একাত্তরের এইদিনে তানোরে শহীদ হন ২ মুক্তিযোদ্ধা

রবিবার, ২৯ নভেম্বর ২০২০ | ৬:৪৩ অপরাহ্ণ

একাত্তরের এইদিনে তানোরে শহীদ হন ২ মুক্তিযোদ্ধা
apps

চারদিকে জয়ধ্বনী। মুক্তিযোদ্ধারা আত্মবিশ্বাসী। ১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে তারা হামলা চালিয়েছিলেন রাজশাহীর তানোর থানায়। সেটি তখন অবাঙালী পুলিশ আর পাকিন্তানি সেনাদের ঘাঁটি। ২৯ নভেম্বর সন্ধ্যার পর মুক্তিযোদ্ধারা তানোর থানা আক্রমণ করেন। এতে শহীদ হন দুই মুক্তিযোদ্ধা।

এটিই ছিল তানোরে সর্বশেষ সম্মুখযুদ্ধ। এই যুদ্ধের একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা দুই সহযোদ্ধার লাশ নিয়ে পিঁছু হঁটতে বাধ্য হয়েছিলেন। তারপর পাকিস্তানি সেনারা তানোর ছেড়েছিল ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে। ১৪ ডিসেম্বর তানোর থানায় নিজ হাতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন রাজশাহী সদর মহকুমার গেরিলা লিডার বীর মুক্তিযোদ্ধা সফিকুর রহমান রাজা। সে সময় তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র। একাত্তরে রাজশাহীর তানোর, গোদাগাড়ী, পবা এবং মোহনপুর থানা এলাকায় সম্মুখ সমর হতো সফিকুর রহমান রাজার দিকনির্দেশনায়। দিনগুলোর কথা এখনও স্পষ্ট মনে আছে এই গেরিলা যোদ্ধার। শুক্রবার (২৭ নভেম্বর) রাতে দীর্ঘ আলাপচারিতায় তিনিই শুনিয়েছেন তানোর থানা আক্রমণের সেই গল্প।

সফিকুর রহমান রাজা বলছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তানোর থানা একাধিকবার আক্রমণ করা হয়। এর মধ্যে আগস্টের শেষের দিকে একটি সফল অপারেশন হয়। সেদিন থানা থেকে মুক্ত করে আনা হয় ছয়জন মুক্তিযোদ্ধাকে। এদের মধ্যে চারজনই ছিলেন আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের যুবক। এই ছয়জনসহ আমরা মোট ৫০ থেকে ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা পবার দুয়ারি ও বাগধানী ব্রিজ উড়িয়ে দেয়ার অপারেশনে যাই। কারণ, পাকিস্তানি সৈন্যদের গাড়ি চলাচল বন্ধ করতে পারলে তাদের কোণঠাসা করা সহজ হবে। কিন্তু দুয়ারিতে যাওয়ার পর পাক হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ফেলে। শুরু হয় সম্মুখ সমর। সারারাত যুদ্ধ চলে। অস্ত্র-গোলাবারুদের সংকটে ভোরের দিকে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। যে যেদিক দিয়ে পারেন এলাকা ত্যাগ করেন। পথে বুরুজ ঘাট এলাকায় মুসলিম লীগের এজেন্ট আইয়ুব আলী চেয়ারম্যান ছয় মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে ফেলে। চার আদিবাসীসহ এই ছয় মুক্তিযোদ্ধাকে তানোর থানায় নিয়ে বন্দী করে রাখা হয়। তখন আমার অধীনে ৩৫ থেকে ৪০ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধদা ছিলেন।

সফিকুর রহমান রাজা বলেন, আমরা মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে থাকতাম। আমি নিজে থাকতাম গোদাগাড়ীর সৈয়দপুর গ্রামে। ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা ধরা পড়ার খবরটা পেলাম বিকালে। ওই সময় সারাদিন যাদের ধরে নিয়ে থানায় নেয়া হতো তাদের আবার সন্ধ্যার পর ট্রাকে করে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের জ্জোহা হলে নিয়ে চলে যাওয়া হতো। ভাবলাম, মুক্তিযোদ্ধাদের সেখানে নিয়ে নির্যাতন করা হবে। নির্যাতনের কারণে তারা যদি আমাদের শেল্টারগুলোর তথ্য জানিয়ে দেয় তাহলে সবাই বিপদে পড়ব। তাই যে করেই হোক তাদের উদ্ধার করতে হবে। কিন্তু আমাদের হাতে সময় ছিল কম। আমি সবাইকে খবর দিলাম, সন্ধ্যার পর পরই থানায় আক্রমণ হবে। সে অপারেশনে আমি সরাসরি যাইনি। ২৫-৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা তানোর থানা আক্রমণ করলেন। ঝটিকা এই আক্রমণে থানার অবাঙালী পুলিশ আর পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে টিকতে পারল না। বেশ কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর তারা থানা ছেড়ে পালিয়ে গেল।

