিন্তু,সময় গড়ালেও আলাদা করে দেয়ার কোন নাম নিচ্ছিলেন না।ধর্মীয় বিধানেও আলাদা করে দেবার কথা বলা হলেও সে বিষয়ে তাদের অনীহা লক্ষ্য করলাম। যেহেতু,আমি একক পরিবার থেকে এসেছি।আমি আমার জিনিস পত্র অন্য কেউ ব্যবহার করা পছন্দ করতাম না।কিন্তু এখানে এসে দেখলাম নিজের কিংবা নিজের জিনিস কোনটারই প্রাইভেসি মেইন্টেইন করা সম্ভব হচ্ছেনা।
আমার শাশুড়ি ঘরের দরজা দেয়া পছন্দ করতেন না,স্বামীর সাথে বাইরে যাওয়া পছন্দ করতেন না।যদিও বা কোথাও যেতাম সাথে দুই তিন জন থাকতোই।যে কারণে স্বামীর সাথে একান্ত মুহূর্ত কাটানো বা সময় কাটানো একেবারে অসম্ভব ছিল।
এক্ষেত্রে,স্বামীর ভূমিকাও ছিল একেবারে নির্বিকার।আমার শাশুড়ি রান্না ঘরের দায়িত্ব কাউকে দিতে চাইতেন না।সারাদিন,সবাই ঘর পরিষ্কার,কাঁটা,ধোঁয়া সব কাজ করলেও তিনি দিনের বেলাতে ঘুমাতেন।কেবল খাওয়া আর নামাজের সময়টা উঠতেন।আমরা,সবাই রাতের বাসি খাবার খেতাম।কেবল,আমার ননদ এবং দেবররের জন্য স্পেশাল খাবার খাওয়ার অনুমতি ছিল।
উনি কাজ শুরু করতেন ঠিক তার ছেলেরা বাইরে থেকে আসার কিছুক্ষণ আগে থেকে।আমার স্বামী একদিন আমাকে বললেন,তোমরা তিন জন বউ থাকতে মা এখনো কষ্ট করে কাজ করে,তাহলে তোমরা কি করো সারাদিন?আমার আসলে উত্তর জানা ছিলনা।
শ্বশুর বাড়িতে পছন্দের কোন খাবার খাওয়া ও সম্ভব ছিলনা।মোট কথা একেবারে বন্দি জীবন।স্বামীর ধরি মাছ না ছুঁই পানি আচরণ,শাশুড়ির পক্ষপাত মূলক আচরণ সব কিছু মিলিয়ে আর মানাতে পারছিলাম না।
হয়ত,আপনার কাছে খুব স্বাভাবিক বা সামান্য মনে হতে পারে কিন্তু সব কিছু আমার পক্ষে মেনে নেয়া আর সম্ভব হচ্ছিল না।তাই,বাবার বাড়ি চলে আসি।ওনারা,সাফ জানিয়ে দিয়েছেন পরিবার ভাংবেন না।আর,আমি ও জোড়াতালির মাঝে থাকতে রাজি না।
আমার এক মাত্র ভাইকে বিয়ের আগেই আলাদা করে দেয়া হয়েছে।একই বিল্ডিং এর ভিন্ন ভিন্ন এপার্টমেন্টে।ভাইয়ের বিয়ের কিছুদিন আগেই আম্মু ভাইয়ার এপার্টমেন্টে গুছিয়ে দিয়েছিলেন।রান্না মিলেমিশে করা হয়।তিনদিন ভাইয়া ভাবী আমাদের বাসায় এবং তিনদিন দিন আব্বু আম্মু ভাবীদের বাসায় খাওয়া দাওয়া করেন।আম্মু ভাবীর পছন্দের রান্না করেন আর ভাবী আম্মু আব্বুর পছন্দের খাবার রান্না করেন।মানে,উভয় পক্ষের মাঝে চমৎকার বোঝা-পড়া।
ভাবীর সাথে আমাদের সবার সম্পর্ক অনেক মধুর।দিন শেষে ওনার একটা আলাদা জগত আছে,যে স্পেস টা দরকার সেটা আছে।কোন কিছু নিয়ে ওনাকে ইনসিকিউরড ফিল করতে হয়না।লাইফে সব জায়গায় একটু স্পেস দরকার।
যদিও আমি বিয়ে এবং সামাজিক সম্পর্কের কোন বিজ্ঞ বিশারদ নই,তবুও বিভিন্ন ঘটনার পরি প্রেক্ষিতে আমার মনে হয়েছে আমাদের সমাজে সব দিক থেকে নারীর প্রতি মাত্রারিক্ত প্রত্যাশা এবং দায় দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়।
অন্য কিছু বাদই দিলাম,এত কম্প্রোমাইজ করার বিনিময়ে নারীর যে ভালবাসা এবং সম্মানপ্রাপ্য সেটি থেকেও তারা বঞ্চিত হচ্ছেন।নানা ভাবে তাদেরকে দমানো,ঠকানো এবং নির্যাতন করা হচ্ছে। ফলে,ভেতরে ভেতরে নারীদের মনে ক্ষোভ পুঞ্জিভিত হচ্ছে।
