উত্তরাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী কুমড়োর বড়ি তৈরীতে ব্যস্ত বৌ-শাশুড়ি ও মেয়েরা

বৃহস্পতিবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২১ | ২:৫৬ অপরাহ্ণ

উত্তরাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী কুমড়োর বড়ি তৈরীতে ব্যস্ত বৌ-শাশুড়ি ও মেয়েরা
apps

প্রতি বছরের মত এবারও রাজশাহীর গোদাগাড়ী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাসহ গোটা উত্তরাঞ্চল জুড়ে মাসকলাই ও কুমড়োর বড়ি তৈরিতে হাজার হাজার বউ, শাশুড়ি, মা, বোনেরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। শীত মৌসুমের সময়ে মাসকলাইয়ের ডালের আটা ও পাঁকা চাল কুমড়ো মিশিয়ে এ সুস্বাদু বড়ি তৈরি করা হয়। এ অঞ্চলের নারীরা শত শত বছরের ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য কয়েক মাস পূর্বে থেকে চাহিদা মত চাল কুমড়ো পাঁকানোর ব্যবস্থা করে থাকেন।

নতুন কলাই জমি থেকে ঘরে, বাজারে আসার সাথে সাথে বড়ি তৈরির ধুম পড়ে যায়। এ সব এলাকার ৮০ ভাগ মহিলারা পালা করে বড়ি দেয়ার কাজটি করে থাকেন। পাক পবিত্র অবস্থায় বড়ি দিতে হয়। অপবিত্র অবস্থায় দিলে বড়ি রং হলুদ হয়ে যায় এবং গন্ধ হলে যায়, স্বাদ লাগে না। বড়ির প্রধান উপাদান ভাল জাতের মাসকালই সংগ্রহ করে প্রথমে সূর্যেও আলোতে শুকিয়ে জাতাতে ডালের আকার দেয়া হয় এবং ওই ডালকে পানিতে ৫/৬ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে ভালভাবে হাত দিয়ে চটের ছালায় ঘুষে ডালের খোসা ছড়ানো হয়, তারপর পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে রোদে শুকাতে হয়। শুকানো ডাল (জাতার দ্বারা) আটায় পরিণত করা হয় এবং খুব সকালে পাঁকা কুমড়োকে দুভাগ করে কেটে কুরানি দিয়ে চিকন করে নিয়ে কুমড়োর বিচি আলাদা করে নিতে হয়। ওই কলাইয়ের আটা ও কুরানো কুমড়ো একটি পাতিলে মিশিয়ে দীর্ঘ নাড়াচাড়া করতে হয়। মিশ্রণ ঠিকভাবে হয়েছে কি না তা দেখার মহিলারা মাঝে মাঝে বড়ির আকৃতি করে পানির পাত্রে ছেড়ে দিলে তা যদি ডুবে যায় তবে আরও ফেনাতে (নাড়াচাড়া করতে) হয়, আংশিক ভাসলে বড়ি তৈরি উপযোগী হয়েছে বলে তারা মনে করেন।

২/৩জন মহিলা সুতি মশারী কিংবা প্লাস্টিকের জ্বাল দড়ির খাটের উপর বিছিয়ে দিয়ে এর উপর ওই মিশ্রণ বড়ি আকৃতি করে লাইন করে দেয়া হয়। ৩/৪ দিন ভাল করে রোদে শুকাতে হয়। মেঘলা ও ঘন কুয়াশা থাকলে বড়ি গন্ধ ও লাল হয়ে যায়। সে গুলি সহজে সিদ্ধ হয় না। খেতেও ভাল লাগে না। ভালোভাবে শুকিয়ে মুখ আটানো পাত্রে সংরক্ষণ করলে ১২ থেকে ১৪ মাস পর্যন্ত খাওয়া যায়। অনেক গৃহবধূরা মাসকলাইর সাথে পিয়াজ, পাঁকা লাউ, আলু, পেঁপে, কপিসহ নানা পদের সবজি মিশিয়ে বড়ি তৈরি করে থাকেন। বিশেষ করে পিয়াজের বড়ি বেশ সুস্বাদু কিন্তু এগুলো বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় না। আগের দিনে প্রায় বাড়ির ছাদে, ঘরের টিনের উপর কিংবা চালে পাঁকা কুমড়া দেখা যায় আর জমিতে তো মাস কলাই হতো অনেক বেশি। কিন্তু এখন নদীর ভাঙনে চরে বেশির ভাগ জমি নদী গ্রাস করেছে। পলি মাটির পরিবর্তে হাজার হাজার একর জমিতে শুধু বালি আর বালি পড়ায় কলাইয়ের আবাদ কমে গেছে। আগে যে কলাই বড়ি দেয়ার জন্য বিনামূল্যে পাওয়া যেত সে কলাই এখন ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর বড়ি দেয়ার ডাল বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি। কুমড়ো বিক্রি হচ্ছে ১৫/২০ টাকা কেজি এতে ১টি বড় সাইজের কুমড়ো ১শ’ থেকে ১শ’ ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ঘরে তৈরি করা ডালের বড়ি রেডিমেট কেনা ডাল দিয়ে বড়ির চেয়ে অনেক বেশি সুস্বাদু। বড়ির উপকরণের মূল্য বেশি হওয়ায় বড়ি তৈরিতে এখন খরচ অনেক বেশি হচ্ছে। অনেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বড়ি তৈরি করে বিভিন্ন বাজারে হাটে বিক্রি করে জীবন-জিবিকা নির্বাহ করে থাকেন। কিন্তু বর্তমানে বড়ির উপকরণের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধির কারণে তারা বড়ি তৈরির আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।

বড়ির সাথে ইলিশ মাছ, চিংড়ি মাছ, বেগুণ, হাঁস, মুরগীর ডিম বেশ মজাদার খাবার। বড়িকে এককভাবে রান্না করে খাওয়া যায়। বিদেশে বড়ি এখন বেশ জনপ্রিয় অনেকে আত্মীয়-স্বজনের নিকট বিদেশে বড়ি পাঠাচ্ছেন এবং বিদেশে পাড়ি দেয়ার সময় তরকারি হিসেবে বড়িকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী পৌরসভার মহিশালবাড়ী মহল্লার গৃহবধূ জোহরুন নেসা বলেন, বড়ি দেয়া কাজটি খুব পরিশ্রমের কাজ। তারপরেও এলাকার ঐতিহ্য ধরতে রাখতে করতে ভালই লাগে। দেশ বিদেশের আতœীয় স্বজনদের দিয়েও আনন্দ পাই, অসময়ের তরকারী হিসেবে যখন তখন রান্না করে খাওয়া যায়। জাতীয় মাছ ইলিশ ও বেগুনের সাথে বড়ি রান্না করে খেতে ভাল লাগে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন এমবিবিএস ডাক্তার জানান, বড়ির পুষ্টি গুণ অনেক বেশি, পেটের জন্য বেশ উপকারী, রুচি সম্মতভাবে খাওয়া যায়। দীর্ঘ সময় ক্ষুধা নিবারণের কাজ করে থাকেন।

Development by: webnewsdesign.com