একজন শিক্ষার্থী নিয়েই চলছে পাঠদান প্রাথমিক বিদ্যালয়ে 

বৃহস্পতিবার, ১৯ মে ২০২২ | ১১:২৭ পূর্বাহ্ণ

একজন শিক্ষার্থী নিয়েই চলছে পাঠদান প্রাথমিক বিদ্যালয়ে 
apps

একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্বাভাবিক চিত্র যেমন হওয়ার কথা- সকালবেলা অ্যাসেম্বলিতে লাইন দিয়ে দাঁড়ানো থাকবে বিভিন্ন বয়সী শিক্ষার্থী। জাতীয় সংগীত শেষে সবাই যার যার শ্রেণিকক্ষে চলে যাবে। রোল কল হবে, পাঠদান শুরু হলে শোনা যাবে শিক্ষার্থীদের পড়ার শব্দ। আর স্কুল শেষে ছুটির ঘণ্টা বাজলেই হৈ হৈ করে দৌড়ে বের হবে শিক্ষার্থীরা।

কিন্তু বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ময়নাপুর গ্রামে রয়েছে এমন একটি স্কুল যেখানে শিক্ষার্থী ভর্তি রয়েছেন মাত্র একজন।ময়নাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামের স্কুলটিতে একমাত্র শিক্ষার্থী দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। স্কুলটিতে শিক্ষকের সংখ্যা তিনজন। সেখানে নেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চেনা কলকাকলি।

স্কুলটির এখন জরাজীর্ণ অবস্থা। টিনের চালে মরিচা ধরেছে।বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক স্বপ্না রানী বলেন,সব কিছুই আর সব স্কুলের মতো হয়- ক্লাস, অ্যাসেম্বলি, স্কুলে ক্লাস শেষে ঘণ্টা বাজে। কিন্তু আমাদের একটা মাত্র বাচ্চা। একজন মাত্র শিক্ষার্থী নিয়ে কি করা যায় বলুন? আমরা তাকে পাশে বসিয়ে মায়ের মতো পড়াই।

একমাত্র এই শিক্ষার্থীর জন্য স্কুলটিতে আলাদা একটি কক্ষ রয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণির তিনটি বিষয়- বাংলা, গণিত, ইংরেজি তিনজন শিক্ষক ভাগ করে পড়ান।

স্বপ্না রানী বলেন, সে মোটামুটি ভাল ছাত্র। কিন্তু একটা স্কুলে স্টুডেন্ট না থাকলে কী রকম হয় বলেন? মনে হয় যেন ফাঁকা, কোনও প্রাণ নেই। মনের দিক থেকে আমার মানতে ইচ্ছা করে না।

তিনি জানান, প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে ভর্তিযোগ্য আরও চারজন শিশু রয়েছে কিন্তু তাদের জন্ম নিবন্ধন সনদপত্র না থাকায় স্কুলে ভর্তি করা সম্ভব হয়নি। ভর্তি না হলেও তাদের স্কুলে আসার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।

কিন্তু এই স্কুলটির এমন হাল কিভাবে হল তার পেছনে রয়েছে অন্য আরেক কারণ। আর তা হল গত কয়েক বছর ধরেই গ্রামটিতে শিশু জন্মের হার কম। তাই প্রাথমিক স্কুলে যাওয়ার বয়সী শিশু নেই।

ময়নাপুর গ্রামের বাসিন্দা তাপস কুমার মণ্ডলের দেওয়া ৩৭ শতক জমির উপর স্কুলটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৯১ সালে এবং এক সময় স্কুলটির প্রধান শিক্ষক ছিলেন তিনি। ২০১৩ সালে স্কুলটি সরকারিকরণ হয়েছে।

তাপস কুমার মণ্ডল বলেন, “ময়নাপুর গ্রাম হাওড়ের মধ্যে একটি দ্বীপ, চারিদিকে পানি। এখানে ৪৬টি পরিবারের বাস। এক সময় ৬০ জনের মতো ছেলেমেয়ে ছিল যাদের সবাই বড় হয়ে মাধ্যমিকে চলে গেছে। গ্রামটিতে গত চার বছরে পাঁচটি মাত্র নতুন শিশু জন্ম নিয়েছে। তারা কেউই এখনও স্কুলে ভর্তির যোগ্য নয়।”

“গ্রামটিতে শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাস। তাদের মধ্যে থেকে ১৮টি পরিবার ভারতে চলে গেছেন। যে পরিবারগুলো রয়ে গেছে তাদের বেশিরভাগেরই একটি করে সন্তান। তাদের মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ের ছেলে মেয়ে আর নেই। এখানে বাচ্চা নেওয়ার হার কম। বছরে একটা করে বাচ্চা জন্ম হলে তারা বড় হবে তারপর না স্কুলে আসবে।”

তাপস কুমার মণ্ডল বলেন, একদম শুরু থেকে অনেক বছর পাশের দুটি গ্রাম থেকে মুসলিম ছেলেমেয়েরাও এই স্কুলে পড়তে আসতে। তখন শিক্ষার্থীদের গম দেওয়া হতো। সেজন্য পাশের দুটি গ্রাম থেকে অনেক ছেলেমেয়েই এখানে আসতো। পরে গম দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া অনেক পরিবার কাজের জন্য অন্যত্র স্থানান্তর হয়েছেন। সাথে করে নিয়ে গেছেন শিশুদের। সব মিলিয়ে আমাদের ছেলে মেয়ে কমতে থাকে।

আর ২০১৬ সালের দিক থেকে স্কুলের ভর্তির ক্ষেত্রে ‘ক্যাচমেন্ট এলাকা’ ব্যবস্থা চালু হয়। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে যে স্কুল রয়েছে সেখানেই ভর্তি হতে পারবেন শিক্ষার্থীরা। অন্য এলাকার স্কুলে চাইলেও ভর্তির সুযোগ নেই।

ডুমুরিয়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার সিকদার আতিকুর রহমান বলছেন, আমার কর্মজীবনে আমি কখনও এরকম দেখিনি। একটা স্কুলে মাত্র একজন শিক্ষার্থী। বিষয়টা খুব বিরলই বটে।

তিনি জানান, জায়গাটি খুবই দুর্গম। মাঝে মাঝেই পানি ওঠে। তাই অনেকেই এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। একটি রাস্তা তৈরি করে দ্বীপটির সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, স্কুলটির অবস্থান ডুমুরিয়ার একেবারে শেষ প্রান্তে, পার্শ্ববর্তী জেলা যশোরের কেশবপুর লাগোয়া। আমরা এখন প্রস্তাব পাঠিয়েছি স্কুলটি বন্ধ করে কেশবপুরের একটি স্কুলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী স্থানান্তরের। প্রস্তাবটি গৃহীত হলে আমরা সেটি বাস্তবায়ন করব।

কিন্তু তাপস কুমার মণ্ডল বলেন, এই স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে সবচেয়ে কাছের স্কুলটি হবে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

Development by: webnewsdesign.com