ইতিহাসে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতা করেন এক মুসলিম নারী

সোমবার, ০৯ নভেম্বর ২০২০ | ২:৪৬ অপরাহ্ণ

ইতিহাসে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতা করেন এক মুসলিম নারী
apps

ফাতিমা বিনতে মুহাম্মাদ আল-ফিহরিয়া আল- কুরাইশিয়া, মানবজাতির ইতিহাসে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতা। আরব্য মহীয়সী এই মুসলিম নারীর প্রতিষ্ঠিত আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়টি মরক্কোর উত্তরাঞ্চলের ফেজ শহরে অবস্থিত। ইউনেস্কো এবং গিনেস বুক ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের তথ্যানুসারে, বিশ্বের সবচেয়ে পুরাতন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন পর্যন্ত উচ্চশিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন স্কলারও আল-কারাওইনকে সবচেয়ে পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে উল্লেখ করেন। ৮৫৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন ফাতিমা আল-ফিহরিয়া। শুরুতে এটি মসজিদ ছিল। পরবর্তীতে মুসলিম ইতিহাসেই এই প্রতিষ্ঠানটি আধ্যাত্মিক এবং শিক্ষার অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে নেতৃত্ব দেয়। ১৯৬৩ সালে মরক্কোর সরকার আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়কে তার আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় পদ্ধতির অংশ হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করে।ফাতিমা বিনতে মুহাম্মাদ আল- ফিহরিয়া একজন আরব্য মহীয়সী মুসলিম নারী। বংশ পরম্পরায় তিনি তিউনিসিয়ার ও কাইরাওয়ান শহরের প্রতিষ্ঠাতা উকবা ইবনে নাফে আল-ফিহরি আল-কুরাইশিয়া। তাদের পারিবারিক নামের কুরাইশিয়া অংশ থেকে ধারণা করা হয় তারা ছিলেন কুরাইশ বংশের উত্তরাধিকারী। তিনি তিউনিশিয়ার ও কাইরাওয়ান শহরের অতীত স্মৃতি। মরক্কোর ফেজ শহর এবং তিউনিশিয়া ও মরক্কোর ইতিহাসে অমর হয়ে থাকা এক ব্যক্তিত্ব।

ধারণা করা হয়, ফাতিমা আল-ফিহরি ৮০০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তৎকালীন আফ্রিকার রাজধানী কাইরাওয়ান থেকে বৃহত্তর মরক্কো ইদ্রিসিয়ার রাজধানী ফেজ শহরে হিজরত করেন। সেখানেই একটি মসজিদ নির্মাণ করেন ফাতিমা। যা পরবর্তীতে ধাপে ধাপে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ লাভ করে। সেখানে জ্ঞানের নানা শাখা-প্রশাখার উপর পাঠদান করা হতো। শিক্ষা সমাপ্ত করে অনেক বড় বড় বিদ্বান বের হতেন, যার আলোর বিকিরণ পৌঁছে যায় মধ্যযুগের সুদূর ইউরোপ পর্যন্ত। যখন ইদ্রিসিয় শাসন আমলে দ্বিতীয় ইদ্রিস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক ফেজ শহরের কথা স্মরণ করা হয়। তখন প্রাসঙ্গিকভাবে কাইরাওয়ানের মহাবিদদের সঙ্গে কারাওইন জামে মসজিদ ও কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা এসে যায়।তারা ফেজ শহরের সুলগ্নে বিশাল কারাওইন উপত্যকাজুড়ে বসবাস করতেন। সে সকল মহাবিদদের মধ্যে ছিলেন ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ আল- ফিহরিয়া। যিনি আমির ইয়া ইয়া বিন মুহাম্মদ বিন ইদ্রিসের শাসনকালে নিজ পিতা কায়রোয়ান ফিকাহ মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ আল-ফিহরি এবং বোন মারিয়ামের সঙ্গে তিউনিশিয়া থেকে ইদ্রিসিয়া সাম্রাজ্যের রাজধানীতে আসেন।