এরপর মুক্তিযোদ্ধারা থানায় ঢুকে বন্দী অবস্থায় ছয় মুক্তিযোদ্ধাকে পেলেন। কিন্তু তালা খোলার উপায় ছিল না। তাই গুলি করে তালা ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছিল। তখন একটি গুলি ঘুরে এসে একজন মুক্তিযোদ্ধার পায়ে লাগে। তিনি গুরুতর আহত হন। শেষে তালা ভেঙে ছয় মুক্তিযোদ্ধাকে উদ্ধার করা হয়। তারা ছিলেন অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার। কারও চোখ অন্ধ করে দেয়া হয়েছিল, কারও দু’চারটা করে দাঁত ভেঙে দেয়া হয়েছিল। এই সাতজনকে চিকিৎসার জন্য ভারতে পাঠানো হয়েছিল। যার পায়ের মাংসে গুলি লেগেছিল তিনি থানা থেকে এক ধাপও হাঁটতে পারেননি। অনেক কষ্ট করে তাকে থানা থেকে এনে ভারতে পাঠাতে হয়েছিল।

বীর মুক্তিযোদ্ধা সফিকুর রহমান রাজা বলেন, ছয়জন মুক্তিযোদ্ধাকে মুক্ত করে আনা হলেও পাকিস্তানি সেনারা আবারও তানোর থানায় আস্তানা গেঁড়েছিল। সে কারণে আমি আবারও তানোর থানা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিই। ২৯ নভেম্বর সন্ধ্যার পরই আক্রমণ শুরু করা হয়। কিন্তু প্রথমবার পরাস্থ হবার পর পাকিস্তানি সেনারা বাংকার তৈরি করেছিল খুব ভালভাবে। মুক্তিযোদ্ধারা সুবিধা করতে পারছিলেন না। এই যুদ্ধে দুইজন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত বরণ করেন।

শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র সৈয়দ মোনায়েম মঞ্জুর ও রাজশাহীর কাটাখালীর মাসকাটাদিঘী বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র মো. ইসলাম। সৈয়দ মোনায়েম মঞ্জুরের বাড়ি ছিল গোদাগাড়ীর সৈয়দপুর গ্রামে। আর ইসলামের বাড়ি হরিয়ান সুগার মিল এলাকায়। এই যুদ্ধে হরিয়ান সুগার মিল এলাকার আরেক মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম মৃধা আহত হয়েছিলেন। সেদিন যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমান ও সৈয়দ মোনায়েম মঞ্জুর। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম মৃধা সম্প্রতি মারা গেছেন।

সফিকুর রহমান রাজা বলেন, তানোর থানা আক্রমণের সময় দুইজন সহযোদ্ধা শহীদ হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা লাশ নিয়ে পিঁছু হঁটতে বাধ্য হন। আমরা দুই শহীদের লাশ গোদাগাড়ীর সৈয়দপুর গ্রামে নিয়ে যাই দাফনের জন্য। খবর পেয়ে পাকিস্তানি হায়েনারা আবারও সৈয়দপুর গ্রামে আক্রমণ করে। আমরা বাড়ির ভেতর লাশ রেখে সরে যাই। পাকিস্তানি সেনারা অনেকের বাড়িতে আগুন দিয়ে জ¦ালিয়ে দেয়। তারা চলে যাওয়ার পর ৩০ নভেম্বর দুপুরে আমরা গ্রামে ফিরতে পারি। তারপর বিকালের দিকে দুই শহীদের মরদেহ গোরস্থানে দাফন করা হয়। রাজা বলেন, সৈয়দপুর গ্রামে দুই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবর রয়েছে। এটা গ্রামবাসীর জন্য গর্বের।

বীর মুক্তিযোদ্ধা রাজা বলেন, ২৯ নভেম্ববরের তানোর থানা আক্রমণের ফলাফল অমিমাংসিত থাকার পর আমরা আবারও হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এরই মধ্যে বিভিন্ন স্থান থেকে বিজয়ের খবর আসতে থাকে। পাকিস্তানিদের মনোবল দুর্বল হয়ে পড়ে। যতদূর মনে পড়ে ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে তারা তানোর থানা ছেড়ে চলে যায়। ১৪ ডিসেম্বর আমি গিয়ে তানোর থানায় বাংলাদেশের পতাকা ওড়াই। তারপর সেদিনই মোহনপুর থানায় গিয়ে বাংলাদেশের পতাকা তুলি।

Development by: webnewsdesign.com