অনেক বিবাহিত নারীই হয়ত সামাজিক বা পারিবারিক বা সন্তানের কারণে অনেক কষ্ট করে সংসার করছেন।তবে,সংসার এবং স্বামীর প্রতি ভালবাসা অনেক আগেই জলাঞ্জলি দিয়েছেন।প্রথমে ছোট ছোট ক্ষোভ থেকেই তাদের হৃদয়ে বড় আকারে জমা হয়েছে ঘৃণার আগুন।
বিভিন্ন নারীদের সাথে কথা বলার মাধ্যমে আমার কাছে পাত্র পক্ষের যে মিথ্যা গুলো ধরা পড়েছে সেগুলো হল-
পাত্রপক্ষ সাধারণত যে তথ্য গুলো পাত্রী পক্ষের কাছে গোপন করে থাকে
• তাদের প্রকৃত সামাজিক,অর্থনৈতিক অবস্থা এবং আয়ের উৎস
• পরিবারের প্রতিটি সদস্যদের প্রকৃত অবস্থা
• শিক্ষাগত যোগ্যতা
• ছেলে বা ছেলের পরিবারের কোন সদস্যের মাদকাসক্তির বিষয়
• ছেলের পরিবারের কোন সদস্যদের কোন ধরণের সমস্যা বা কমতির কথা যা পুর্বে জানা জরুরী।
• ছেলের মানসিক বা শারীরিক সমস্যা
• ছেলের কোন জটিল রোগের কথা
• পূর্বে কোন বিয়ে হয়ে থাকলে বিষয়
• সম্পত্তির মিথ্যা তথ্য(যা নেই সেটিও বলে)।মানে,বাড়িয়ে মিথ্যা তথ্য দেয়া।
• চকুরি সংক্রান্ত তথ্য।
সুতরাং,আপনার কন্যাকে পাত্রস্থ করার আগে উপরিক্ত তথ্য গুলো ভাল করে জেনে নিন।
বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়ের পিতা মাতার জন্য যে বিষয় গুলো জানা বা মানা গুরুত্বপূর্ন
• পৃথিবীর সব চাইতে ভাল ছেলের পরিবারের কাছ থেকে বিবাহের প্রস্তাব পেলেও তাড়াহুড়ো করবেন না।মনে রাখবেন,খুব তাড়াহুড়োর মাঝে কিন্তু অনেক কিন্তু লুকিয়ে থাকে।
• বিয়ের প্রস্তাব যার মাধ্যমেই আসুক না কেন,তার কথার উপর পুরোপুরি আশ্বস্ত না হয়ে নিজেরা ব্যক্তিগত ভাবে খোঁজ খবর নেয়ার চেষ্টা করুন।আশপাশের মানুষ মানে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে কিছুটা গোপনে খোঁজ নিন।
• অনেকেই পরিবারের অনেক দূর সম্পর্কের আত্মীয় বা মামা চাচার যোগ্যতার বিষয়ে ফোকাস করে থাকে।মনে রাখবেন,আপনি কিন্তু ঐ পরিবারের আত্মীয়ের সাথে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন না।
• সেক্ষেত্রে যে আপনি যে পরিবারের যে পাত্রের কাছে আপনার মেয়ে পাত্রস্থ করবেন তার পুরো পরিবারের প্রতিটি সদস্য সম্পর্কে খোঁজ খবর নিন।তাদের প্রতিটি সদস্যের শিক্ষাগত যোগ্যতা,তারা কি করে,পরিবারের সবাই স্বনির্ভর কিনা প্রতিটি বিষয় জেনে নেয়া উচিত।
• ছেলে কত বেতন পায় এটা জানার চেয়ে খোঁজ নিন আসলেই তিনি চাকুরী করেন কিনা।কারণ অনেক পরিবারের লোকজন ছেলে চাকুরী না করলেও ছেলে বড় চাকরি করে বলে জাহির করে।
• ছেলের বোন বা ভাই থাকলে তারা কি করে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং তাদের বিয়ে হলে কোন পরিবারের সাথে তাদের বিয়ে হয়েছেএবং তারা সবাই কি করে সে সম্পর্কে খোঁজ নিন।
• যদি জানেন ছেলে ব্যবসা করে,তাহলে আগে নির্দিষ্ট করে জানুন সে কিসের ব্যবসা করে এবং ব্যবসায় তার ইনভেস্টমেন্টের উৎস বৈধ নাকি অবৈধ।
• অনেকে সরকারী চাকুরি করে শুনলে আর কিছু দেখতে চাননা।জানার চেষ্টা করুন,সে নির্দিষ্ট কোন পদে আছে এবং তার বিরুদ্ধে কোন অনিয়মের অভিযোগ আছে কিনা?