ফাতিমা আল-ফিহরি অন্য আরবদের সঙ্গে তার মূল নিবাস তায়বং থেকে বৃহত্তর মরক্কোতে পালিয়ে আসেন। তারপর দ্বিতীয় ইদ্রিসের শাসনামলে কারাওইন উপত্যকায় বসবাস শুরু করেন। এখানেই তিনি বিয়ে করেন। তবে বিয়ের কয়েক বছরের মাথায়ই ফাতিমাদের পরিবারে দুর্যোগ নেমে আসে। অল্প সময়ের মধ্যেই তার বাবা, ভাই এবং স্বামী মৃত্যুবরণ করেন। বেঁচে থাকেন কেবল এতিম দুই বোন ফাতিমা এবং মারিয়াম।বাবার রেখে যাওয়া বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির উত্তরাধিকার হন তারা। মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী, পিতার কাছ থেকে পাওয়া সম্পত্তি ব্যয় করার ক্ষেত্রে কন্যারা কারো কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য না। ফাতিমা এবং মারিয়ামও চাইলে এই সম্পত্তি যেকোনোভাবে ব্যয় করতে পারতেন। তবে কোনো বিলাসিতার পেছনে ব্যয় না করে তারা সিদ্ধান্ত নেন, এই অর্থ তারা ব্যয় করবেন ধর্মের জন্য, মানবতার কল্যাণের জন্য। সাজসজ্জার কিংবা বিলাসিতার পণ্য ক্রয় না করে সিদ্ধান্ত নেন, তারা ক্রয় করবেন জনগণের ভবিষ্যত।
ফাতিমার জীবন সম্পর্কে খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতকের ঐতিহাসিক ইবনে আবি-জারা যা উল্লেখ করেছেন, এর চেয়ে বেশি বিস্তারিত ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে তেমন কিছু জানা যায় না। ১৩২৩ খ্রিস্টাব্দে কাইরাওয়ানের এক বিরাট অগ্নিকাণ্ড হয়। আর সেই অগ্নিকাণ্ডে সংরক্ষিত নির্ভরযোগ্য সব নথিপত্র নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরেও এখনও এতে প্রায় ৪,০০০ প্রাচীন এবং দুর্লভ পাণ্ডুলিপি আছে। এর মধ্যে আছে নবম শতকে লেখা একটি কোরআন শরিফ, হাদিসের সংকলন, ইমাম মালিকের গ্রন্থ মুয়াত্তা, ইবনে ইসহাকের লেখা রাসুল (সা.)-এর জীবনী, ইবনে খালদুনের লেখা কিতাব আল-ইবার এবং আল-মুকাদ্দিমার মূল পাণ্ডুলিপিসহ বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ।তার পিতা মহাবিদদের মধ্যে একজন ছিলেন। তিনি ছিলেন কাইরাওয়ানের আরুপতিউই সিয়ান। তিনি ছিলেন অনেক ধন সম্পদের অধিকারী। তার দুই মেয়ে ফাতিমা ও মারিয়াম ছাড়া আর কোনো সন্তান ছিল না। তিনি তার দুই মেয়েকে উত্তম রূপে শিক্ষা দিয়ে বড় করেন। যখন তিনি মৃত্যুবরণ করলেন, তখন তার দুই মেয়ে তার সব সম্পত্তির অধিকারী হলেন।

ফাতিমা দীর্ঘকাল ভাবছিলেন, এতো সম্পদ তিনি কোথায় ব্যয় করবেন? এক সময় সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করবেন যা তার মৃত্যুর পর স্মৃতি হয়ে থাকবে। তার ও পৃথিবীবাসীর মাঝে একটি সম্পর্কের সূত্র হয়ে এই আমল পরকালে পাকের হবে। যা থেকে তিনি অনন্তকাল প্রতিদান পেতে থাকবে। ২৪৫ হিজরির রমজান মাসে পিতার উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পত্তি থেকে মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করলেন। প্রতিবেশি এক লোক থেকে আশপাশের এক মাঠ কিনে এর আয়তন দ্বিগুণ করলেন। নিজের জমিও মসজিদের সঙ্গে মিলিয়ে দিলেন। আন্তরিক আগ্রহের সঙ্গে বিপুল অর্থ তিনি এতে খরচ করলেন। ফলে সুদৃঢ় আলংকারিক কাল কারুকার্য গঠিত একটি মনোমুগ্ধকর মসজিদ হয়ে উঠলো।

ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেন, ফাতিমা আল-ফিহরি মসজিদটি নির্মাণের সংকল্প করার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে রোজা রাখতে শুরু করেন। তিনি মানত করেন, একদিনও রোজা ভাঙবেন না, যতদিন না মসজিদের নির্মাণ কাজ পরিপূর্ণ শেষ হয়ে যায়। এরপর মসজিদের নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে গেলে তিনি মসজিদে গিয়ে সর্বপ্রথম দুই রাকাত শোকরানা নামাজ আদায় করেন।
অনেক ঐতিহাসিক উল্লেখ করেন, এই মসজিদই পরবর্তীতে ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপলাভ করে। যেখানে জ্ঞানের নানা শাখা-প্রশাখার উপর উচ্চতর পাঠদান করা হতো। ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন বলেন, কারাওইনের জামে মসজিদ মরক্কোতে ইসলাম ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে সুদীর্ঘকাল। এরপর এই নেতৃত্বে জ্ঞানের বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ে সুদূর ইউরোপেও। একসময় কারাওইনের জামে মসজিদ বৃহত্তর মরক্কোর প্রথম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং বৃহৎ আদি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়ে যায়। এভাবেই ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ আল-ফিহরিয়া পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। অবশেষে ২৬৫ হিজরির মোতাবেক, ৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ আল-ফিহরি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর ৯১৮ সালে সরকার মসজিদটিকে অধিগ্রহণ করে এবং একে সরকারি মসজিদ হিসেবে ঘোষণা করে। যেখানে সুলতান নিয়মিত নামাজ আদায় করতে শুরু করেন। দ্বাদশ শতকের দিকে পুনরায় পরিবর্ধনের পর এটি একসঙ্গে ২২,০০০ মুসল্লিকে ধারণ করার সক্ষমতা অর্জন করে।

ফাতিমার প্রতিষ্ঠিত কারাওইন মসজিদ এবং কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়টিকে কেন্দ্র করে ফেজ হয়ে উঠতে থাকে আফ্রিকার ইসলামী শিক্ষার প্রধান কেন্দ্র। শুধু মুসলমান নয়, মধ্যযুগের অনেক খ্যাতিমান ইহুদি এবং খ্রিস্টান মনীষীও এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরিয়েছেন। এর ছাত্রদের মধ্যে একজন ছিলেন পোপ দ্বিতীয় সিলভাস্টার। যিনি এখান থেকে আরবি সংখ্যাপদ্ধতি বিষয়ে ধারণা লাভ করে সেই জ্ঞান ইউরোপে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং ইউরোপীয়দেরকে প্রথম শূন্যের ধারণার সঙ্গে পরিচিত করেছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিখ্যাত মালিকি বিচারপতি ইবনে আল-আরাবি, ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুন এবং জ্যোতির্বিদ নূরুদ্দীন আল-বিতরুজি। প্রতিষ্ঠার পরপর ফাতিমা নিজেও কিছুদিন এখানে অধ্যয়ন করেছিলেন।কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিটিকেও বিশ্বের প্রাচীনতম লাইব্রেরি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই লাইব্রেরিতে বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ রয়েছে। একবার জানিয়েছি, আগুনে পুড়ে বিপুল সংখ্যক পাণ্ডুলিপি নষ্ট হয়ে যায়। তারপরও এখনো প্রায় ৪,০০০ প্রাচীন এবং দুর্লভ পাণ্ডুলিপি আছে।ফাতিমা আল-ফিহরি ইন্তেকাল করেন ৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু তার প্রতিষ্ঠিত কারাওইন মসজিদ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং লাইব্রেরি আজও দাঁড়িয়ে আছে সগৌরবে। তার প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গত সহস্রাধিক বছরে লক্ষাধিক শিক্ষার্থী পাশ করে বেরিয়েছে। তার স্বদেশী আরব, মুসলিম বিশ্ব এবং সর্বোপরি মানব সম্প্রদায়কে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার ক্ষেত্রে এবং বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে ফাতিমার অবদান অপরিসীম।

Development by: webnewsdesign.com