• অনেকেই আছে,বেসরকারি চাকুরি করে এবং নিজেকে বড় কর্মকর্তা বলে পরিচয় দেয়।সেক্ষেত্রে সে কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করে এবং কোন পদে আছে সে বিষয়ে ভালভাবে জেনে নিন।
• যৌতুকের ব্যাপারে তাদের মনোভাব জানার চেষ্টা করুন।যদি,যৌতুকের ব্যাপারে পাত্র পক্ষের মনোভাব ইতিবাচক হয়,তবে বিয়েতে আপনার মনোভাব নেতিবাচক হওয়াই শ্রেয়।
• পাত্র এবং পাত্রী পক্ষের সামজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের সাথে খুব বেশি ব্যবধান আছে কিনা সেটি ভাল করে যাচায় করুন।পাত্র পক্ষের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা যদি পাত্রী পক্ষের চেয়ে অনেক ভাল হয়,তবে তাদের আচার-অনুষ্ঠান বা সামাজিকতার সাথে খাপ খাওয়ানো পাত্রী পক্ষের জন্য বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।যা,পাত্রী পক্ষের জন্য বেশ বিব্রতকর হতে পারে এবং বিয়ের পর পাত্রীকে বিভিন্ন ধরণের খোটার সম্মুখীন ও হতে পারে।
• ধর্মীয় বিশ্বাসে কোন মত পার্থক্য আছে কিনা সে বিষয়ে ও জেনে নিন।
পাত্রী পক্ষের কর্তব্য
সুতরাং,বিয়ের কথা চলা-কালীন সময় যেভাবে পাত্র পক্ষের খোঁজ খবর নেবেন একই ভাবে নিজেদের সম্পর্কে সকল বিষয়ে সঠিক তথ্য প্রদান করবেন।মেয়ের উচ্চতা,গায়ের রঙ,চুল, শিক্ষা সম্পর্কে সত্য তথ্য উপস্থাপন করুন।কোন ভাবেই ছল বা মিথ্যার আশ্রয় নেবেন না।
• মেয়ের যদি কোন বিশেষ রোগ বা সমস্যা থাকে সেটি অ্যাজমা হোক আর আর থাইরয়েড হোক বা অন্য কোন সমস্যা থাক তা পাত্র পক্ষকে বিনয়ের সাথে জানান।একই ভাবে পাত্রের ব্যাপারে ও জেনে নিন।
• মেয়ের পূর্বে যদি কোন বিয়ে থাকে তা গোপন করবেন না।যদি সেই বিয়ে মাত্র এক দিনের জন্য ও টেকে সেক্ষেত্রে ও না।
• দয়া করে কোন কিছু গোপন করে বিয়ের পর বলবেন এমনটি করবেন না।বিয়ের পর না মেনে নিয়ে কি করবে এমন চিন্তা এক প্রকার অন্যায় এবং অসাধুতা।
• পরিবারের কোন সদস্যের কোন ভুল থাকলেও সেটি খোলা খুলি আলোচনা করুন।ধরুন,আপনার এক সন্তান এমন এক মেয়েকে ভালবেসে বিয়ে করেছে যা আপনার পরিবারের কেউ মেনে নেননি,এমন বিষয় ও গোপন করবেন না।যেন এমন না হয় আপনারা বলেননি কিন্তু অন্য কারো মাধ্যমে থেকে পাত্র পক্ষ জানতে পারলো,তাতে কিন্তু আপনার পরিবারের সম্মান হানি হবে।
• আপনার সব সত্য জেনে এবং মেনে যদি কেউ আপনার কন্যাকে সাদরে গ্রহণ করতে চাই তবে মনে করবেন সেখানেই আল্লাহর রহমত রয়েছে।
• বিয়ের সময় দেনমোহর বাস্তবতার ভিত্তিতে ধার্য করুন।মনে রাখবেন আপনি কন্যাকে বিক্রি করছেন না।ছেলের সামর্থের ভিত্তিতে বাস্তব সম্মত দেনমোহর ধার্য করুন।
আশা করি জীবনের সবচেয়ে সুন্দর এবং পবিত্র সম্পর্কের বন্ধনে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোন পক্ষই মিথ্যা,প্রতারণা বা মিথ্যার আশ্রয় নেবেন না।
বিয়ের পরও মেয়ের খোঁজ খবর নেয়ার চেষ্টা করুন।তবে,অযাচিত ভাবে মেয়ের সংসারে খবর দারি করবেন না।তবে,মেয়ে যদি তার কোন সমস্যার কথা বলে তবে সেটা গুরুত্ব সহকারে নিন।
মনে রাখবেন,আপনার সামান্য ভুলে আপনার কন্যার জীবনে সারা জীবনের দুঃখ নেমে আসতে পারে।নিজেদের দামী গহনা রাখার জন্য যেমন নিরাপদ জায়গা খোঁজেন ঠিক আপনার কন্যার জন্য ও এমন একটি নিরাপদ জায়গা খুঁজুন যেন আপনার অনুপস্থিতিতেও সে ভাল থাকে কিংবা ভাল রাখে।
আর হ্যা,বিয়ের আগে প্রতিটি মেয়েরই উচিত, পড়াশোনা শেষ করা এবং নিজের পায়ে দাড়ানো।যাতে,কেবল কপালের দোষ দিয়ে বাকি জীবন না কাটাতে হয়
সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা।
লেখক: পুষ্টিবিদ, বেক্সিমকো ফার্মা লিমিটেড।
Development by: webnewsdesign.com